জীবন - রাজশ্রী


পুণে  স্টেশন থেকে হাওড়াগামী দুরন্ত এক্সপ্রেস ছাড়ল। থ্রী টিয়ার সাইড লোয়ারে বসে পরলেন প্রতিভা। পরনে হালকা গোলাপী রঙের শাড়ী  সুটকেশ সিটের  নীচে ঠিক ঠাক রেখে দিল গাড়ির ড্রাইভার। তারপর নমস্তে জানিয়ে ট্রেন থেকে নেমে  গেল।এই সিটটা খুব পছন্দের প্রতিভার সেই ছোটবেলা থেকে। ছোটবেলা  শিলিগুড়িতে কেটেছে বাবার চাকরির সূত্রে। মামা বাড়ি কলকাতায় গেলে সাইড লোয়ার পেলে  কি আনন্দ হত। সারা রাত প্রায় জেগে  জেগে জানলা দিয়ে দেখতেন অন্ধকারে টিম টিম করে আলো জ্বলছে দূরে কোনো গ্রামে। নাহলে কোনো স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ালে কুলির মাথায়  হোল্ডলবাক্স প্যাটরা উঠিয়ে যাত্রীরা ট্রেনে উঠত  যারা ঘুমিয়ে থাকত তারা  বিরক্ত হত। বাবা বলতেন প্রভা শুয়ে পরো   দেখো তোমার বোন ঘুমিয়ে পরেছে  প্রতিভা শুয়ে পরত ,ট্রেনের  শব্দ শুনতে শুনতে জুড়িয়ে আসত চোখ 

প্রতিভা এসেছিলেন মেয়ের বাড়িতেগত  একবছর ছিলেন। মেয়ে জামাই দুজনেই আইটি সেক্টরে  জব করে।মেয়ে লীলার  যমজ দুই ছেলে হয়েছেসেইই জন্যই আসা পুনেতে। আয়ার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হত প্রতিভাকে। বাচ্চারা তিন মাসের হওয়ার পরে মেয়ে জব জয়েন করেছে।প্রতিভার বাড়ি শিলিগুড়িতেছেলে অয়নবৌমা  পিয়ালী  আর নাতনি রু  থাকে বাড়িতে। প্রতিভাকে তাড়াতাড়ি যেতে হচ্ছে বৌমা প্রেগনেন্ট বলে। ছেলে ডেকে পাঠিয়েছে "তুমি এসোস্কুল থেকে আসার পরে রুকে তোমাকে দেখতে হবে। "পাড়ায় একটা সুন্দর ক্রেস হয়েছেকিন্তু ছেলে সেখানে মেয়েকে রেখে টাকা অহেতুক খরচ করবে  না। সাত বছরের রু অনাসায়ে ওখানে থাকতে পারে কিন্তু মা থাকতে ক্রেসে রাখার কোনো মানে হয় না অয়নের  কাছে

 বসে থাকতে থাকতে হটাৎ মাথাটা ঝিম ঝিম করছে প্রতিভার।  মনে পরে গেল আজকে আসার  সময় প্রেসারের ট্যাবলেট খাওয়া হয় নি। একটু জল বিস্কুট খেয়ে ট্যাবলেট খেলেন তিনি। তারপর শুয়ে  পরলেন। করোনা হওয়ায় পর থেকে পর্দা দেওয়া থাকে না ট্রেনে । খুব অসুবিধা হয় সকলের সামনে শুয়ে থাকতে।  কিছু করার নেইতাই মাথা   পর্যন্ত সাদা চাদর ঢেকে পাশ ফিরে  ঘুমানোর চেষ্টা করলেন প্রতিভা। অবশ্য এই দুপুরে অনেকেই শুয়ে আছে। মন  চলে যায় অতীতে,  বাবা   ব্যাঙ্কের  ম্যানেজার ছিলেন। চাকরির জন্য কত জায়গায় ঘুরতে হয়েছে তাদেরকে।  তবে  বাবা শিলিগুড়িতে  থাকার সময় বাড়ি করেছিলেন।  আকাশ পরিষ্কার থাকলে ছাদে উঠলেই দূরে পাহাড় দেখা যেত। প্রতিভা  ছুটির দিনে বই নিয়ে ছাদে পড়তে পড়তে দূরের আবছা হয়ে যাওয়া পাহাড় দেখত। একবার  গরমের ছুটিতে দার্জিলিং  যাওয়া হল সকলে মিলে। সে কি  আনন্দ উত্তেজনাজীবনে প্রথম পাহাড়ে যাওয়ার।  টয় ট্রেনে করে পাহাড় ভেঙে ভেঙে ওপরে ওঠার আনন্দই আলাদা। পাহাড়ি  ঝর্ণা কেমন এঁকে বেঁকে বয়ে যাচ্ছে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল বোনের সঙ্গে। চারিদিকে সবুজ ফারপাইনদেবদারু কোথাও বুনো ফুল ফুটেছে দেখতে দেখতে যাচ্ছিল প্রতিভা।  কাঠের  কটেজের সামনে বসে নেপালি মেয়েরা উল বুনে চলেছে একমনেলাল লাল গালওয়ালা বাচ্চারা খেলে বেড়াচ্ছে এদিকে ওদিকে।ট্রেন ধীর গতিতে চলেছে।   হালকা হালকা কুয়াশায়  ঘেরা ঘুম স্টেশনে এসে ট্রেন থামলে তারা গরম গরম চা খেয়েছিলকি অপূর্ব ফ্লেভার সেই চায়ে। আস্তে আস্তে হুইসেল বাজাতে বাজাতে ট্রেন ঢুকল দার্জিলিংয়ে

 মেমসাব  ডিনার লিজিয়েঘুম ভাঙল প্রতিভার।  সামনেই হাসিমুখে ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা। তার হাত থেকে ট্রে নিল প্রতিভা। চারিদিকে অন্ধকার তখনএতক্ষন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল প্রতিভা। "এই হয়েছে আমার শুলেই ছোটবেলায় ফিরে যাই।" খুব মন খারাপ করে বাবা মা বোনের জন্য। বাবা মা,বোন নেই ভাবতেই ইচ্ছে করে না। মনে হয় সবসময় পাশেই আছে। কিন্তু সত্যিই নেই। ঠিক পনেরো বছর বয়েসে দুদিনের জ্বরে মারা যায় বোন রঞ্জা।  আজ রঞ্জা বেঁচে থাকলে তাঁর এই অবস্থা হত না। নিজের বাড়ি থাকতেও তাকে যাযাবরের মত জীবন কাটাতে হচ্ছে। একবার মেয়ের কাছে পুনেতে আর একবার ছেলের কাছে শিলিগুড়িতে। সকলে তাকে প্রয়োজনে ব্যবহার করে নিচ্ছে। চিন্তা করতে করতে জিরা রাইস আর পনীর   খাচ্ছেন প্রতিভা

হাই প্রেসারসুগারথাইরয়েড,, মাইগ্রেনকলেস্টোরেল কি নেই এই শরীরে। তবু বিশ্রাম নেই। এখন নিজের ছেলে মেয়েও স্বার্থপরসকলে শুধু নিজেরটা ভাবে। কিন্তু সবাই এক নয়কপালের দোষ বলবেন না সমাজের দোষ দেবেন বুঝতে পারেন না প্রতিভা

বিয়ের  হয়েছিল অঙ্কিতের সঙ্গেশিলিগুড়িতে বাড়ি কিন্তু চা বাগানে কর্মরত ছিলেন।  বিয়ের পরে  সুন্দরভাবে  সবুজ প্রকৃতির মাঝে জীবন  কাটাতে পেরেছিল প্রতিভার। চারিদিক  সবুজবাংলোর বারান্দায় বসে বসে গল্পের বই পড়তে  কি ভালো লাগত। দূরে পাহাড়  দেখা যেতআকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা। বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা রোদের আলো পরে অত দূর থেকেও ঝক ঝক করত।  দূরের কুলি লাইন থেকে মেয়েরা যেত পিঠে ঝুড়ি নিয়ে চা পাতা তুলতে। সন্ধ্যে বেলা দূর থেকে মাদল বাজিয়ে গান শোনা যেত। অঙ্কিত বলত "ওই দেখ  হাঁড়িয়া খেয়ে গান শুরু হয়ে গেছে। "প্রথম দিকে  বাড়ির জন্য খুব মন খারাপ করত প্রতিভার । বয়সও অল্প ছিল। মাঝে মাঝে হাতির দল ঢুকে পরত বাগানে তখন খুব ভয় লাগত।একসময় বিপ্লবীদের আনাগোনা বাড়ল এই তল্লাটে।  অঙ্কিত বলত বাড়িতে কাজের এতগুলো লোক থাকলেও সজাগ থাকতে। সেই  বিপ্লবীদের দেখার ইচ্ছে হতসাহায্য করতে মন চাইত। যারা দেশমাতার জন্য নিজেদের জীবন তুচ্ছ  করেছেন সেই মানুষগুলোকে  দূর থেকে শ্রদ্ধা করত সে। বাবাকে চিঠি লিখে জানাতো তার মনের সব  কথা।  বাবাও লিখতেন দেশের সমস্ত খুঁটিনাটি খবর। প্রতিভা প্রাণ খুলে কখনও নিজের মনের কথা অঙ্কিতকে বলতে পারেন নি। অঙ্কিতের  ব্যক্তিত্বের কাছে  কোনোদিনই সহজ হতে পারেন নি প্রতিভা।  তিনি শ্রদ্ধা করতেনযত্ন করতেন হাসব্যান্ডকে। কিন্তু ভালোবাসা সে তো মনের ব্যাপার। বিয়ে হলেই কি ভালোবাসা যায়। মন  যে বড় অদ্ভূত। একবার কলকাতা থেকে এসেছিল  একটা ছেলে নাম নিলয় শিলিগুড়িতে  প্রতিভাদের পাশের বাড়িতে। তখন প্রতিভা পনেরো আর নিলয়  প্রায় সমবয়েসি। বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিলপ্রতিভার কাছ থেকে গল্পের বই নিয়ে যেত। প্রায় একমাস গরমের ছুটি কাটিয়ে কলকাতায় ফিরে গিয়েছিল। তারপর  সম্পর্ক ভালোবাসা অবধি গড়িয়েছিল ওই চিঠির মাধ্যমে। কিছুদিন পরে চিঠি আসা বন্ধ হল কিন্তু প্রতিভার মনে ভালোবাসারা থেকে গেল

 তারপর ছেলে মেয়ে  সংসার নিয়ে কিভাবে এতগুলো বছর কেটে গেল ভাবাই যায় না। গত কয়েক বছর আগে অঙ্কিত চলে গেলেন। প্রতিভা ভাবেন নি এত একা হয়ে যাবেন। বাড়িতে ছেলের ফ্যামিলি থাকা স্বত্বেও একা প্রতিভা। ওদের আলাদা জগৎ। কেউ দরকার ছাড়া কথা বলে না। গল্প করতে আসে না  ছেলে অয়ন। আর  বৌমা পিয়ালী সব সময় ব্যস্ত মেয়েকে নিয়ে। কেউ মন্দ নয় আসলে খুব ব্যস্ত

 এখন নারী দিবস পালন করা হয় ঘটা করে। কিন্তু নারীকে বোঝার মত মানুষ কোথায়ভাবেন তিনি। নারী শুধু প্রয়োজনে ব্যবহার হয়। আজ তাঁর অনেক মূল্য ছেলে মেয়ের কাছে। মেয়ে ডাকছে তার নিজের স্বার্থে। ছেলেও বলছে "মা তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি এসোতোমাকে বড্ড প্রয়োজন ।"পিয়ালী  নার্সিংহোমে ভর্তি হলে নাতনি  রুকে দেখাশোনার জন্য  বিশ্বস্ত কাছের লোকের   ভীষণ দরকার। সেটা হলেন প্রতিভাকারণ তিনি বিনা পয়সার আয়া। ছেলে  সচেতন তার সংসার নিয়ে। 

 অয়নের নিজস্ব ফ্ল্যাট থাকা স্বত্বেও বাড়িতে  আছে। ফ্ল্যাট রেন্টে দিয়েছে। তাহলে কিছুটা হলেও লোন শোধ করতে সুবিধে হবে। একই বাড়ির এক তলায় প্রতিভা থাকেন আর ওরা থাকে দোতলায়। অয়নের ভয় বোনকে বাড়ির  অর্ধেক অংশ  মা লিখে দেবে। তিনি মনে  করেন ভয় থাকা ভালোকারণ একজনকে  সব কিছু দেওয়ার পক্ষপাতি তিনি নন।  তাঁর যা আছে সব কিছু সমান ভাবে ভাগ করে দেবেন। তবে দুজনকেই তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে

 তিনি বুঝে গেছেন জীবন বড় কঠিন। ছেলে মেয়ে কখনও জানতে চায় না "মা তুমি  কেমন আছো। "প্রতিভাও জানান না কোনো অভিযোগকারণ বিবেককে  জাগানো তার কাজ নয়। তিনি যা শিক্ষা দিয়েছেন ছেলে মেয়েকে সেখানে নিস্বার্থ হওয়ার কথা ছিল। তিনি শিক্ষিত করেছেন  দুজনকেই কিন্তু উপযুক্ত মানুষ করতে পারেননি। এত কাছে থেকেও ওরা প্রতিভার মত হয়নিকোথায় যেন মনে হয় ওরা অঙ্কিতের প্রতিবিম্ব

 ট্রেন এসে পৌঁছলো হাওড়া স্টেশনে,  কোনোরকমে নামলেন।   এক ভদ্রলোক সুটকেশ নামিয়ে দিলেন প্লাটফর্মে। কুলি নিতে হল। লম্বা লাইন পরেছে ট্যাক্সির জন্য।  অতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়।  কুলি ছেলেটি এত ভালো যে কাউন্টারে বলে একটা হলুদ ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিল কিছুক্ষনের মধ্যে। যাইহোক অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে প্রতিভা রওনা হল শিয়ালদার  দিকে।  শিয়ালদা স্টেশনে যাওয়া মানেই যেন উত্তরবঙ্গের  জন্য মন কেমনের হু হু  আরও বেড়ে যায়।  সবুজ পাহাড় আর ঝর্না যেন হাতছানি  দিয়ে  ডাকে

রাত দশটাদার্জিলিং মেললোয়ার বার্থে জানলার ধারে বসে আছেন প্রতিভা। তিনি এখন অমূল্যঅতি প্রয়োজনীয় একটা জিনিস এই সংসারে।   ছেলে বৌ তার অপেক্ষায় অন্যদিকে মেয়ের চোখে জল নিয়ে বলছে "তুমি না থাকলে কিভাবে চলবে আমাদের।"

 আজ আট তারিখ মার্চেরমোবাইলে দেখলেন  আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দেশ বিদেশ জুড়ে পালন করা হচ্ছে। যেসব  মহিলারা প্রতিষ্ঠিত এই সমাজেনানাভাবে সমাজের মানুষকে সাহায্য করছেন তাঁদেরকে সম্মানিত করা হল। ভালো লাগল প্রতিভার

 ট্রেন ছুটে চলেছে আলো আঁধারিতেসংসারের অন্দর মহলে যারা নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন এই বয়েসেও সত্যিই তাঁদের কোনো মূল্যই দিল না এই সমাজ এই সংসার এই দেশ

 প্রতিভার চোখে জল,  হটাৎ মনে পরল নিলয়কেআসলে নিলয় তার মনের গভীরে কোথাও একটা থেকে  গেছে।দুঃখঅভিমান হলেই আজও তার কথা মনে পরে। কেন মনে পরে কোনো ব্যাখ্যা নেইআসলে মনকে বোঝা সত্যিই মুশকিল বিশেষ করে মেয়েদের

দূরের অন্ধকার দেখতে দেখতে চলেছে প্রতিভা উত্তর বাংলায়মন ফিরে যায় মেয়েবেলায়।  সেই সবুজ পাহাড় হাতছানি  দিয়ে ডাকে




1 মন্তব্যসমূহ

  1. বেশ ভালো একটা লেখা। বর্তমানে ভীষণ প্রাসঙ্গিক ও পরিচিত একটি বিষয়। শেষটা উত্তরণের মাধ্যমে হলে বোধ হয় আরেকটু ভালো লাগত। পরে আর পড়ে নিয়ে বিস্তর বানান সমস্যা রয়েছে। এছাড়া হটাৎ বানানটাও ভুল। ভালো থাকবেন।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন