পরিচালক – নিতিলন স্বামীনাথন
শ্রেষ্ঠাংশে – বিজয় সেতুপতি, অনুরাগ কাশ্যপ, মমতা মোহনদাস, নটরাজন
সুব্রহহ্মণ্যম, অভিরামী, দিব্যা ভারতী, সিঙ্গমপুলি, অরুলদস, মুনিশকান্ত, সাচনা নামিদাস, বিনোদ সাগর.
ভালো ছবি কোনটা সেটা যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি, সেদিন থেকেই বিজয় সেতুপতির ছবি দেখাতে ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। আজ দেখলাম তাঁর অভিনীত ছবি 'মহারাজা'। সত্যি মহারাজাই বটে। তাঁর উদারতা, ভালোবাসা, ক্রোধ - আবার একইসাথে অন্যায় দেখলে প্রকৃত মহারাজার মতো সেই অন্যায়ের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করা, এইসব গুণই বর্তমান আমাদের মহারাজের মধ্যে। তাই চরিত্রের নাম যে স্বার্থকতা পেয়েছে তা অনায়াসেই বলা যায়।
যদিও ছবিটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি, ১৮৬২ সালে 'করসনদাস মুজ্লি' ও 'মহারাজ যদুনাথ জি' নামক দুই মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে নিয়ে নিথিলন স্বামীনাথান চিত্রনাট্য লেখেন ও ছবিটির নির্দেশনা করেন।
ছবিটির শুরুতে মনে হতে পারে এক সামান্য নাপিত তার বাড়ির ডাস্টবিন (লক্ষ্মী) চুরি হওয়া নিয়ে এতো চিন্তিত কেন? ওটাকে লক্ষ্মীই বা বলে কেন? কি আছে এমন ওতে? যা নিয়ে এক সামান্য নাপিত পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছে এবং নিজেকে সবার সামনে হাসির খোরাক করে তুলছে? এমনকি সে ওই পুরোনো একটা ডাস্টবিন ফেরত পাওয়ার বিনিময়ে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা দিতেও পিছুপা হচ্ছে না। জানা যায় যে, সেই নাপিতের পরিচয় শুধু নাপিত নয়, সে একজন বাবা, এক কন্যা সন্তানের বাবা আর সেই বাবার গোটা পৃথিবী জুড়েই তার মেয়ে।
পুরো ছবিতে ঘটনা গুলো এমনভাবে সাজানো যে জট খুলতে ও রহস্যভেদ করতে শেষ পর্যন্ত দেখতেই হবে। মাঝে মাঝে চিন্তাতেও পড়তে হবে যে কি হচ্ছে আসলে! কিন্তু, সেই কথা মাথায় রেখে লেখক ও নির্দেশক নিথিলন স্বামীনাথান হাস্যরসেরও ব্যবহার করেছেন যথেষ্ট পরিমাণে, যা দর্শককে ছবির সাথে জুড়ে রাখবে।
বিজয় সেতুপতি (মহারাজ) এই ছবিতে বাবার ভূমিকায় আছেন এবং প্রমাণ করে দিয়েছেন যে এক বাবা তাঁর সন্তানের জন্য কতদূর যেতে পারে। রক্ষকই যখন ভক্ষক (কিছু) হয়, তখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে হিংস্র প্রাণী হয়ে ওঠা, এক নিমেষে ভালোবাসায় দুর্বল ও একইসাথে পাথর হয়ে হয়ে যাওয়া খুব কঠিন হয় না। রক্তের সম্পর্ককে মাপকাঠি বানিয়ে তা দিয়ে যে পিতার স্নেহকে মাপা যায় না, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সিনেমার শেষ ৫ মিনিট সমস্ত হিসেব নিকেশ ওলোটপালোট করে দেয়। ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা ছবি হিসাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই ছবি, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্যই আমার দেখা সেরা ছবি “মহারাজা”। সিনেমাটা দেখার পর থেকেই কেমন জানি লাগছে, ভাষায় বর্ণনা করতে পারবো না। শেষ দৃশ্যে আম্মুর পায়ের ছাপের ওই রক্তস্নান দৃশ্যটা এখনো কিছুক্ষণ পরপর চোখে ভেসে উঠছে। নির্দেশক ও অভিনেতা সকলেই পুরো ছবিতে দর্শকদের মন -মস্তিষ্ক- আবেগ- চেতনা -মমত্ব - ক্রোধ প্রতিটি অনুভূতি নিয়ে যেন খেলা করেছেন। বিজয় সেতুপতির অভিনয় নিয়ে লেখার ধৃষ্টতা আমার নেই। উনি অভিনেতা নন, নিজেই গোটা চলচ্চিত্র জগৎ। তাঁর সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন অনুরাগ কাশ্যপ। পরিচালক হিসেবে আমি এনার অন্ধ ভক্ত তো বটেই কিন্তু আজ থেকে অভিনয়েরও ভক্ত হয়ে গেলাম।
ক্লাইম্যাক্স দেখে আমি বাকরুদ্ধ। মানুষের বিবেক দংশন বড়োই সাংঘাতিক ব্যাপার। মানুষকে এক নিমেষে শেষ করে দিতে ও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই বিবেক দংশন। সামাজিক জটিলতা, বাবা ও মেয়ের সম্পর্ক ও মানবিক খলতার এক সুন্দর মিশ্রণে 'মহারাজা' তৈরি হয়েছে, যা ভাবাতে বাধ্য করে স্বার্থপরতা কি, কেন গড়ে ওঠে ও তার জন্য দায়ী কারা? ভুল বোঝাবুঝি কতটা মারাত্মক ভূমিকা পালন করে মানুষের জীবনে তা মহারাজা বুঝিয়েছে। মনে থেকে যাবে ছবিটা, কথা দিলাম।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন