ডাক - সবুজ পরিমল

 


 গোয়াল ঘর থেকে সমানে ডেকে চলেছে মঙ্গলা। সুখময়ের ঘুমটা সেই ডাকেই ভেঙে গেল। সক্কাল সক্কাল মঙ্গলাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। যেতে আসতে অনেকটা পথ। লখাই ঘোষের বাড়ি বাঁশের খুঁটি বেঁধে স্থায়ী বন্দোবস্ত করাই থাকে সারা বছর। হৃষ্টপুষ্ট কালাপাহাড়ের মতো ষাঁড়টা দিয়ে পাল ধরিয়ে ভালোমতোই হাতে আসে। মঙ্গলাকে বেঁধে ফেলা হয় ওই তেকোণা বাঁশের খুঁটির ভেতর। ভালো করে নড়তে চড়তেও পারে না সে। এরপর নিয়ে আসা হয় সেই ভীষণ দেহী ষাঁড়টিকে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কামার্ত করে তোলা হয় তাকে। তারপর লেলিয়ে দেওয়া হয় মঙ্গলার উদ্দেশে। এমন অপ্রকৃতিস্থ নির্মম যৌনতার ঘটনার নিদর্শন যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। মঙ্গলার রুগ্ন শরীরটা ওই পাহাড় প্রমাণ ভারে একটু কেঁপে উঠল। চোখের কোণ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ল বুঝি! পাশে দাঁড়িয়ে সুখময় মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কে জানে এমন নিকৃষ্ট ঘটনার সাক্ষী হতে হয়তো তারও ভীষণ লজ্জা করে। নিজেকে বড় অপরাধী বলে মনে হয়। সারা বছরখান আর ভাবতে হয় না। দুধ বেচে বাপ-বেটির দিব্যি চলে যায়। ঘরের পাশে এক ছটাক জমি আছে বটে তবে চাষবাস বড় একটা হয় না। এই মঙ্গলার উপরই সুখময়ের সংসারটা দাঁড়িয়ে আছে

              দুই বছর হতে চলল গরুটা গর্ভবতী হয়নি। এই রোজগারের জমা টাকা আর থাকেই বা কতটুকু! যেটুকু যা ছিল তা শেষ হয়েই এসেছে প্রায়। দুধও বন্ধ হয়ে গিয়েছে বেশ কয়েকদিন হলো। চাষাবাদ না করে করে ঘরে হাতায় জমিটাও কবেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সুখময় চাষবাস বিশেষ বোঝেও না। খোল, ভুসি, বিচালি কবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মঙ্গলার কপালে এখন শুধুমাত্র ঘাসপাতাটুকু জোটে কোনোরকমে। দিন যেন আর চলে না। ধার করতেও সাহস হয় না। আবার ধার ছাড়া উপায়ও নেই। পাশের বাড়ির রামরতনের কাছে ধার করতে গেলে সেই বললে কথাটা

  - দেখো সুখময় ধার যে নেবে শোধ কিকরে দেবে শুনি! তার চেয়ে একটা কাজ করো না কেন, সামনেই তো বকরিদ ভালো দাম পাবে। রুগ্ন গরুটা বেচে দিয়ে আরেকটা গরু কিনলে তো পারো। ও গরু তোমায় আর খাওয়াবে না। শুধু তোমার ঘাড়ে বসে খাবে

  শুনেই সুখময়ের বুকটা ধড়াস করে উঠল

  - কী বলছেন রতনবাবু! হিন্দু হয়ে আমার মঙ্গলাকে যবনের হাতে তুলে দেবো! তাও জবাই করতে! ধম্মে সইবে?

  - তবে আর কি, না খেয়ে মরোগে যাও। ওই হাড় জিরজিরে গরু বিনি পয়সাতেও কেউ নেবে নে এই বলে রাখলুমবিকৃত মুখে একপ্রকার খেঁদিয়ে দিলো রামরতনবাবু

সুখময় আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ কিছুক্ষণ স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ফেরার পথ ধরে। ধর্ম নাকি পেট কোনটা এখন বাঁচাবে সে! উভয়সঙ্কটে পড়ে যায় সে

দেখতে দেখতে পরব চলে এল। সক্কাল সক্কাল স্নান করিয়ে কোরবানীর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে মঙ্গলাকে। গলায় একটা লাল রঙের প্লাস্টিকের মালা। স্থানীয় মৌলবী তার নিজস্ব কাজ করছে। উদ্যত ছোকরাটা পাশেই অপেক্ষা করছে পরবর্তী সেই কাঙ্খিত নির্দেশের জন্য। তারপর এক-দুই-আড়াই। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। উপস্থিত সকলে আনন্দে হই হই করে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যেই উচ্ছ্বাসটা উশৃঙ্খল ভীতির সঞ্চার করে সকলের মধ্যে। মঙ্গলার পেটের মধ্যে রয়েছে অপরিণত অপুষ্ট একটা ভ্রূণ। নিথর ক্ষুদ্র অপরিণত দেহটা তাজা রক্তে সপসপ করছে। এই গুনাহ-র থেকে নিষ্কৃতির পথ খুঁজতে ব্যস্ত মৌলবী সাহেবের মুখ দিয়ে তাৎক্ষণিক শুধু একটা শব্দই বের হয়

- হায় আল্লা!

      ঘুমটা ভেঙে যায় সুখময়ের। এটা কী দেখল সে! দরদর করে ঘামতে থাকে সে। কলসি কাত করে এক গ্লাস জল একবারে শেষ করে ফেলে। সকাল হতে আরো কিছুটা বাকি। আসন্ন ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে এমনিতেই ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল। কিন্তু এই স্বপ্নটা দেখার পরে সেটার মাত্রা ছাড়িয়েছে। এমন সময় গোয়াল থেকে ডেকে ওঠে মঙ্গলা। এই ডাক সুখময়ের বহুদিনের চেনা। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার...

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন