বিনোদ চমকায়। এইনিয়ে বেশ কয়েকবার। প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাকালের ক্লান্তিহীন তড়িৎশিখার মতন। অহরহ। বারবার। ক্লান্তিহীন। চমকাচ্ছে বিনোদ।
ছালওঠা শ্যাওলা ধরা চারটে দেওয়াল বিনোদকে ঘিরে
রেখেছে। মাথার ওপর ঝুরঝুরে লালচে টিন প্রতিদিনের মতন আজকেও নিদ্রাহীন রাতটাকে
ঢেকে রাখার চেষ্টা করে চলেছে। ঘষাটে কাঁচের ভেতরের হলুদ ফিলামেন্ট বিনোদকে
ধোঁয়াশাছন্ন করে রাখে। আধশোয়া বিনোদ। মুখ তুলে ওপরের দিকে চায় সে। শতচ্ছিন্ন টিনের
আস্তরণ ভেদ করে চোখ চলে যায় আকাশপানে। অন্ধকারের ছায়ায় ঢাকা পড়ে তারাগুলো। খুশি হয়
বিনোদ। হলদেটে এলোমেলো দাঁতগুলো বেড়িয়ে পড়ে অজান্তেই। কোটি কোটি তারা এখন তার হাতের
মুঠোয়।
বিনোদ তবু চমকায়।
সারিসারি খবরের কাগজ। সাদাকালো রঙিন। ভাঁজের পর ভাঁজ। স্তরে স্তরে স্তরীভুত। ঠিক যেন বল্লাল সেনের ঢিবির সুসজ্জিত ধ্বংসাবশেষ।
কাগজের দেওয়াল ঘরের টিন ছুঁয়েছে। ঘরের সমস্ত গ্লানি
ঢেকে দিয়েছে। তারই মাঝে
হামাগুড়ি দেয় বিনোদ।তিরিশ বছর ধরে দিয়ে কাগজের দেওয়াল গেঁথে তুলেছে সে। সবুজ,হলুদ, গোলাপি-কত রঙ। একেবারে রঙে
রঙিন হয়ে উঠেছে। সারারাত আবঝা আলোয় তারা গোনে বিনোদ। হাত বুলোয়। স্পর্শে
গন্ধে অনুভবে নিজের চেতনাকে জুড়িয়ে নেয়। তবু তৃপ্তি মেটে না। অবশেষে ক্লান্তি
আসে। ভোরের শরীর ঘুম খোঁজে।
আবার চমকায়
বিনোদ।
সারা শরীর উন্মুখ। মনেহয় বাইরে অনেকগুলো চোখ তার
ঘরটাকে লেহন করে চলেছে বারবার। হাজার চোখের কটাক্ষপাত সর্বক্ষণ সচেতন করে তোলে। আজ
বিনোদের ক্লান্তি নেই।
জানলার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে বিনোদ। কুকুরটা কাঁদছে। বড়
চাপা কান্না। ও প্রতিদিন আসে। লকলকে চোখ দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখে।
কি লোভ!
জিভ দিয়ে লালা ঝরছে অনর্গল। বিনোদেরও মুখ দিয়ে লালা
ঝরে ঘুম আসার সময়। বিনোদ মেঝের ওপর পড়ে থাকা কাগজটাকে ডেলা পাকিয়ে ছুড়ে মেরেছিল
একদিন। পরদিন বউ কাঁপতে কাঁপতে কাগজের টুকরোটাকে ফেরত দিয়েছিল।
ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন। মেয়েটার জ্বর। নিশ্বাসে খুব
কষ্ট।
বউটাও এভাবে ঘরে ঢুকতে চায়। সঙ্গে নিত্যনতুন
বার্তা-গ্যাস ফুরিয়ে গেছে! চাল নেই! বাজার চাই!ওষুধ চাই!কত দাবী!
“হবে!হবে! অত
তাড়া কিসের। একটু মানিয়ে নিতে শেখো। সামনের মাসে রিটায়ার করছি। এখন কিছু দিতে পারবো
না। একটু হিসেব করে চলো।”
“হিসেবের
ঘরটাও তোমার ঘরের মতন বোঝাই হয়ে গেছে। আর পারছিনা সামলাতে। এবার তোমার হিসেব
করার সময়।”
“সেইভাবেই তো
চলছি। একার উপার্জন। আর কত পারব?”
“তোমার
উপার্জনের উপায় আমি বের করব কি করে? যে দায়িত্ব দিয়েছো তা আর ক্ষমতায় কুলোচ্ছে কোথায়?”
“হবে হবে। সব
হবে। একটু ধৈর্য ধরো।”
“সেও তো তা
আর রাখতে চাইছে না।”
“কেন? গতকাল বাজার করে দিলাম। আর
ফুরিয়ে গেল?”
“গ্যাস
ফুরিয়েছে। সাত দিন হল।”
“কাঠ
পাতাগুলো কি জন্য আছে?”
“সেগুলোও
ফুরাতে আর বাকী নেই।”
‘লোভ! এত লোভ
ভালো নয়। লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু।”
“কিন্তু
মেয়েটাকে ভালো ডাক্তার না দেখালে এবার ও সত্যি সত্যি মরবে।”
বিনোদের
আঙুলগুলো নিশপিশ করে। বেঁকে যাওয়া খসখসে শক্ত আঙুলগুলো। বউটার গলাটা লতার মত। একেবারে
লাউয়ের ডগা। পাঁচ আঙুলেই শেষ। একেবারে নিশ্চিন্ত। শেষমেশ নিজেকে সামলে নেয় বিনোদ। দূত
অবধ্য। গোঁজ হয়ে নিজের জগতে ঢুকে পরে।
আবার চমকায় বিনোদ ।
কুকুরটা
কাঁদছে। ডুকরে কাঁদছে। কোথাও কোনো সাড়া নেই, এদিকে কুকুরটার শোক উথলে উঠছে যেন।
“বেরো! বেরো! দূর
হয়ে যা!”
ফিসফিস করে ওঠে বিনোদ। গলাটা হঠাৎ বসে গেছে যেন। বুকটা
ধড়াস ধড়াস করছে।
কুকুরটা খুব প্রিয় ছিল মেয়েটার। প্রতিদিন ওকে ভাত দিত
মেয়েটা।
“দাতব্য! দাতব্য! দাতব্য
পেয়েছিস তোরা? সবকিছু
মাগনা আসে না!”
বিনোদের সারা শরীর গরম হয়ে ওঠে। বউটা কেমন শিউরে ওঠে।
চোখ মুখ বেঁকে যায়। সহ্য হয় না। বিনোদ ঘরে ঢুকে পড়ে। সেই ঘর। লাল দেওয়াল। খবরের কাগজ
দিয়ে ঘেরা। মাথার ওপর মাকড়সার জাল ঘরের চালচিত্র তৈরি করে দিয়েছে। তিনফুটের
জায়গা। সেখানেই ঢুকে পড়ে। পড়ে থাকে স্তুপের মতন। খিদে পায় তার। শুকনো মুড়ি চিবোতে
থাকে। দাঁত সব নষ্ট। মাড়ি নড়বড়ে। তবু চিবোয়। প্রাণপণে। মাড়িতে অনেক জোর তার। মাংস ছিড়ে
নিয়ে পারে সে। একসময় দোমড়ানো মুড়ির টুকরোগুলো গলা নেমে যায়।
কুকুরটা আবার কেঁদে ওঠে।
খিদে! কত খিদে এদের! কিছুতেই মেটেনা! সবাই এতব্যস্ত কেন? মেয়েটা আবার মাংস ভালোবাসে। বউটার খিদে সাঙ্ঘাতিক। পাগলের মতন করে সবসময়। বিনোদ কাগজের দেওয়ালে হাত বুলোয়। ওপর
থেকে নীচে। সাদা রঙ নেমে গেছে হলুদ হয়ে। জগদ্দল পাথর। চেপে বসেছে। কেউ নড়াতে পারবে
না। বিনোদ হাসে।
কুকুরটা দরজায় ধাক্কা মারছে না!
বিরক্ত হয় বিনোদ। এখানে কেন? মেয়েটার কাছে যা না।
আবার চমকায় বিনোদ।
মেয়েটার কথা মনে পরে। আচ্ছা,মেয়েটা এখন কেমন আছে? কোথায় সে! ধুর, সব তারা সে তো নামিয়ে
নিয়েছে! বউটাও কেমন মিইয়ে গেছে। মনে হয় খিদে মরে গেছে। কি মজা! সব কেমন
নিঃশব্দ। দেয়ালগুলো এখন আরো শক্ত হয়ে গেছে।
কুকুরটা গোঙাচ্ছে। দরজায় আঁচড়াচ্ছে। সবকিছু ছিড়ে ফেলবে
যেন। মাথা দিয়ে ধাক্কা মারছে। দ্রাম! দ্রাম!
মারতে যায় বিনোদ। পারে না। হাঁটুদুটো টনটন করে। চিৎকার
করে ওঠে।
“খিদে,খিদে,খিদে। এত খিদে কেন তোদের? মর!মর! জাহান্নামে যা সব।”
গোঙানি থেমে যায়। কান্না বন্ধ হয়ে যায়। সবাই মনে হয়
ঘুমিয়ে পরে। মেয়েটার মুখটা হারিয়ে যায়। বিনোদ হাত রাখে কাগজের দেওয়ালে। দেওয়ালের ভেতর
থেকে উঁকি মারে একশো, দুশো, পাঁচশো — অনেক টাকা। হাজার
হাজার! লক্ষ লক্ষ! অগুন্তি তারা। দীর্ঘ চাকরী জীবনের সমস্ত সঞ্চয়। তার টাকা। নিজের
টাকা। তার জীবনের সঙ্গী। বড় আপনার। কিছুতেই কাছছাড়া করেনা। বিনোদ টাকা গোনে । গুনে গুনে ক্লান্ত হয় সে। একসময় ঘুমিয়ে পড়ে বিনোদ।
ভাবনাটা বেশ অন্যরকম...
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন