জানকীর জন্ম হয় ১৮৯৭ সালে কেরালার তেলিচেরিতে। ছয় ভাই পাঁচ বোনের বড় পরিবার ছিল তাঁদের। পিতা দেওয়ান বাহাদুর কক্কট কৃষাণ ছিলেন মাদ্রাজ হাইকোর্টের সাব-জজ। এর সাথেই তিনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং পক্ষীচর্চায় আগ্রহী ছিলেন। মালবার পাখির উপর দু'টি বই লেখেন তিনি। কক্কট কৃষাণ মুক্তমনা মানুষ। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ দিয়ে তিনি তাঁর সন্তানদের প্রভাবিত করেছিলেন। সেই কারণেই হয়তো ছোট থেকে বিজ্ঞানের প্রতি জানকীর বড় বেশি টান ছিল।
জানকীর প্রথম পড়াশোনা থ্যালাসেরির স্যাক্রেড হার্ট কনভেন্টে। তারপরে মাদ্রাজের কুইন মেরি কলেজ, পরবর্তীতে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। স্নাতকের পর কলেজের অধ্যাপকরাই জানকীকে প্রভাবিত করলেন ‘সাইটোজেনেটিক্স’ পড়ার জন্য। কিন্তু তার জন্য তো বিদেশ যেতে হবে! স্কলারশিপ পেলে কাজটা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। চেষ্টা শুরু করে দিলেন বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপের। এর মধ্যেই এলো চাকরির ডাক। মাদ্রাজের উইমেনস ক্রিশ্চিয়ান কলেজে যোগ দিলেন অধ্যাপিকা হিসাবে।
স্কলারশিপের চেষ্টা বৃথা যায়নি। আমেরিকার মিশিগান
বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ মিলল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বার্বোর বৃত্তি নিয়ে
উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন জানকী। ভারতে ফিরে পুনরায় কয়েক
বছর মাদ্রাজের উইমেন ক্রিশ্চিয়ান কলেজের অধ্যাপিকা হিসাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁকে
আবার পাঠানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৩১ সালে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই
উদ্ভিদবিদ্যায় ডক্টরেট সম্পূর্ণ করেন। বোটানিতে পিএইচডি অর্জনকারী তিনিই প্রথম
ভারতীয় মহিলা।
দেশে ফিরে এসে আবার অধ্যপনার জগতে প্রবেশ করলেন, তবে এবার অন্য কলেজে। ত্রিবান্দ্রামের মহারাজা বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপিকার পদে নিযুক্ত হলেন। বছর দুয়েক সেখানেই কাটান। কলেজে পড়াতে বেশ ভালো লাগলেও তাঁর ভাবনা জুড়ে শুধুই গবেষণা, নিত্যনতুন আবিষ্কারের নেশা। ১৯৩৪ সালে কলেজ ছেড়ে কোয়াম্বাটরে আখ উৎপাদন ইনস্টিটিউটে জেনেটিসিস্ট পদে যোগ দিলেন তিনি। আখ চাষের ওপর তাঁর গবেষণা বিশ্ববিখ্যাত। তিনি দেশীয় প্রজাতির আখকে পলিপ্লয়ডির মাধ্যমে এই দেশের আবহাওয়ায় ভালো ফলন দেবে এমন জাতের আখ তৈরি করেন এবং প্রমাণ করেন যে Saccharum spontaneum প্রজাতির আখ আসলে এদেশীয় প্রজাতি।
১৯৩৫ সালে বিজ্ঞানী সি ভি রমন ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম বছর ফেলোশিপ পান জানকী। বেশ কয়েক বছর দেশের মাটিতে কাজ করার পর চলে গেলেন বিদেশে। লন্ডনের রয়্যাল হর্টিকালচার সোসাইটিতে। চলল গবেষণার কাজ। তিনি বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালার ক্রোমোজোম সম্পর্কে বহু গবেষণা করেন এবং সি ডি ডার্লিংটনের সাথে Chromosome Atlas of Cultivated Plants (১৯৪৫) বইটি লেখেন। মূলত কেরালার বর্ষারণ্যের ওপর গবেষণা করলেও পুরো ভারতবর্ষেই ভেষজ ও অর্থকরী উদ্ভিদ সম্পর্কেও তিনি বহুদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা চালিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম দেখান যে উত্তর-পূর্ব ভারতে উত্তর-পশ্চিমের তুলনায় বেশি দ্রুত নতুন প্রজাতি আবির্ভূত হয়। এর কারণ সেখানে পলিপ্লয়ডি বেশি এবং চীনা ও মালয় প্রজাতির উদ্ভিদের সাথে সংকর সৃষ্টি।
স্বাধীনতার পর দেশকে শস্যশ্যামলা রূপে সাজিয়ে ফেলতে নেহেরুর আহ্বান পৌঁছল লন্ডনে গবেষণারত জানকীর কাছে। দেশের উন্নতির ভিত্তি হবে কৃষি। নতুন বীজ চাই। ১৯৫১ সালে জানকী ফিরে এলেন ভারতের মাটিতে। বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া পুনর্গঠন করলেন এবং পরের বছর সংস্থার ডিরেক্টর হলেন। ঘাস, সঙ্কর প্রজাতির বাঁশ নিয়ে তাঁর গবেষণা যুগান্তকারী। সাথেই বাগানের উদ্ভিদের ক্রোমোজোম নিয়ে গবেষণা করেন।
লন্ডনের রয়্যাল হর্টিকালচার সোসাইটিতে নিজের সহকর্মীদের
সাথে, ১৯৪৫ সাল
রয়্যাল হর্টিকালচারল সোসাইটির বাগানে বংশগতিবিজ্ঞানী
হিসাবে কাজ করার সময় জানকী ম্যাগনেলিয়ার মত কিছু গাছের সদ্য অঙ্কুরিত চারায়
কলচিসিন প্রয়োগ করলেন। কয়েকদিন পর দেখলেন চারা গাছের কচি পাতাগুলো যেন তাড়াতাড়ি
বেড়ে গিয়েছে। অন্য গাছের তুলনায় কলচিসিন প্রয়োগ করা গাছগুলো অনেক দ্রুত বৃদ্ধি
পেয়েছে। পাতায় ও ফুলে তফাৎটা চোখে পড়ার মত। নতুন এই ফুলের নাম দেওয়া হয়
ম্যাগনেলিয়া কোবাস।এই ফুল তাজাও থাকে অনেকদিন, বীজের সংখ্যাও বেশি। এই গাছের কিছু বীজ নিয়ে জানকী
একদিন ব্যাটেলস্টোন পাহাড়ে রোপণ করলেন। নতুন ফুলে ভরে উঠল ভ্যালি। তাঁর সম্মানে
ম্যাগনেলিয়ার নাম রাখা হল আম্মাল।
ম্যাগনেলিয়া কোবাস 'আম্মাল'
ভারতের উদ্ভিদবিদ্যা গবেষণায় তাঁর অবদান স্মরণে ২০০০
সালে ভারত সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রক তাঁর নামে ট্যাক্সনমিতে জাতীয় পুরস্কার
ঘোষণা করে। তাঁকে ভারতের আধুনিক বটানির জননী বলা হয়। শ্রমসাধ্য এবং সঠিক
পর্যবেক্ষণ করার দক্ষতায় অন্যতম এবং গবেষণাকর্মে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় নিবেদিত
বৈজ্ঞানিক কর্মীদের আদর্শ জানকী আম্মালের প্রতি রইল সশ্রদ্ধ প্রণাম।
১৯৪৯ সালের ন্যাশনাল সায়েন্স কংগ্রেসের উদ্বোধনে, সঙ্গে
নেহেরু এবং ডঃ রাধাকৃষ্ণণ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন