ইলশেগুঁড়ি! ইলশেগুঁড়ি! ইলিশ মাছের … - বাণী মিত্র


শাস্ত্রে আছে –

'ইল্লিশো মধুর/ স্নিগ্ধো রোচনো/ বহ্নিবর্জনঃ
পিত্তিকৃৎ কফকৃৎ/ কিঞ্চিল্লঘু ধর্মোহ নিলাজহঃ।'

অর্থাৎ, ইলিশ মাছ হলো মধুর, স্নিগ্ধ রোচক ও বলবর্ধক, পিত্তকারী, কিঞ্চিৎ কফকারী, লঘু পুষ্টিকর ও বাতনাশক। মাছে ভাতে বাঙালির পরম উপাদেয় পদের তালিকায় প্রথমেই নাম আসে ইলিশ মাছের। রৌপ্যজ্জ্বল এই মাছের চাহিদা বঙ্গজীবনের সোনার থেকে কিছু কম নয়। উৎসবে অনুষ্ঠানে আনন্দের যে কোনও পরিবেশে ইলিশ মাছের পদ পরিবেশন করা বাঙালি মাত্রেই গর্বের বিষয় হয়ে যায়। বাংলার বিভিন্ন কাব্য – পদ – পুরাণে ইলিশ মাছের কথা ঘুরে ফিরেই আসে। তার সে লোকাচারই হোক বা অতিথি আপ্যায়ন প্রসঙ্গে কোনও বিখ্যাত ঘটনাই হোক। বাঙালি, বিশেষ করে বাঙাল বাড়িতে ইলিশের সমাদর প্রায় দেবদেবীর পর্যায়ে করা হয়।

ইলিশ মাছ দিয়ে রান্নার ক্ষেত্রে প্রচলিত সর্ষে ভাপা বা কালো জিরের পাতলা ঝোল ছাড়াও আরও বহুবিধ পদের গন্ধ বাংলার ঘরের কোণে একটু উঁকি মারলেই পাওয়া যায়। নারায়ণ দেব ও জানকীনাথের ‘পদ্মপুরাণ’-এ ইলিশের একটি পদ পাওয়া যায়। কবিরা জানাচ্ছেন, তারকা তার নন্দাই লখিন্দরের জন্য সরষেশাক দিয়ে ইলিশের মাথা রান্না করেছিলেন।মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলোতে এই রকম আরও বহু চমকপ্রদ ইলিশের পদের খোঁজ পাওয়া যায় । সাথে পাওয়া যায় মন ভরানো নেপথ্য কাহিনী।

বর্ষার আগমনে ছোটবেলায় শিশুপাঠে পাঠ্য একটা ছড়া আমরা খুব বলতাম -

"ইলশেগুঁড়ি! ইলশেগুঁড়ি!
ইলিশ মাছের ডিম,
ইলশেগুঁড়ি! ইলশেগুঁড়ি
দিনের বেলায় হিম ।।"

গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে লাগলেই আনন্দের সাথে এই ছড়া বলা সম্ভবত প্রত্যেক বাঙালি শিশুই বলে এসেছে কতকাল ধরে। হিরের কুচির মত গুঁড়ো গুঁড়ো বর্ষার জল গায়ে লাগলে নাকি ইলিশ মাছ ডিম পারতে শুরু করে। ইলিশের ডিম পারার সাথে শিশু জীবনের সরাসরি কোনও যোগাযোগ না থাকলেও, সম্ভবত ডিম ভরা ইলিশ খেতে পাওয়ার আনন্দে বাড়ির বড়দের সাথে সাথে শিশুমনও দুলে উঠত।

খুব ছোট বেলায় মনে পড়ে আমাদের বাড়িতে সরস্বতী পূজার দিন সকালে জোড়া ইলিশের আগমন ঘটত। তাকে নির্দিষ্ট উপাচারে পূজা করে ঠাকুমা আঁশবটি পেতে উঠোনে ইলিশ কাটতে বসতেন। মাছের রূপালি আঁশ সমস্ত কেটে নিয়ে একটি ছোট মাটির পাত্রে সংগ্রহ করে বাগানের এক প্রান্তে মাটি খুঁড়ে সেই আঁশসহ বাটি পুঁতে দিতেন। বাড়ির কোনও শিশুকে দিয়ে প্রশ্ন করানো হত, ‘ ও ঠাকুমা তুমি কি করছ?’ ঠাকুমা সহাস্যে উত্তর দিতেন, ‘ অমুকের বিয়ের টাকা জোগাড় করছি’, কিংবা ‘অমুকের পড়ার টাকা জমাচ্ছি।‘ অর্থাৎ সেই মুহূর্তের আসন্ন কোনও বড় খরচের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিশ্বাস করা হত সেই আঁশ ক্রমে রুপোর টাকায় পরিণত হবে। এরপর ইলিশ মাছ দুটিকে কুমড়ো শাক ও অল্প সব্জি সহ শুধু মাত্র নুন, হলুদ ও কাঁচা লঙ্কা সহযোগে রান্না করে পরিবেশন করা হত।

এই প্রকার উপাচার বাংলার বহু পরিবারেই প্রচলিত ছিল। যেমন ভাগ্যকুলের জমিদার বাড়ির সদস্যরা আজও শারদীয়ায় ইলিশ-পরম্পরা রক্ষা করে চলেছেন। ভাগ্যকুলের রায়েরা এখনো পুজোর দিনগুলোতে ইলিশ খেয়েই কাটান বলে জানা যায়। তাদের ইলিশের নানা মেনুর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, ইলিশের ডিমের ভাপা। পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচ দিয়ে মাখো মাখো ইলিশের ডিমভর্তা।

কথিত আছে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ইলিশকে মহিমান্বিত করে রেখে গেছেন এক অনন্য পদ সৃষ্টির অনুঘটক হয়ে। নবাব একবার হুকুম করলেন তিনি ইলিশও খাবেন আবার পোলাও। কিন্তু সেটা একসঙ্গে হতে হবে। তাঁর হেঁশেলে বাবুর্চিরা সব পূর্ব বাংলার। ফরমাশ পেয়ে তাঁরা নবাবের জন্য ইলিশ ও সুগন্ধী চালের সমন্বয়ে তৈরি করলেন এক অভিনব পদের। আবিষ্কার হল ইলিশ পোলাওয়ের। যার নাম হল 'মাহি পোলাও'। মুর্শিদাবাদে এই পদ এখনও অত্যন্ত জনপ্রিয় ও প্রচলিত।

বর্তমানযুগে বিভিন্ন সামগ্রীর প্রচারে বস্তুটির অপরিসীম গুরুত্ব বোঝাতে নানাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে ইলিশ মাছ। ইলিশের কথা এলে সবার আগে মনে পড়ে একটি বিজ্ঞাপন। একসময় জনপ্রিয় হয়েছিল 'মাছের রাজা ইলিশ। আর বাতির রাজা ফিলিপস।'

মাত্র কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের একটি বিজ্ঞাপন ছিল 'দু হাজার টাকার ওপরে সোনার জিনিস কিনলে একটি ইলিশ মাছ ফ্রি।'

বঙ্গজীবনে লোককথা অনুযায়ী ইলিশ মাছের ৫০ প্রকারের পদ পাওয়া যায়। বিদেশেও কিছু কিছু স্থানে ইলিশ মাছ খাওয়ার প্রচলন জানতে পারা যায়। বলা হয় ইলিশ মাছের কোনও অংশই নাকি ফেলে দেওয়া যায় না। সবই খাওয়ার যোগ্য। কিছু কিছু জায়গায় ইলিশ মাছের আঁশ ভেজে খাওয়ার , ইলিশ মাছের পেটের তেলসহ অন্যান্য প্রত্যঙ্গ দিয়ে তরকারি তৈরি করে খাওয়ার কথা শোনা যায়। এমন কি ইলিশ মাছের লেজও ভেজে বা তরকারি সহযোগে রান্না করে খাওয়া হয় বলে শোনা যায়।

আজ প্রচলিত কিছু রান্না বাদ দিয়ে একটু পৃথক ধরণের ইলিশের পদ দিলাম।

ইলিশ কাবাবঃ


উপকরণঃ

১. গোটা ইলিশ – ১ টি
২. আদা বাটা ১/২ চা চামচ,
৩. রসুন বাটা – ১/২ চা চামচ,
৪. পুদিনা পাতা বাটা - ১ চা চামচ,
৫. সাদা সরষে বাটা – ১/২ চা চামচ,
৬. টকদই – ১০০ গ্রাম,
৭. পেঁপে বাটা - ১ টেবিল চামচ,
৮. লঙ্কা গুঁড়ো - ১ টেবিল চামচ।
৯. পেঁয়াজ বাটা – ১/২ কাপ,
১০. গরমমশলা বাটা - ১ টেবিল চামচ,
১১. সর্ষে তেল - পরিমাণমতো,
১২. কাঠকয়লা - পরিমাণমত,

প্রণালীঃ

  • প্রথমে মাছের আঁশ ছাড়িয়ে তারপর মাছের পেটের দিকটা চিরে ভেতর থেকে সব নোংরা বের করে ভালো করে মাছ ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখতে হবে। মাছের গা ছুরি দিয়ে হালকা করে চিরে দিতে হবে।
  • মাছের সাথে বাটা ও গুঁড়া মশলা, লবণ, তেল এবং টকদই ভালো করে মাখিয়ে প্রায় ২-৩ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে।
  • মশলা মাখানো মাছটিকে একটি কাবাব বানানোর বারবিকিউ ওভেনে কাঠকয়লা জ্বালিয়ে অল্প আগুনে ওপরে একটি জালি ট্রেতে মাছ রেখে পোড়াতে দিতে হবে।
  • দু’ মিনিট পরপর মাছে সর্ষে তেল ব্রাশ করে মাছ এপিঠ ওপিঠ করে ঝলসিয়ে নিলে তৈরি হবে ইলিশ কাবাব।

কাঁচকলা দিয়ে ইলিশঃ




উপকরণঃ

১. কাঁচাকলা - ৫০০ গ্রাম,
২. ইলিশ মাছ – ৫০০ গ্রাম ( টুকরো করে কাটা),
৩. পেঁয়াজ কুচি- ২ টেবিল চামচ,
৪. কাঁচালঙ্কা ফালি - ৫/৬ টি,
৫. সর্ষে তেল - ২ টেবিল চামচ,
৬. হলুদ গুঁড়ো - ১ চাচামচ,
৭. নুন - পরিমান মত


প্রণালীঃ
  • প্রথমে কলার খোসা ছাড়িয়ে টুকরো করে কেটে নিতে হবে। হলুদ নুন মাখিয়ে ভালো করে ভেজে তুলে রাখতে হবে।
  • মাছ ধুয়ে পরিষ্কার করে নুন ও হলুদ মাখিয়ে মাছগুলোকে হালকা করে ভেজে তুলে রাখতে হবে।
  • কড়াইতে তেল গরম করে পেঁয়াজ ও কাঁচালঙ্কা ফালি দিয়ে সামান্য নেড়ে নিতে হবে। তারপর কলা দিয়ে দিতে হবে।
  • পরিমাণ মত নুন ও হলুদ দিয়ে অল্প করে জল মিশিয়ে কয়েক মিনিট ঢেকে রান্না করতে হবে।
  • জল শুকিয়ে কলা সেদ্ধ হয়ে মাখা মাখা হলে মাছ মিশিয়ে নামিয়ে নিতে হবে।

মালাবার ইলিশঃ



উপকরণঃ

১. ইলিশ মাছ – ৫০০ গ্রাম (টুকরো করে কাটা)
২. পেঁয়াজ কুচি – ৫০ গ্রাম
৩. রসুন কুচি – ১ চামচ
৪. আদা কুচি – ১ চামচ
৫. জিরে গুঁড়ো – ১ চামচ
৬. ধনে গুঁড়ো - ১ চামচ
৭. নুন ও হলুদ গুঁড়ো – পরিমাণ মত
৮. লাল লঙ্কা গুঁড়ো – ১/২ চামচ
৯. গরম মসলা গুঁড়ো – ১/২ চামচ
১০. নুন – পরিমাণ মত
১১. তেঁতুল – ১/৪ কাপ জলে ভিজিয়ে ক্বাথ তৈরি করা
১২. নারকেল দুধ – ১০০ মিলি
১৩. তেঁতুলের পেস্ট ১ চামচ (ঐচ্ছিক)

প্রণালীঃ
  • একটি মাটির হাঁড়িতে তেল গরম হলে পেঁয়াজ সোনালি বাদামী হওয়া পর্যন্ত ভাজতে হবে।
  • আদা, রসুন, জিরা, ধনে, হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো এবং গরম মসলা যোগ করে দু’ মিনিট রান্না করতে হবে।
  • ইলিশের টুকরো নুন হলুদ মাখিয়ে আলাদা করে রাখতে হবে।
  • ভেজানো তেঁতুলের ক্বাথ, তেঁতুলের পেস্ট (যদি ব্যবহার করা হয়), নুন এবং ১ কাপ উষ্ণ জল যোগ করতে হবে। ফোটাতে হবে।
  • আঁচ কমিয়ে ১০ মিনিট ঝোল ঘন হওয়া পর্যন্ত ফোটাতে হবে। ঝোল ঘন হয়ে গেলে নারকেল দুধ মিশিয়ে অল্প নেড়ে ইলিশ মাছের টুকরো দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে।
  • ৫ মিনিট রান্না হওয়ার পর আঁচ বন্ধ করে ধনেপাতা দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করতে হবে।





Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন