অলৌকিকতার অকালমৃত্যু এবং 'ঔল' - ডঃ দীপ সরকার

 


গল্প - ঔল
লেখক - ত্রিজিত কর 

মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হলে অলৌকিক সাহিত্য উপভোগ করতে পারে না এই অভিযোগ বা যুক্তিকে আমি গ্রাহ্য বলে মনে করি না। যারা এই ঘরানার সাহিত্য প্রকৃতই ভালবাসেন তাঁরা নিজেদের অবিশ্বাসকে কখনই সাহিত্যের রসাস্বাদনে বাধার কারণ হতে দেন না। কিন্তু গল্প উপভোগ করার শত চেষ্টা সত্ত্বেও যখন পাঠকের যুক্তিবোধ তাঁর মনে বিদ্রোহ জানাতে থাকে তখন সাহিত্যের গুণমান নিয়ে মনে প্রশ্ন ওঠে। সন্দেহ জাগে যে আদতে কোন pulp horror পড়ছি কিনা। ত্রিজিৎ করের “ঔল” সম্পর্কে আমার অনুভূতি কতকটা এইরকম |

 ঔল”এর শুরুটা বেশ জমজমাটি, ঠিক যেমনটা কোন অলৌকিক সাহিত্যের ভক্ত একটা দুর্দান্ত ভয়ের গল্পের কাছ থেকে আশা করে। গল্পের প্রেক্ষাপটও মানানসইহত যদি লেখক একটা অকাল্ট হরর উপন্যাস দাঁড় করানোয় মন দিতেন। কিন্তু শেষ অবধি কী যে দাঁড় করালেন তা হয়তো তিনিই ভাল বলতে পারবেন। বাঁকুড়ার উলুমারি গ্রামে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লোক এল বহু প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে খননকার্য চালাতে, পরে জানা গেল এই নিদর্শন হল “বহু মূল্যবান প্রস্তর মূর্তি” কিন্তু কার প্রস্তরমূর্তি, কত পুরোনো তা একবারের জন্যও স্পষ্ট করে বলা হল না। ঔলের কঙ্কাল আবিষ্কার ও তার অনতিপরে ঔলের উপদ্রব আরম্ভ হওয়াতে সেই প্রসঙ্গ একেবারেই ধামাচাপা পড়ে গেল। প্রস্তরমূর্তিও আর কিছুই পাওয়া হল না।

 গল্পের শুরুতে গল্পের কথক সঞ্জয় বলেছিল অনন্ত সান্যালের প্রত্নতত্ত্বে অগাধ জ্ঞান কিন্তু তাঁর কোন কথাতেই সেই জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া গেল না। প্রস্তরমূর্তির ব্যাপারে যেটুকু বললেন তা জল্পনামাত্র, সেইসাথে দেখা গেল যে জায়গায় খননকার্য তদারকি করতে আসা, সেই উলুমারির ইতিহাস বা লৌকিক আচার-প্রথার ব্যাপারেও কিছুই জানেন না। যে তালপাতার পুঁথিতে ঔলদের ইতিহাস পাওয়া গেল সেটার ব্যাপারে কেবল “এ তো বহু প্রাচীন পুঁথি” এইটুকুমাত্র মূল্যায়ণ করতে পারলেন! একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ হয়েও ওনার কথায় এমন কিছুই পেলাম না যা শুনে তাকে প্রত্নতত্ত্ববিদ বলে মনে হতে পারে।

 ঔলদের ইতিহাসের ব্যাপারটা আরই বিসদৃশ। একদিকে গল্পের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র জাহ্নুবী বলল, “ঔল যে আসলে কী তা আমরাও সঠিক জানি না”; তার অনতিপরেই আবার বলল দেবী সহস্রফণার এক মেয়ে নিজের হতেই তালপাতার পুঁথিতে ঔলদের ইতিহাস লিখেছিল। গল্পের শেষে দেখা গেল এই জাহ্নুবীই সেই তিন মেয়ের একজন, যে মানুষরূপে জন্মেছিল (বাকী দুই মেয়ে সাপ ও ঔলরূপে জন্মায়)। অতএব এটাই স্বাভাবিকভাবে অনুমেয় যে পুঁথিটা জাহ্নবীই লিখেছিল। অথচ সেই জাহ্নুবীই বলল ঔল কী আমরাও জানি না! হতে পারে পুঁথিতে লেখা কাহিনীর সমস্তটাই মনগড়া! এগুলো কি কেবল সঞ্জয় ও অনন্ত সান্যালকে ধন্দে রাখবার জন্য? কিন্তু সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন ওঠে যে এমন কথা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? তবে তাঁদের পুঁথির কথা বলারই বা কি দরকার ছিল? আবার যদি পুঁথির লোভ দেখিয়ে সর্বনাশের পথে ঠেলে দেওয়াই জাহ্নুবীর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে পুঁথির গল্পের সত্যতা নিয়ে অহেতুক বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস কীসের জন্য?

 আর গল্পের শেষাংশটুকু নিয়ে যত কম বলা যায় ততোই হয়তো ভাল। তবে পর্যালোচনা যখন লিখতে বসেছি তখন একেবারে উপেক্ষিত রাখারও উপায় নেই কারণ শেষটা ভাল হলে উপরোক্ত যা কিছু ত্রুটি ক্ষমা করে দেওয়া যেত। কিন্তু তার পরিবর্তে পেলাম আরও কিছুটা বিভ্রান্তি। উলুমারি গ্রাম ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগের রাতে যেসব সাদা বকের পালের আগমন হল, যারা আবার জাদুবলে রূপান্তরিত হয়ে গেল মানুষের মত দেখতে প্রাণীতে, তাঁরা কারা? ফগিথিলিস কে? প্যারাফার্তই বা কী? যেটুকু বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা শুনে যদিও মোটামুটি একটা আন্দাজ করা যায় যে ফগিথিলিস এই বকমানুষদের কোন আরাধ্য দেবতা আর প্যারাফার্ত “প্যারাডাইস”এর মত কিছু, প্রশ্ন হল উপন্যাসের শেষে গিয়ে হঠাৎ এইসবের অবতারণা কেন? জাহ্নুবী বা ফুলি কি তবে এই বকমানুষদের মতোই কোন ভিনগ্রহের প্রাণী? তা নাহলে সে ওদের ভাষায় উত্তর দিল কি করে?

 যেটা আরও বোঝা গেল না তা হল যে উলুমারি গাঁয়ের লোকজন ঔলের নাম পর্যন্ত নিতে ভয় পায় তাঁরা ফুলির সন্তান ঔল এই কারণে তাকে হত্যা করল, তাও ফুলির সামনে! এটাও লেখক পাঠককে বিশ্বাস করতে বললেন? কারণ মানুষ নিকৃষ্ট, পাপী, দুনিয়ার অভিশাপ, এই জন্য? মনুষ্যত্ব কাদের আছে তাহলে? ওই বকমানুষ আর ঔলদের, যারা বিদায় নেওয়ার আগে নৃশংস হত্যালীলায় মেতে উঠে একটা গোটা গ্রাম ছারখার করে দিল? হয়তো এটা সম্পূর্ণই আমার মতামত, কিন্তু প্রতিশোধের জন্য হত্যাও কিন্তু হত্যাই। আর যে হত্যা করে, সে খুনী। আর যে খুনী, তাঁর মনুষ্যত্ব কিছু যদিবা থেকেও থাকে তা প্রতিহিংসার কাছে পরাজিত।

 যাই হোক, লেখক যে গল্পের পিছনে খুব বেশি খাটেননি সেটা বললে নেহাত ভুল হয়তো বলা হবে না। পড়াশোনা বা গবেষণার ধার যে বিশেষ ধারেননি সেটা চরিত্রদের বাক্যালাপের মধ্যেই স্পষ্ট। শুধু গল্পের শেষটা পড়ে একটা আশঙ্কা রয়ে গেল মনে-এই গল্পের আবার দ্বিতীয় খন্ড লেখার পরিকল্পনা করেননি তো লেখক? তাহলেই চিত্তির! “ঔল” পড়ে ভয় পাওয়ার মতো যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা এটাই।




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন