দেশ বিদেশের অদ্ভুত খাবারের গল্প (পর্ব ১) - বাণী মিত্র



প্রতিটি মানুষেরই বেঁচে থাকার জন্য প্রাথমিক শর্ত হিসাবে প্রথমেই প্রয়োজন হয় খাদ্যের। মানুষ বিবর্তনের সাথে সাথে আগুনের ব্যবহার শেখে। সম্ভবত আগুনের ব্যবহারের সাথেই কাঁচা খাবারের পরিবর্তে রান্না করে খাবার তৈরি করার প্রচলন শুরু হয়। রান্না করা খাবার অতি অবশ্যই পূর্বের কাঁচা খাবারের তুলনায় অনেক বেশি স্বাদু হয়। ফলে মানুষ রন্ধন প্রণালী নিয়ে গবেষণা শুরু করে দেয়। এই গবেষণাকালে অনেক সময়েই বিভিন্ন কার্যকারণবশত অথবা দুর্ঘটনার ফলে কিছু নতুন খাবারের উৎপত্তি হয়ে যেত। রন্ধন শৈলীর নিরন্তর গবেষণা ছাড়াও বহু খাবার বিচিত্র পদ্ধতিতে হঠাৎ করে অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়ে যায়। এছাড়া মানুষের অফুরন্ত কৌতূহল এবং জিহ্বা তৃপ্তির বিভিন্নতাও বহু অদ্ভুত খাবারের জন্ম দেয়। সব খাবারই যে অত্যন্ত সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর হয় তাও নয়। আবার সমস্ত খাবার সবাই খেয়ে একই ভাবে তৃপ্তও হন না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ধরণের বিভিন্ন বিচিত্র খাবার ও তাদের আশ্চর্যজনক উৎপত্তি কাহিনী আছে। আজ এই রকমই কিছু খাবারের বিষয়ে কথা বলব।

ফুগুঃ


পাফার মাছ

১৭৭২ - ১৭৭৫ সালে ক্যাপ্টেন জেমস কুকের দ্বিতীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমুদ্রযাত্রার একটি রেফারেন্স লগে একটি বিশেষ ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৭৭৪ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর জেমস কুকের ডিঙ্গি নৌকা এইচএমএস রেজোলিউশনের (HMS Resolution)মাঝিরা বেশ কয়েকটি কাটাযুক্ত সামুদ্রিক মাছ (spiny tropical fish) ধরে রান্না করে খেয়েছিল। তারা জাহাজে রাখা শূকরের পালকে মাছের অপ্রয়োজনীয় অংশ যেমন মাথা, অঙ্গ ইত্যাদি খাওয়াত। সেদিন জাহাজে অবস্থিত যারা এই মাছ খেয়েছিলেন প্রত্যেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। দুর্বলতা, অসাড়তা এবং শ্বাসকষ্টে ভুগলেও সবাই বেঁচে যান। কিন্তু শূকরের পুরো পাল মারা গিয়েছিল। কারণ তারা মাছের লিভার এবং ডিম্বাশয় খেয়েছিল। সেই বিশেষ মাছটি হল পাফার মাছ বা “ফুগু”। একটি পাফার মাছের লিভার, চোখ এবং ডিম্বাশয় টেট্রোডোটক্সিন নামক এক প্রাণঘাতী বিষ সঞ্চিত রাখে। এই মাছকে বিশেষ উপায়ে রান্না করে খাওয়া গেলে চরম নেশায় আসক্তি হয়। এই ঘটনা থেকে “ফুগু” খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়।

ফুগু সাশিমি

পৃথিবীতে যত অদ্ভুত খাবার আছে তার মধ্যে অন্যতম ভয়ঙ্কর খাবার হল “ফুগু”। জাপানে পাফার মাছ দিয়ে এই পদটি তৈরি করা হয়। এই মাছে টেট্রোডোটক্সিন নামের এক বিশেষ প্রকারের বিষাক্ত নিউরোটক্সিনের অবস্থানের জন্য এই মাছ অত্যন্ত বিষাক্ত হয়। সঠিক পদ্ধতিতে রান্না না করা হলে এটি খেলে মানুষের মৃত্যু হওয়া অবশ্যম্ভাবী। বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে লাইসেন্সপ্রাপ্তির পরেই এই মাছ রান্নার অনুমতি পাওয়া যায়। অনেকসময় কিছু রন্ধন বিশেষজ্ঞ ইচ্ছে করে সামান্য পরিমাণ একটু বিষ রেখে দেন এই মাছে যাতে খাবার সময় মুখে এক প্রকারের অবশ অনুভূতি হয়। যদিও এই খাবারটি তীব্র শীতের হাত থেকে রক্ষা পাবার তাগিদেই খাওয়া শুরু হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে তা নেশার খোরাক রূপে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। জাপানের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের ফুগু পাওয়া যায়। যেমন -


ফুগু সাশিমি (Fugu Sashimi)- কাঁচা মাছের পাতলা ছোট টুকরো pieces)
ফুগু সুশি (Fugu Sushi) – সুশি ভাতের ওপরে পাফার মাছ বিছিয়ে পরিবেশিত হয়।
ফুগু নাবে (Fugu Nabe) – ফুগু হট পট
ফুগু কারাগে (Fugu Karaage) – ছাঁকা তেলে ভাজা পাফার মাছ
ফুগু শিরাকো (Fugu Shirako) - পাফার মাছের শুক্রথলি দিয়ে তৈরি পদ
ফুগু মিল্ট (Fugu Milt) – পাফার মাছের শুক্র থলিকে গ্রিল করে খাওয়া হয়।
ফুগু কাতসু (Fugu Katsu) – পাফার মাছের কাটলেট


সুরস্ট্রমিংঃ

হেরিং মাছ সুরস্ট্রমিং

পৃথিবীর সবথেকে উগ্র কটু গন্ধযুক্ত খাবার হোল সুইডেনের সুরস্ট্রমিং। হেরিং মাছ দিয়ে এই বিশেষ পদটি বানানো হয়। সুইডিশ “সুর” শব্দের অর্থ “টক” এবং “স্ট্রমিং” অর্থ হেরিং মাছ।

ষোড়শ শতকে এই বিশেষ খাবারটি আবিষ্কৃত হয়। কথিত আছে বাল্টিক সাগরে সুইডিশ জেলেরা হেরিং মাছ ধরত এবং এটিকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য বড় বড় ব্যারেলে নুন দিয়ে সংরক্ষণ করত। দুর্ঘটনাজনিত কারণে সামুদ্রিক লবণাক্ত জলীয় বাস্প ও প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে মাছের প্রোটিন ভেঙে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি করে এবং মাছে একটি উদ্ভট গন্ধ ও তীব্র টক স্বাদের সৃষ্টি করে। জেলেরা এটি খেয়ে বোঝে এই খাবারটি রান্না করা টাটকা মাছের থেকে অনেক বেশি সুস্বাদু। তারা এটি স্থানীয় মানুষদের খাওয়াতে শুরু করে। এইভাবে এই পদটি জনপ্রিয় হয়ে সারা সুইডেন তথা পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। নুন দিয়ে মাছকে পচানোর প্রক্রিয়াটি বেশ কয়েক মাস সময় নেয়, যা মাছকে এক বিশেষ স্বতন্ত্র স্বাদ এবং গন্ধ প্রদান করে। সুরস্ট্রমিং হল সুইডিশ জেলেদের দ্বারা রন্ধনসম্পর্কীয় সৃজনশীলতার একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

প্রাথমিকভাবে, সুরস্ট্রমিং মূলত সামুদ্রিক অঞ্চলের কৃষকের খাদ্য থাকলেও পরবর্তীতে এটি সমাজের সমস্ত সামাজিক শ্রেণীর মধ্যেই সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বর্তমানে এটি সুইডেনের জাতীয় খাবার এবং এটি সেদ্ধ আলু, টক ক্রিম এবং কাটা পেঁয়াজ দিয়ে পরিবেশন করা হয়।


 সুইডিশ রুটি 'থুনব্রাড' সহযোগে সুরস্ট্রমিং


বালুটঃ

বালুট

বালুট হল ফিলিপিন এবং অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলির একটি জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড। এটি ফিলিপিনের ঐতিহ্যবাহী ও বহু শতাব্দী প্রাচীন এক খাবার। যদিও ঐতিহাসিকদের মতে এই খাবারের প্রকৃত উৎপত্তি চীনে। প্রায় ১০০০ বছর ধরে

চিনে "মাও ডু" (mao dou) বা "নিষিক্ত হাঁসের ডিম" (fertilized duck egg) নামে একটি অনুরূপ খাবারের প্রচলন রয়েছে।

ফিলিপিনে বালুটের ইতিহাস দশম শতকে চীনে আসা চীনা ব্যবসায়ীদের দ্বারা উল্লেখিত রচনা থেকে পাওয়া যায়। কথিত আছে তাঁরা চিন থেকে ফিলিপিনে আসার সময় সাথে রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্য সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। যার মধ্যে হাঁসের ডিমে ভ্রূণের বিকাশ ঘটিয়ে তা সেদ্ধ করে খোসা থেকে খাওয়া হওয়ার চল ছিল। সময়ের সাথে সাথে খাবারটির ফিলিপিনো সংস্করণ তৈরি হয়ে যায় এবং স্থানীয় খাবারের অন্তর্গত হয়। ডিমগুলি সাধারণত রাস্তার খাবার হিসাবে বিক্রি হত, বিক্রেতারা "বালুট! বালুট!" বলে চিৎকার করে গ্রাহকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। "বালুট" নামটি ফিলিপিনো শব্দ "বালোট" থেকে এসেছে যার অর্থ "মোড়ানো"( wrapped)। ফিলিপিনের বিভিন্ন প্রদেশে এই খাবারকে তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী পরিবর্তন করে পৃথক পৃথক কয়েক প্রকারের বালুটের প্রচলন আছে। যেমন -

১. পিনয় (লাগুনা প্রদেশ) : ভ্রূণ ছাড়া অপরিণতপ্রাপ্ত ডিমকে সেদ্ধ করে বানানো হয়।
২. বালুট সা পুটি (বাতাংগাস প্রদেশ) : প্রচুর মশলা সহ ভিনিগারে ডিম ফুটিয়ে বানানো হয়।
৩. বালুট সা দাগাত (মিন্দানাও প্রদেশ) : সামুদ্রিক কচ্ছপের নিষিক্ত ডিম দিয়ে তৈরি করা হয়।

যদিও পরবর্তীকালে জানা যায় এই খাবারের জনপ্রিয়তার পিছনে ফিলিপিনো বিক্রেতাদের চাতুর্য ও দক্ষতার দায়ী। তাঁরা রান্নার বিভিন্ন পদ্ধতি, মশলার ব্যবহার এবং উপাদান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এক নতুন আঞ্চলিক বৈচিত্র্য তৈরি করে বর্তমানের রূপ দিয়েছেন। ফলে আজ এটি ফিলিপিনের একটি প্রিয় খাবার, যা সব বয়সের এবং সব অঞ্চলের মানুষ উপভোগ করে খান।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন