নাথপুর।
নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের ২৩ কিলোমিটার পশ্চিমে একটি ছোট্ট পল্লীগ্রাম। এই নাথপুরের বিশ্বাস
বংশের নদীয়া অঞ্চলে বিশেষ খ্যাতি ছিল। না,
রাজা-উজীর, জমিদার বা প্রভূত ধনাধিপতি তাঁরা ছিলেন না, তাঁদের খ্যাতি ছিল শিক্ষাদীক্ষা,
ভদ্রোচিত আচার ব্যবহার ও দয়া-দাক্ষিণ্যাদি সদ্গুণের সমাবেশে। বিশ্বাসরা পুত্রপৌত্রাদিক্রমে
পরম বৈষ্ণব; গোরাচাঁদের প্রেমলহরীতে যখন “শান্তিপুর ডূবু ডূবু নদে ভেসে যায়”, তখন থেকেই
তাঁরা শ্রীগৌরাঙ্গের উপাসক। এই সম্ভ্রান্ত বিশ্বাস বংশেরই সন্তান গিরিশচন্দ্র বিশ্বাস।
কলকাতার সার্ভেয়ার জেনারেলের অফিসে সামান্য বেতনের চাকরী করতেন তিনি। গিরিশচন্দ্র কর্মসূত্রে
কলকাতাতেই থাকতেন।
সালটা
১৮৬১। ঊনবিংশ শতকের বাংলা তখন নবজাগরণের
সূচনা ঘটাতে ব্যস্ত; বাংলার শিক্ষা,
চেতনা, ধ্যান ধারণা আপামর ভারতবর্ষকে উজ্জীবিত করছে, তাঁকে নবযুগের দিকে এগিয়ে নিয়ে
যাচ্ছে। এমনই
এক সময়, যখন কলকাতার জোড়াসাঁকোতে
জন্ম নিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
ঠিক সেই সময়ই নাথপুরের
অজপাড়াগাঁয়ে গিরিশজায়ার কোল আলো করে ভুমিষ্ঠ হল এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ,
গিরিশচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র সুরেশচন্দ্র। গিরিশচন্দ্র নিজে
ছিলেন ছাপোষা চাকুরে, কিন্তু সুরেশ যেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া।
প্রাজ্ঞজনেরা
বলে থাকেন, শিশু ভবিষ্যতে বড়ো হয়ে কেমন
মানুষ হবে, তাঁর আভাস শৈশবেই পাওয়া যায়।
কিছু মানুষকে লক্ষ্যে করলে বোঝা যেয়,
তাঁরা যেন নেতৃত্ব দিতেই জন্মগ্রহণ করেছেন, অন্যের আজ্ঞাবহ হওয়া তাঁদের ধাতে নেই। সুরেশচন্দ্রের জীবনেও তা সুস্পষ্ট ভাবে প্রতিভাত। শুরু থেকেই দুরন্ত-দস্যিপনা ছিলো সুরেশের রক্তে। চূড়ান্ত
অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় সুরেশের দৌরাত্ম্যে গ্রামের প্রায় প্রতিটি সাধারণ মানুষ
অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। তবে এই সব দস্যিপনার মধ্যেও শিশু সুরেশের
যে বিশেষত্বগুলো নজর কাড়ে তা হল তাঁর নির্ভীকতা এবং অপুর্ব সহনশীলতা। তাঁর শৈশবের একটি
বিশেষ ঘটনাতে সুরেশের এই সহ্যশক্তির পরিচয় মেলে।
ছোট্ট
সুরেশের আগুনের প্রতি এক অদ্ভুত টান ছিল। প্রদীপের শিখা বা উনুনের আঁচ দেখলেই হামাগুড়ি
দিয়ে ছোট্ট সুরেশ তা ধরতে ছুটতো। সুরেশচন্দ্রের মা সদাই শঙ্কিত যে, খেয়ালের বশে এই
অবোধ, অবাধ্য শিশু আগুন নিয়ে কোনো দুর্ঘটনা না বাধায়। মা শেষে ভাবলেন, আগুনের তাপ হাতে
লাগলেই হয়তো ছেলের মনে ভয় জন্মাবে ফলে সুরেশের আগুনের প্রতি এই ‘অবাঞ্ছিত টান’ হয়তো
কমতে পারে। মাটির ঘরের এক কোনে একটি ছোট প্রদীপ জ্বলছিল। সুরেশ কে কোলে নিয়ে মা সেই
প্রদীপের কাছে গিয়ে তাঁকে নানা ভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলেন। হঠাৎ, সুরেশ মায়ের কোল
থেকেই নির্ভয়ে তাঁর কচি হাত দুটি বাড়িয়ে প্রদীপের শিখা ‘করায়ত্ত’ করতে গেলেন, এবং দুর্ভাগ্যবশত,
সফলও হলেন। হাতে বিলক্ষণ ছ্যাঁকা লাগল। কিন্তু ছোট্ট সুরেশ কাঁদলেন না, তাঁর চোখে বিন্দুমাত্র
অশ্রু দেখা গেলনা। মা হয়তো ভেবেছিলেন সামান্য ছ্যাঁকা খেয়েই সুরেশ হাত সরিয়ে নেবে।
বালকের চোখে মুখে যন্ত্রনার কোনোরূপ চিহ্ন দেখা গেলনা। কাতরতার পরিবর্তে কেবল এক অপুর্ব
নীরবতা, কিন্তু মার প্রাণ তখন কত কেঁদেছিল, কে জানে। যাই হোক, সন্তানের এমন সহ্যগুণ
দেখে সেই দিন থেকেই তাঁকে শাষনের সংকল্প ত্যাগ করলেন। ভবিষ্যতে ভীষণ অগ্নিময় সমরক্ষেত্রে
সুরেশচন্দ্র যে নির্ভয়ে অগ্নিক্রীড়া করবেন, এই সামান্য ঘটনা হয়তো তাঁরই ইঙ্গিত দিয়ে
গেল।
সুরেশচন্দ্রের
বয়স যখন দুই বছর মাত্র, তখন থেকেই তাঁর নির্ভীকতা ও দুঃসাহসের অদ্ভুত পরিচয় পাওয়া যায়। দুই বছরের শিশু একাকী খেলা করছে, হঠাৎ পাঁচিলের গায়ে সাঁটানো ২০ ফুট উঁচু একটি মইয়ের দিকে সুরেশের চোখ পড়ল এবং দেখা মাত্রই সেই মইয়ের সদব্যবহারও
করা হল। সুরেশ মই বেয়ে উঁচুতে উঠল এবং অনাবিল আনন্দে সেই
করতালি দিতে থাকে; সঙ্গে অর্থহীন
আনন্দ সঙ্গীত। এদিকে সুরেশের কাণ্ড
দেখে সকলের চক্ষুস্থির। একটু
অসাবধান হলেই ভগবান যে কি দুর্ঘটনেই
ঘটাবেন, সকলে সেই আশংকায় ভীত। এদিকে আত্মীয় স্বজনের কোলাহল দেখে সুরেশের আনন্দ বাড়ল বই কমল না। সকলেই ইষ্টনাম
জপ করছে — এই বুঝি বিপদ ঘটে! মই বেয়ে
কেউ একজন উঠে যে সুরেশকে নামিয়ে আনবে তাও খুব বিপজ্জনক। যদি মই নড়ে গিয়ে সুরেশ নীচে
পরে যায়! কিম্বা কাউকে উঠতে দেখলে অবোধ বালক কৌতুকছলে নিজেই যে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পরবেনা,
সেটাই বা কে বলতে পারে। সুরেশজননী সন্তানকে যতই স্থির হয়ে বসতে বলছেন, সুবোধ শিশুর সঙ্গীতভঙ্গী ও চীৎকার যেনও ততই বাড়ছে। ভয় দেখানো বা বকুনি দেওয়া বৃথা বুঝতে পেরে তখন তিনি
স্নেহকাতরবাক্যে সুরেশকে ক্ষণেকের জন্য শান্ত হতে অনুনয় করতে লাগলেন। অবশেষে ক্লান্তিবশেই হোক অথবা মায়ের কাতরবাক্যেই হোক, সুরেশ স্থির হয়ে বসল এবং একজন ধীরে ধীরে মইয়ে উঠে সুরেশকে নামিয়ে মায়ের কোলে চালান করে দিল। মার প্রাণের ব্যাকুলতা কেই বা বর্ণনা করবে, বিশেষতঃ সুরেশের ন্যায় ‘শান্তশিষ্ট’ শিশুর জননীর
সদাই ভাবনা, খেলার ছলে ছেলে কখন কি সর্বনাশ করে।
[৩]
সুরেশের
যখন ছয় বছর বয়স, তখন গিরিশচন্দ্র কলকাতার বালিগঞ্জে একটি বাড়ি ক্রয় করেন। অনতিবিলম্বে,
তিনি নাথপুরের পাট চুকিয়ে সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন। সুরেশ এবার ভর্তি হয় কলকাতার
স্কুলে, ভবানীপুরের লন্ডন মিশন স্কুলে। কিন্তু পড়াশোনায় মন
থাকলে তো! রামায়ণ-মহাভারত আর ইতিহাসের দিগ্বিজয়ী বীরদের গল্পেই যেন তার সবটুকু
আগ্রহ। শুধু গল্প শোনেই নয়, অর্জুনের বীরত্ব, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা, রামচন্দ্রের রাবণবধ – এগুলি যেন বালক সুরেশের মর্মে মর্মে গাঁথা। আলেকজাণ্ডারের দিগ্বিজয়, লিওনেইডাসের
স্বদেশ রক্ষা, সিজার ও হানিবলের
বীরবিক্রম, আলফ্রেড ও হেরাল্ড, ব্রুস ও ওয়ালেস, নেপোলিয়ন অথবা ওয়াশিংটনের
শৌর্য্যবীর্যের গল্পে রোমাঞ্চ হত ছোট্ট সুরেশের। কলকাতায় সমবয়সী বন্ধুবান্ দলে সুরেশই ছিল ‘সর্দার’।
বয়স
বাড়ছিল এবং সেই সঙ্গে বাড়ছিল সুরেশের চঞ্চলতাও। কলকাতায় থাকা সত্ত্বেও শহুরে নির্জীবতা
বা বিলাসিতা তাঁর হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারেনি, এখনও সে আগের মতোই অকুতোভয়, আগের মতোই
অসমসাহসী। সুরেশের বয়স তখন ১১। স্কুলের ছুটিতে কলকাতা থেকে নাথপুরে এসেছে সে। একদিন
পাখির ছানার খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে একটি আমগাছের উপর কতকগুলি পাখির বাসার খোঁজ পেল কিশোর
সুরেশ। অতএব, দেরী না করেই সুরেশচন্দ্র গাছে চড়লে। এমন সময় একটা প্রকাণ্ড সাপ সামান্য নিচে এক কোটর একটি কোটর থেকে বেড়িয়ে এসে ফোঁসফোঁস করতে লাগল। অন্য
কেউ হলে সেই অভাবনীয় বিপদে বিহ্বল হয়ে পরত। কিন্তু সুরেশ অন্য ধাতুতে
গড়া। সাপ ফণা তুলে ছোবল দেওয়ার আগেই, একাদশবর্ষীয় বালক খপ করে সাপের
গলা ধরে ফেলে। ভাগ্যক্রমে, সুরেশের কোমরে একটা ছুড়ি বাঁধা ছিল। কালক্ষেপ না করে সুরেশ
সেই ছুড়ি দিয়ে সাপের মাথা কেটে ফেলে।
আমরা
যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে
নদীয়ার স্থানে স্থানে নীলকুঠি
থাকায় অনেক ইংরেজ এই জেলায় বাস করতেন। এরা প্রায়ই ঘোড়ার পিঠে চড়ে বুনো শূকর কিম্বা শেয়াল শিকারে অভিযান চালাতেন। তখন সুরেশ নাথপুরে। এক দিন তিন জন সাহেব শিকার
করতে নাথপুরে এলেন, এঁদের সঙ্গে বেশ
কয়েকটি শিকারী কুকুরও ছিল। হঠাৎই পাশের জঙ্গল থেকে ছুটে এল
একটি বন্য শূকর। শূকর দেখেই সাহেবদের কুকুর ঘেউ ঘেউ করে শূকরের দিকে তেড়ে গেল। তাড়া খেয়ে শূকর যেদিকে ছুটছিল, সেইদিক থেকে এমন সময়ে তিনটি ছেলে গ্রামের দিকে আসছিল।
এদেরই একজন সুরেশ। সুরেশই প্রথম শূকরটিকে ধেয়ে আসতে দেখলে। এদিকে সুরেশের হাতে ছিল
একগাছা ছিপ। তাই দিয়ে সুরেশ সবলে আঘাত করলে ছুটন্ত শূকরের মাথায়। সুরেশের সেই এক মোক্ষম আঘাতেই শূকরের ভবলীলা সাঙ্গ হল। ততক্ষণে, সাহেবরা ঘোড়া ছূটিয়ে সুরেশের কাছে এসে পৌঁছেছেন।
সুরেশের সাহস দেখে তারাও অবাক। সুরেশের এই শূকর সংহার তাঁর জীবনের এক শুভ ঘটনাও বটে। এই ঘটনার পরই নাথপুরের ইংরেজ সমাজের
কাছে কিশোর সুরেশ বেশ বিখ্যাত হয়ে ওঠে। সেই সূত্রেই অনেকের সাথেই সুরেশের ঘনিষ্ঠতা
তৈরী হয়।
[৪]
আগেই
বলেছি, এমনিতে সুরেশ দুঃসাহসী, দুর্জয়, নির্ভীক হলেও, পড়াশোনাতে তাঁর মন বসতো না। লন্ডন
মিশন স্কুলে সুরেশ যে ভালো ছাত্র ছিলেন, এমনটা কিন্তু একেবারেই নয়। পড়শোনা করার চাইতে দাঙ্গাহাঙ্গামা করতে
তিনি বিশেষ পটু ছিলেন। স্কুলের যত দাঙ্গাবাজ ছেলের সুরেশই দলপতি। তাস পেটানো আর খুচরো রঙবাজিতেই দিনাতিপাত হচ্ছিলো। এসবের ব্যস্ততায় মাসে
দশদিনও ক্লাসে যাবার সময় হতো না। সুরেশ প্রত্যেকদিন সকাল নটায়
স্কুলে রওনা হতেন ঠিকই, কিন্তু স্কুলে আর পৌঁছতেন না। ছেলের এমন উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন তাঁর পিতামাতারও চিন্তার কারণ
হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। অবশ্য মায়েরও কিছুটা
আশকারা ছিল এতে। কিন্তু ঢাল হয়েও বেশিদিন ছেলেকে বাপের থেকে আড়াল করতে পারেননি
তিনি। ছেলেকে সুপথে আনার অনেক চেষ্টাই করলেন গিরিশবাবু। তাতে ছেলের বিগড়ানো বাড়লো
বৈ কমলো না! আগে তবুও ছেলে বাড়িতে ফিরতো, বাবার শাসন শুরু হবার পর থেকে সেটাও অনিয়মিত হয়ে গেলো। একটা সময় এমন হয়েছিল যে বাড়ির সকলের কাছেই সুরেশ হয়ে উঠেছিলেন চক্ষুশূল।
লন্ডন মিশন স্কুলের প্রধান শিক্ষক রেভারেন্ড অ্যাশটন সুরেশের ডাকাবুকো স্বভাবের জন্য
খুবই স্নেহ করতেন। তিনিও সুরেশকে সুপথে আনার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো
পরিবর্তন হয়নি।
অবশ্য,
সুরেশের উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন ছাড়াও আরও
একটা কারণে তাঁর সাথে তাঁর বাড়ির অন্যান্য মানুষদের একটা দুরত্ব হয়েছিল। কলকাতায় থাকাকালীন
অনেক খ্রিষ্টান সহপাঠীদের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছিল। নিজের বাড়ি
না ফিরে, সুরেশ প্রায়ই তার
খ্রিস্টান বন্ধুদের বাড়িতে খেয়ে সেখানেই ঘুমিয়ে থাকত। তিনি অন্য বিষয়েও যেরূপ উচ্ছৃঙ্খল
হয়েছিলেন, ধর্ম-আচার-ব্যবহার, আহার-বিচার সকল বিষয়েই সেরকমই
উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছিলেন। সুরেশের গোঁড়া
বৈষ্ণব পরিবার তা মেনে নিতে পারেনি। আর খ্রিস্টান বন্ধুদের
সান্নিধ্যে এসে পূর্বপুরুষের জাত-ধর্মের ওপরেও আস্থা হারাতে থাকে সে। এভাবেই একমাত্র মা ও কাকা কৈলাসচন্দ্র
বিশ্বাস বাদে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে তার মনমালিন্য ঘটে।
উদ্ধত
ও উচ্ছৃঙ্খল সুরেশ বাবার শাসনে
ক্ষিপ্ত প্রায় হয়ে উঠেছিলেন। তিনি যেরকম স্বাধীনচেতা, অন্যের
অধীনে থেকে ক্রমাগত অপমান সহ্য করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। এমনই একদিন পিতাপুত্রের মধ্যে
বিষম কলহ উপস্থিত হল, গিরিশচন্দ্র ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সুরেশকে বেত্রাঘাত
করে বসেন। সুরেশ আর সহ্য করতে পারলেন না, তখনই তিনি গৃহত্যাগ করলেন এবং জীবন থাকতে
কোনোদিনও নিজের বাড়ির চৌকাঠ মাড়াবেন
না, এমন ভীষ্মপ্রতিজ্ঞা করে নাথপুর ত্যাগ করলেন। পাছে আত্মীয়স্বজনরা তাঁর খোঁজ করেন,
সেই উপায়ও রাখলেন না তিনি। গৃহত্যাগ করেই সুরেশ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন। তাঁর খ্রিষ্টান
হওয়ার খবর পেয়ে আত্মীয় স্বজন সুরেশের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। সুরেশের বাবা
গিরিশচন্দ্রও তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করে জীবনে তাঁর মুখদর্শন করবেন না প্রতীজ্ঞা করলেন।
গৃহত্যাগ
করে তিনি রেভারেন্ড অ্যাশটনের কাছে আশ্রয় নিলেন সুরেশ। কঠিন সময়ে রেভারেন্ড অ্যাশটন
যেন দেবদুত হয়ে এলেন সুরেশের জীবনে। তাঁর হস্তক্ষেপেই লন্ডন মিশন স্কুলের একটি ঘরেই
বিনামূল্যে সুরেশের থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থা
করা হল। অথচ সুরেশ পরের গলগ্রহ হয়ে থাকার পাত্র নন, কাজেই শুরু হল চাকরির চেষ্টা। নানা স্থানে চেষ্টা করেও
সুরেশ কোন চাকরি জোগাড় করতে পারলেন না। সদাগরী অফিস, সরকারি অফিস, রেল, ডক, জেটি কোথাও বাদ দিলেন
না। যেখানেই কোন চাকরির সম্ভাবনা আছে, সুরেশ সেই সেই খানেই গেলেন, কিন্তু কোথাও কিছু হল না। আর হবেই বা কি করে? একে তাঁর বয়স অল্প, তার উপর লেখা পড়া কম, কেই বা তাঁকে চাকরী দেবে? আর তিনিই বা কি চাকরি করতে
পারবেন?
নিরাশার
মেঘ এই ভাবেই সুরেশকে গ্রাস করছিল। তখনই ঘোর অমানিশার মধ্যে একটা আশার আলো দেখা দিল,
মিশনারি স্কুলে পড়ার সুবাদে তিনি বেশ ইংরেজি শিখেছিলেন। সেটাকেই সম্বল করে তিনি কলকাতার
স্পেন্স’স হোটেলে একটা ছোট্ট কাজ পেলেন। তাঁর কাজ ছিল বন্দর কিম্বা রেলস্টেশনে থেকে
সাহেব-মেমদের হোটেলে নিয়ে আসা এবং ফেরত পৌঁছে দেওয়া, তাঁদের মালামালের হিসেব রাখা এবং
তাঁদেরকে কলকাতার নানান দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে দেখানো। এককথায়, তিনি ছিলেন ট্রাভেল গাইড।
এই
কাজের সুবাদে অনেক ইউরোপীয় সাহেব-মেমদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান সুরেশ। অবসরে
তিনি বিভিন্ন বিখ্যাত পর্যটক ও অভিযাত্রীদের ভ্রমণকাহিনীও পড়তে শুরু করেন। এদিকে স্পেন্স’স হোটেলে গাইডের কাজে তাঁর আর মন বসছেনা। ফলতঃ, অবধারিতভাবেই বিলেতে পাড়ি জমানোর ইচ্ছা তাকে পেয়ে বসে নেশার মতন। কিন্তু
“বিলেত যাবো” বললেই তো আর বিলেতে যাওয়া যায় না! হোটেলে আগমনকারী
অনেক সাহেবকেই তিনি বিলেতে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের দিক থেকে অবজ্ঞা
ভরা মৃদু হাসি ছাড়া সুরেশ কিছুই পায়নি। আত্মীয়স্বজনরা ‘ধর্মত্যাগী’ সুরেশকে কোনোরূপ
সাহায্য করবেন, সেটা ভাবাটাই বাতুলতা। আর বাবা-মা? বাবা গিরিশচন্দ্র তো নিজেই সুরেশকে
ত্যাজ্য করেছেন আর মাও বাবার ভয়ে কিছু করতে পারবেন বলে মনে হয়না।
যত
সময় যাচ্ছিল, সুরেশ ততই যেন অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিলেন। হোটেলের গাইড হয়ে আর কতদিন? কি ভবিষ্যত
আছে এই পেশায়? শেষে একদিন সাতপাঁচ না ভেবেই হোটেলের চাকরতে ইস্তফা দিলেন সুরেশ। জমানো কিছু টাকা নিয়ে সোজা চলে গেলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া
স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির অফিসে। সেখান থেকে একটা ডেক টিকিট কেটে জাহাজে চেপে বসলেন
অজানা ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে। কোথায় যাবেন তিনি? বিলেতে? না না, কলকাতা ত্যাগ করে, বাড়ির সঙ্গে সমস্ত নাড়ির টান ছিন্ন করে তিনি পাড়ি
দিলেন সুদূর বার্মা মুলুকে, রেঙ্গুনে।
[৫]
এত জায়গা থাকতে বার্মাতেই কেন যাচ্ছেন সুরেশ। এর উত্তরে বলা যায়, বিলেত যাওয়ার
উপায় না দেখে তিনি বার্মা যাওয়াই স্থির করেছিলেন। অল্প খরচে নতুন দেশে যেতে চাইলে সর্বাপেক্ষা
প্রশস্ত স্থান হল রেঙ্গুন, তথা বার্মা। তাছাড়া, সেই সময় বার্মায় ইংরেজ রাজত্ব পুরোপুরি
প্রতিষ্ঠিত হয়নি। লোয়ার বার্মা ইংরেজদের অধীনে এলেও, আপার বার্মা তখন দেশীয় শাসকদের
অধীনে। গোটা বার্মাই তখন বিশৃঙ্খল, অরাজক অবস্থার মধ্যে। ইংরেজি জানা লোকেরও তখন বিশেষ
অভাব ছিল বার্মায়, তাই বার্মায় গেলে একটা সুরাহা হওয়ার সম্ভাবনা আছে ভেবে সুরেশ রেঙ্গুনেই
পাড়ি জমান।
যাইহোক,
বার্মা তখন এক চুড়ান্ত অরাজক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এটা আগেই বলা হয়েছে। রেঙ্গুনের
পরিবেশও তখন ভালো না। চারিদিকে খুন-জখম, চুরি-ছিনতাই লেগেই আছে। পুলিশও এমন অবস্থায়
অসহায়। এহেন রেঙ্গুনে এসে সুরেশ তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে উঠলেন। সুরেশ সারাদিন চাকরির
অন্বেষণে এখানে সেখানে ঘুরতেন এবং অবসরে রেঙ্গুনের ইরাবতী নদীতে নৌকাভ্রমণ করতেন। এই
নৌকাভ্রমণ সুরেশের বিশেষ পছন্দের অবসর যাপন ছিল। কলকাতায় থাকাকালীন তিনি তাঁর সহপাঠীদের
সাথে মিলে একটি ‘রোয়িং ক্লাব’ও তৈরী করেছিলেন। চেষ্টাচরিত্র করে একটি নৌকাও জোগাড় করেছিলেন
তাঁরা। বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিলে প্রত্যেকদিন বিকালে নৌকাবিহার করা সুরেশের রূটিন হয়ে
উঠেছিল। কলকাতার সেই অভ্যাস রেঙ্গুনেও ত্যাগ করতে পারেননি সুরেশ। রেঙ্গুনের ইরাবতী
নদীর স্বচ্ছ টলটলে জল দেখে তাঁর কি বাংলার গঙ্গার কথা মনে পড়েছিল? কে জানে!
এমনই
একদিনের কথা। নৌকাভ্রমণ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন সুরেশ। সময়টা
সন্ধ্যা। রাস্তাঘাট এরই মধ্যে ফাঁকা হয়ে গেছে। হঠাৎ একটা শব্দে
চমকে উঠলেন তিনি। কোত্থেকে যেন দুটো ধারালো দা ছুটে গেলো
সুরেশের পাশ দিয়ে। নিক্ষেপকারী দুজন ষণ্ডামার্কা মগ ডাকাত। হুট করেই তারা ঝাঁপিয়ে
পড়লো সুরেশের ওপর। হয়তো তাঁরা ভেবেচিল এই বিদেশি ছোকরাকে খুব
সহজেই কাবু করা যাবে। কিন্তু এ যে সুরেশ! মল্লযুদ্ধে
পারদর্শী সুরেশকে হারাতে ভালোই বেগ পেতে হচ্ছিলো ওদের। তারপরও, পেশাদার দুজন ডাকাতের সাথে পেরে ওঠা দায়। মরতেই বসেছিলেন তিনি। হঠাৎ রাস্তায় আবির্ভূত হয়
একদল বরযাত্রী। তাদের দেখেই ডাকাতেরা পালালো শেষটায়। সে যাত্রায় বেঁচে গেলো
সুরেশের প্রাণ।
যাই
হোক, রেঙ্গুনে এসেও সুরেশ সুবিধা করে উঠতে পারছিলেন না। কয়েকদিন ধরে সুরেশ রেঙ্গুনের
প্রায় প্রত্যেকটি সরকারি ও বেসরকারি অফিসে ঘুরলেন, অনেক লোকজনে সাথে দেখা করলেন, কথা
বললেন, কিন্তু চাকরি পাওয়া দূরে থাক, চাকরির সামান্য আশাটুকুও পাওয়া গেল না। সুরেশের
তখন যেন শনির দশা চলছে। এদিকে হাতের পয়সাকড়ি ফুরিয়ে আসছে, বন্ধুর বাড়িতেও অনেকদিন হল
গলগ্রহ হয়ে আছেন তিনি। শেষমেষ তিনি স্থির করলেন যে দেশে ফিরবেন।
যে
দিন রাত্রে রেঙ্গুন ছেড়ে রওনা হবেন সেদিনের
কথা। সেদিন সন্ধ্যাবেলা শেষবারের মতো রেঙ্গুনের পথে হাওয়া
খেতে বেরোলেন। কোথা থেকে যেন হৈ-হল্লা কানে আসছে। একটি এগিয়েই
তিনি দেখলেন এক ভয়াবহ দৃশ্য। আগুন লেগেছে পাশেরই এক বাড়িতে, দোতলার জানালা থেকে ভেসে আসছে একটি মেয়ের আর্ত-চিৎকার। কিন্তু
কি আশ্চর্য, বাড়ির সামনে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়ে তামাশা দেখছে, দু-একজন ছাড়া কেউই
এগিয়ে এসে সেই মেয়েটিকে সাহায্য করছেনা। যে
কয়েকজন আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন, তাঁরাও সুবিধে করতে পারছিলেন না। চোখের সামনে
একজন মানুষের প্রাণ যাবে, এটা সুরেশ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।
ক্ষণিকের
জন্য ফিরবার কথা ভুলে নিজের প্রাণ বাজি রেখে সুরেশ প্রবেশ করলেন সেই অগ্নিকুণ্ডে। এদিকে সেই মেয়েটি প্রায় অচৈতন্য, বিহ্বল, নিজেকে রক্ষা করার তাঁর যেন আর
শক্তি নেই। সুরেশ সেই জ্বলন্ত ঘরে প্রবেশ করতে না করতেই আগুন যেন আরও তেজে তাঁদেরকে
ঘিরে ফেলল। ঘর থেকে বেড়োনোর আর রাস্তা নেই, দরজা-জানালা, কড়ি-বড়গা সবেতেই আগুন লেগেছে,
যেকোনো সময় ঘর ভেঙে পড়তে পারে। এদিকে মেয়েটিও আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। শেষে সুরেশ
ঘরেরই একটা অর্দ্ধদগ্ধ জানালা ভেঙে বেড়োনোর একটা পথ খুঁজে পেলেন। এবং মেয়েটিকে কোলে
করে অতি সাবধানে জানলা থেকে বেড়িয়ে মই বেয়ে নিচে নামলেন, বাঁচালেন
সেই মেয়েটির প্রাণ।
সুরেশ
নিচে এসে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। মেয়েটিকে কোনোরকমে তার আত্মীয়দের জিম্মায় করে
দিতেই সুরেশের মাথা ঘুরে গেল, তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পরে গেলেন। বলা বাহুল্য, সুরেশ
এই অভিযানে নিজেও আঘাত পেয়েছিলেন, তাঁরও শরীরের বেশ কিছু জায়গা আগুনে পুড়ে গেছিল, তাছাড়া
বিষাক্ত ধোঁয়াতে তাঁর প্রায় শ্বাসরোধ হয়ে এসেছিল। যখন সুরেশের সংজ্ঞা হল তখন তিনি দেখলেন,
যে তিনি তাঁর বন্ধুর বাড়িতে শুরে আছেন। সেই মেয়েটি ও তাঁর বাড়ির লোকজন তাঁর সেবাশুশ্রূষা করছে। মেয়েটির সেবাযত্নে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই
সুরেশ সেরে ওঠেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন, মেয়েটি ভালোবেসে
ফেলেছে তাঁকে। সুরেশও যে টান অনুভব
করেনি এই বিদেশিনীর প্রতি, তা নয়।
কিন্তু তার ভবঘুরে, ছন্নছাড়া
জীবনের সাথে জড়াতে চাননি সেই তরুণীর জীবন। তিনি এই ভালোবাসার
প্রতিদান দিতে অক্ষম। তাই আবেগ দমন করে উঠে পড়েন
মাদ্রাজগামী জাহাজে। ইতি ঘটল সুরেশের রেঙ্গুন পর্বের।
[৬]
কয়েকদিন
পরে তিনি মাদ্রাজে পৌঁছলেন। মাদ্রাজ পৌঁছেও সুরেশের আশার বেলুনে ফুটলো দুর্ভাগ্যের সূঁচ। কারণটা ভাষা! তামিল-তেলেগু না জানায় কোনো কাজই পাওয়া যাচ্ছিলো না
সেখানে। তবুও আশার শেষ রেশটুকু আঁকড়ে তিনি খ্রিস্টান পরিবারগুলোর দ্বারে দ্বারে
ধর্না দিতে লাগলেন। কাজ হচ্ছিলো না তাতেও। মাদ্রাজে যত খ্রীষ্টান পরিবার ছিল, সুরেশ প্রত্যেকের কাছে গেলেন, কিন্তু কোথায়ও কিছু হচ্ছিল
না। কলকাতায় ফেরারও উপায় নেই। হাতে যেটুকু
টাকা অবশিষ্ট আছে তাতে খাওয়া পড়াই চলেনা, জাহাজের ভাড়া দেবেন কি করে। তিনি কি করবেন, কোথায়
যাবেন, কিছুই স্থির করতে না পেরে নিরাশ সুরেশ একদিন সমুদ্রের তীরে এলেন। হতাশা যেন আবারও তাঁকে
গ্রাস করতে লাগল। সামনে সমুদ্রের সফেন ঢেউ বারংবার পদতলে আঘাত করছে। তিনি মনে মনে ভাবলেন, জীবনে
আর প্রয়োজন কি? এত কষ্ট পেয়ে কষ্টের জীবন রাখার অর্থ
কি? এই ত সামনে সমুদ্র যেন নাচছে, একবার লাফিয়ে পরলেই তো সকল জ্বালা জুড়োয়!
একদিকে
রোজগারহীন অবস্থা তো অন্যদিকে পেটে খিদের জ্বালা, মনে তেজ নেই, জীবন চলবে কী
করে? ক্ষুধাময় দিনরাত্রি, একলা নিঃসঙ্গ জীবন। হয়ত সেদিন তিনি আত্মহত্যাই করতেন, সহসা তাঁর দৃষ্টি এক বৃদ্ধ ফিরিঙ্গী সাহেবের দিকে পড়ল। একটা শেষ চেষ্টা
করতে ক্ষতি কি? সুরেশ ধীরে পায়ে সাহেবের দিকে এগিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানালেন। সাহেব প্রতিনমষ্কার
জানিয়ে বললেন, “আমি কি তোমায় কোন সাহায্য করতে পারি?” সুরেশ বললেন, “আমি বিদেশী, সুদূর কলকাতা থেকে চাকরির আশায় মাদ্রাজে এসেছিলাম। অনেক চেষ্টা চরিত্র
করেও কিছু জোগাড় করতে পারিনি। হাতে যেটুকু পয়সা আছে, তাতে এক টুকরো রুটিও জুটবেনা।
ওই টাকাটুকুও ফুরোলে আমায় অনাহারে মরতে হবে। যদি দয়া করে আমাকে একটা কাজের সন্ধান দেন,
তাহলে খুব উপকৃত হই।”
সাহেবঃ
তুমি কতদুর লেখাপড়া করেছ?
সুরেশঃ
কলকাতায় থাকতে লন্ডন মিশন স্কুলে কয়েক বছর পড়েছিলাম, তবে সে পড়া শেষ করতে পারিনি। তবে
আমি ইংরেজি আর বাংলা জানি।
সাহেবঃ
তুমি কি নেটিভ খ্রিষ্টান?
সুরেশঃ
আজ্ঞে হ্যাঁ। স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল রেভারেন্ড অ্যাশটন আমাকে খ্রিষ্টান করেন।
সাহেবঃ
তা ঠিক কি কি কাজ করতে পার তুমি?
সুরেশঃ
আপনি যা বলবেন, তাই করতে পারি। একমুঠো খেতে পাওয়ার জন্য যাই করতে হোক না কেন, আমি পারব।
সাহেবঃ
দেখ খোকা, আমি বড়লোক নই। অবসরগ্রহণের পর বর্তমানে আমার এমন কোনো পদাধিকারও নেই যার
বলে আমি তোমাকে কোনো চাকরির খবর দিতে
পারি। তবে, বাড়িতে আমার দুই নাতির জন্য একজন দেখাশোনার লোক খুঁজছি। তা তুমি কি এই কাজ
পারবে? ভেবে দেখো। আমি এই মুহুর্তে তোমাকে অন্য আর কোনো কাজ দিতে পারছি না।
সুরেশের
মনে আর আনন্দ ধরে না। অন্তত যা হোক একটা চাকরি তো জুটলো, দুইবেলা অন্নসংস্থানের চিন্তাটা
কিছু দিনের জন্য ঘুচলো। বারংবার বৃদ্ধকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, সুরেশ তখনই রাজি হলেন। সেই
দিন থেকেই বৃদ্ধের দুই নাতিকে দেখাশোনার কাজে লেগে পড়লেন তিনি। সুরেশ শীঘ্রই সকলের প্রিয় হতে পারতেন। এখানেও অচিরেই তিনি সাহেব
ও তাঁর নাতিদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। এই খ্রিষ্টান
পরিবারে সুরেশ বেশ কয়েক মাস ছিলেন। শেষে যখন তাঁর কলকাতা ফেরার মতো উপযুক্ত অর্থ রোজগার
হল, তখন তিনি সেই বৃদ্ধ সাহেবের থেকে বিদায় নিয়ে আবার একবার জাহাজে চেপে বসলেন।
[৭]
কথায়
বলে, সংসারের ঝড়ঝাপ্টা নাকি মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়, মানুষকে অনেক বদলে দেয়।
সুরেশের ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যত্যয় হয়নি। এত ধাক্কা খেতে খেতে সুরেশের স্বভাবের অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। সংসার সমুদ্রের
ঢেউয়ে পরে সুরেশের সেই পুর্বের ঔদ্ধত্য একেবারেই লোপ পেয়েছিল। জীবনে এই প্রথম তিনি
লেখা পড়ার গুরুত্ব টের পেলেন। কলকাতায় ফিরে তিনি আবার লন্ডন স্কুলের সেই পুরনো ঘরে
গিয়েই উঠলেন। রেভারেন্ড অ্যাশটন সুরেশের জন্য পাকা ব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছিলেন। এতদিনের নির্মম বাস্তবতায় শিক্ষার গুরুত্বটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলেন
সুরেশ। তাই এইবার তিনি পড়াশোনায় জোর দিলেন। ছোটখাট চাকরির ফাঁকেই তাই মনোনিবেশ করলেন বই পড়ায়। ক্রমে তাঁর লেখাপড়ায় বেশ উন্নতি হতে লাগল।
ওদিকে
মন সুরেশের মন তো পড়ে আছে বন্দরে, সমুদ্রে। এখনও তিনি দিনরাত
স্বপ্ন দেখেন বিলেত যাওয়ার। নিজের পড়াশোনার মাঝে সময় পেলেই তাই তিনি জেটিতে জেটিতে ঘুরে বেড়াতেন। উদ্দেশ্য, মদ খাইয়ে জাহাজীদের সাথে ভাব জমানো আর নানা দেশের গল্প শোনা। যতই তিনি এই গল্প শুনতেন, ততই যেন তাঁর বিলেত দেখার জন্য মন পাগল হয়ে উঠত। বিলেত যাওয়ার জন্য যদি জাহাজের নাবিকও হতে হয়,
তাহলে তিনি তাই হবেন- যেনতেনপ্রকারেন তাঁর বিলেত যাওয়া চাইই চাই।
দিনের
পর দিন, মাসের পর মাস কেটে গেল। কিন্তু সুরেশের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। একদিন বাড়ি
ফেরার পথে তাঁর সাথে জাহাজের এক ক্যাপ্টেনের সাক্ষাৎ হয়। ভদ্রলোক ব্রিটিশ স্টিম নেভিগেশন
কোম্পানিতে জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন, সম্প্রতি তাঁর জাহাজ কলকাতা বন্দরে নোঙর করেছে। সুরেশ ক্যাপ্টেন সাহেবের নাম ঠিকানা জেনে
নিয়েছিলেন। সেই দিন থেকেই তিনি ক্যাপ্টেনের সাথে ভাব জমানো শুরু করলেন। আর ক্যাপ্টেন
ভদ্রলোকও বেশ সুহৃদ ব্যক্তি, অচিরেই দুই জনের মধ্যে বেশ হৃদ্যতা জন্মায়।
এমনই
একদিন আড্ডার মাঝে সুরেশ নিজের গোপন ইচ্ছার কথা ক্যাপ্টেনকে জানালেন। কিন্তু সুরেশের
বয়স কম। স্রেফ ছেলেমানুষি ভেবে ক্যাপ্টেন কথাটাকে হেসে উড়িয়ে দিলেন। কিন্তু সুরেশ ছাড়ার
পাত্র নন। সুরেশের অনুনয় বিনয়ে তিনি অবশেষে তাঁকে লন্ডন নিয়ে যেতে সম্মত হলেন। সুরেশের
দুঃসাহসের কথা মাথায় রেখে তাঁকে নিজের জাহাজে একটি চাকরিও জুটিয়ে দিলেন। সেই দিনই সুরেশ
জাহাজের অ্যাসিষ্টাণ্ট স্টুয়ার্ডের পদে নিযুক্ত হলেন। এমনি করেই একদিন বিলেত যাবার স্বপ্ন সত্যি
হয়ে গেলো সুরেশের। তখন সুরেশের বয়স মাত্র ১৭।
কয়েক
দিন পরেই জাহাজ কলিকাতা ছেড়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে চলল। ব্যাকুল নেত্রে জাহাজের ডেকে
উপর দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো সুরেশ দু’চোখ ভরে কলকাতাকে দেখে নিলেন। বন্দরে সেদিন অনেক
লোক, কেউ জাহাজ দেখতে এসেছেন, কেউ বা নিজের প্রিয়জনদের বিদায় জানাতে — কিন্তু তাঁদের মধ্যে সুরেশের নিজের কেউ ছিল না। তিনিও যে জাহাজের অন্যান্য সওয়ারিদের মতই দেশ, স্বজন, মা-বাবা সকলকেই পরিত্যাগ করে দূর
বিদেশে প্রস্থান করছেন, তা কেউ জানল না; কেউ দেখল না, কেউই তাঁর জন্য এক ফোঁটা চোখের জল ফেলল না। স্নেহময়ী জননীকে কাঁদিয়ে
তিনি চিরদিনের জন্য চললেন, কলকাতা ছেড়ে, নাথপুর ছেড়ে, এতে যেন তাঁর
মনখানি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে লাগল। কতই
বা বয়স তাঁর, তখনই তিনি কিশোর। কতবার ভাবলেন, এখনও সময় আছে, ক্যাপ্টেনকে
বলে নেমে পড়ি, আর বিলেতে গিয়ে কাজ নেই। কিন্তু তৎক্ষণাৎ হৃদয়ের দুর্বলতাকে শমিত করলেন,
চোখের জল চোখেই মুছে মাতৃভূমির আঁচল ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন সুরেশ।
[৮]
“এখন
তুমি কি চাও? লন্ডনেই থেকে যেতে চাও, নাকি যে চাকরি করছ সেটাই করতে চাও?” জাহাজের ক্যাপ্টেন
সুরেশকে জিজ্ঞাসা করলেন। জাহাজ সেদিন টেমস নদীর তীরে লন্ডনে নোঙর
করেছে। চারিদিকে জাহাজ থেকে নামার জন্য যাত্রীদের ব্যস্ততা,
মাল খালাস করার জন্য খালাসি এবং কুলিদের হট্টগোলে কানপাতা দায়। লন্ডনের ব্যস্ততা দেখে
সুরেশ কিছুক্ষণের জয় হকচকিয়ে গিয়েছিল। এত ব্যস্ততা, এত গতিময়তা কলকাতাতেও
নেই। লন্ডনের কাছে কলকাতা যেন নেহাত মফঃস্বল।
সুরেশ
কিছুক্ষণ ভেবে জানালেন, “এখনও কিছুই স্থির করে উঠতে পারিনি, কি করব না করব সেটাই ভাবার
অবকাশ পাইনি।” ক্যাপ্টেন স্নেহভরে সুরেশের চুল ঘেঁটে বললেন্, “বেশ, ভেবে চিনতে যা ভাল
বোঝ তা কর। তবে চিন্তা করনা, আমার দ্বারা যতটা সম্ভব, আমি তোমাকে সাহায্য করব। জাহাজ
তো প্রায় তিন সপ্তাহ লন্ডনে থাকবে। আমি বলি কি, তুমি আগে লন্ডন শহরটা ঘুরে দেখে নাও।
আর জাহাজ যতদিন এখানে আছে, জাহাজেই তোমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
সুরেশ
কৃতজ্ঞতায় গলে গিয়ে বললেন, “ক্যাপ্টেন, আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ দেব তা আমার জানা নেই।
আমার বাবাও যা আমার জন্য করেননি, তা আপনি করলেন।” ক্যাপ্টেন হাসতে হাসতে বললেন, “ধন্যবাদ
দিতে হবেনা। তোমার ভাল হোক, মনেপ্রানে সেটাই প্রার্থনা করি। যদি আমার কথা শোন, তবে
এখনই তোমার মাইনের টাকা নিওনা। তুমি তো জাহাজেই থাকবে, অতএব, তোমার আপাততো বাইরের কোনো
খরচ নেই। যখন জাহাজ ছেড়ে যাবে, তখন তো
লন্ডনে তুমি একা, তখন তোমার টাকার দরকার পরবে। মনে রেখ, এ শহরে একগাছি ঘাসও তুমি বিনামূল্যে পাবেনা।”
সুরেশ
অতঃপর ক্যাপ্টেনের থেকে বিদায় নিলেন। এবং জাহাজের বোটসোয়েন-এর সাথে লন্ডন শহর ভ্রমণে
বেরিয়ে পরলেন। সুরেশ কদিন বেশ করে লন্ডন ঘুরে দেখতে লাগলেন। বিস্তৃত
লণ্ডনের রাস্তা ঘাটও তিনি কিছুটা চিনে নিলেন। সুরেশ প্রত্যেকদিন ভোরে
জাহাজ থেকে থেকে বেরিয়ে শহর দেখতেন, এবং সন্ধ্যার পর জাহাজে ফিরে আসতেন।
এইভাবে
কয়েকদিন কেটে গেল। জাহাজের লন্ডন ত্যাগ করার সময়ও চলে এল। এইবার লন্ডনে একটা বাসা জোগাড়
না করলেই নয়। সুরেশ বোটসোয়েনের সাহায্যেই লন্ডনের ইস্ট এন্ড পল্লীতে সস্তায় একটি ঘর ভাড়া নিলেন। অবশ্য নামেই ঘর, আদপে এক কামরার একটি পায়রার খুপড়ি মাত্র। ঘরে থাকার মধ্যে
একটা ভাঙ্গা চেয়ার, একটা ভাঙ্গা টেবিল এবং শোয়ার জন্য একখানি শতচ্ছিন্ন গদি।
তাছাড়া, ইস্ট এন্ড-এর পরিবেশও ভালো নয়।
আসলে ইস্ট এন্ডকে লন্ডনের গরীব পাড়া
বলা যেতে পারে, যত রাজ্যের ছোটলোকেদের বাস। ঘিঞ্চি সব বাড়িঘর, এদেশের বস্তির থেকেও
খারাপ অবস্থা। লণ্ডনের যত বদমাইস প্রভৃতির এটাই বাসস্থান ও আড্ডা। পদে পদে মদের দোকান!
রাস্তায় মাতালের হুড়োহুড়ি, খোলা নর্দমা; তাতে আবার কুকুর
শুকরে খেলা করছে। সকল স্ত্রীপুরুষ যেন পাপের নিম্নতম স্তরে অবতীর্ণ হয়েও সন্তুষ্ট নয়। সকল প্রকার উচ্ছৃঙ্খলতা ও পাপকার্যেই যেন তাদের বিপুল আনন্দ।
সুরেশও
এই পাপের জগৎ-এর হাতছানি থেকে পরিত্রাণ পাননি। একেই বেকারত্বের জ্বালা, যেখানে হাজার হাজার সাহেব মেম প্রত্যহ চাকরির হাহাকার করে দ্বারে দ্বারে
ঘুরছে, সেখানে বিদেশী বাঙ্গালী বালক
সুরেশ চাকরি সহজেই চাকরি পাবেন তা আশা করাটাই একরকম ধৃষ্টতা।
একদিন সন্ধ্যেবেলার কথা। সুরেশ সবে বাড়ি ফিরেছেন, ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত দেহমন। একটু
মদ্যপান করলে দেহ ও মনে বল পাবেন ভেবে তিনি ভাটিখানায় ঢুকলেন। দুজন মহিলা কোনার এক টেবিলে বসে সুরাপান করছিলেন। সুরেশের
হাতে মদের বোতল দেখে তারা সুরেশের সাথে আলাপ করল এবং সুরেশকে নিজেদের টেবিলে নিয়ে যাওয়ার
জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। সুরেশের মনের অবস্থা এমনই যে তিনি তাঁদের উপরোধ অনুরোধ এড়াতে
পারলেন না।
শীঘ্রই
সে বোতল শেষ হল। সুরেশ আর এক বোতল হুকুম করলেন। তারপর আরও একটা…তারপর আরও একটা…তারপর আরও একটা। বলা বাহুল্য, সুরেশ তখন বেহেড মাতালে পরিণত হয়েছেন, মহিলা
দুজনের অবস্থাও সেরকমই। তিনজনে মিলে অনেক নাচগান, চীৎকার কোলাহল করা হল। শেষে রমণীদ্বয়
আরও এক বোতল মদ নিয়ে সুরেশকে টানতে টানতে তাদের ঘরে নিয়ে গেল। এরপরে কি হল তা সুরেশের
মনে নেই। পরেরদিন দুপুর বেলায় যখন ঘুম ভাঙল, তখনও সুরেশের নেশা কাটেনি। মাথা যন্ত্রনায়
তুলতে পারছেন না। পুরো ঘর লণ্ডভণ্ড, পাশে সেই দুই মহিলা অর্ধ উলঙ্গ ও বেহুঁশ হয়ে পরে
আছে। সুরেশ বুঝতে পারলেন, মাতলামির চুড়ান্ত হয়েছে আর তারই সঙ্গে তাঁর অশেষ অধঃপতন ঘটেছে।
তবে সুরেশের তাতে হুঁশ হলনা। তিনি রমণীদ্বয়কে জাগানোর
জন্য তাদের অধরে চুম্বন করলেন, তারাও যেন শরীরে প্রাণ ফিরে পেল। আবার মদ এল, আবার চূড়ান্ত
নোংরামি। সেই দিন এইভাবেই কাটল; তারপরের দিনও এবং তারপরের দিনও। এহেন সমুহ বিপদে সুরেশকে
রক্ষা করার মতো কেউই ছিলনা, তাঁকে সদুপদেশ দেন বা তাঁকে শাসন
করেন এমন কোনো আত্মীয় তাঁর মাথার উপর ছিলনা। বস্তুত, এখানে
সুরেশকে বারণ করার কেউ নেই।
কয়েকদিনের
মধ্যেই সুরেশের জমানো টাকা পয়সা শেষ হল। ওই মহিলা দুজনও তখন পাততাড়ি গোটালে। এবার সুরেশের
নেশা ছুটে গেল, হুঁশ এল। অনুতপ্ত সুরেশের কাছে একটা কানাকড়িও নেই। কি করবেন, কোথায়
যাবেন? এত আর ভারতবর্ষ নয় যে লোকের দ্বারে
গেলে লোকে একমুঠো ভিক্ষা দেবে।
[৯]
পকেটে
রেস্ত না থাকায় তাঁকে ইস্ট এন্ডের বাস ওঠাতে হল। চাকরি পাবার
আগেই হতে হল গৃহহীন। এরপর অভাবের
তাড়নায় তিনি খবরের কাগজ বিক্রি শুরু করলেন। চলে এলেন হাইড
পার্কে। কোন কাজেই সুরেশ বেশি দিন মনোনিবেশ
করতে পারতেন না। কাজেই খবরের কাগজ বিক্রির কাজও তাঁর আর ভালো লাগছিলনা। উপার্জন মন্দ হচ্ছিলনা, তা সত্ত্বেও একসময় ইস্তফা
দিলেন সেই চাকরি থেকে। এরপর শুরু করলেন মুটেগিরি। পেটের দায়ে পাপ কর্মে লিপ্ত হওয়ার
থেকে এটাই অনেক শ্রেয় ছিল সুরেশের কাছে। সুরেশ দেখলেন খবরের কাগজ বিক্রির থেকে মুটে-কুলির কাজে উপার্জ্জন অনেক বেশী হয়, তিনি
যে দিন থেকে এই কাজ শুরু করলেন, সেই দিন থেকে তাঁর অনেক
কষ্ট ঘুচল। বেশ দুপয়সা আয় করছিলেন, কিন্তু সুরেশ স্বভাবতই
একসময় সেটাতেও ইস্তফা দিলেন।
এরই
মধ্যে সুরেশ বাড়ি বদল করেছেন। হাইড পার্ক
থেকে উঠে এসেছেন লন্ডনের এক অপেক্ষাকৃত সম্ভ্রান্ত এলাকাতে। কিন্তু সেখানেও বিপদ। সুরেশ
নিজের আচার ব্যবহারে প্রায় সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। সুরেশের মুখে তাঁর দেশের
গল্প, তাঁর অভিযানের গল্প, রেঙ্গুন-মাদ্রাজ-কলকাতার
গল্প শুনতে নতুন বাড়ির বাসিন্দারা খুবই
পছন্দ করতেন। বিশেষ করে বাড়ির মহিলা
বাসিন্দাদের কাছে তিনি বিশেষ প্রিয় ছিলেন। এঁদের মধ্যেও একজন ছিলেন (ইনি আবার সুরেশের
থেকে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠা, তার উপর বিবাহিতা) যিনি সুরেশকে একটূ ‘বিশেষ’ রূপে ভালোবাসতে
আরম্ভ করলেন। সুরেশ যতদিনে বুঝলেন, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
একদিন
রাতের বেলা অতিমাত্রায় প্রেম প্রকট হওয়ায় সেই রমণী সুরেশের ঘরে ‘প্রেমনিবেদন’ করতে
‘ব্যগ্র’ হয়ে পরেছিলেন। অনেক সাধ্য-সাধনা, অনুনয়-বিনয়ের পরে সে যাত্রায় সুরেশ মহিলার
‘উগ্র প্রেম’ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। ঘটনার নাটকীয়তায় তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে এখান থেকে পিঠটান না দিলে সামনে সমূহ বিপদ;
আর এই বিপদ হয় মহিলা ডেকে আনবেন আর নাহয় তার স্বামী। অনেক ভাবনা চিন্তা করে সুরেশ লন্ডন
ত্যাগ করাই সমীচীন মনে করলেন।
যেমন
ভাবা তেমনি কাজ। সুরেশ ফেরিওয়ালার কাজ জুটিয়ে বেড়িয়ে পরলেন ইংল্যান্ডের পল্লিগ্রামের
উদ্দেশ্যে। লন্ডন থেকে সস্তায় জিনিসপত্র কিনে দুর-দুরান্তের গ্রামে তা ফেরি করতেন।
এমনি করেই বেশ আয় হচ্ছিল সুরেশের। তাছাড়া, গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি বেশ আনন্দেই ছিলেন।
আর সেই সঙ্গেই চলছিল তাঁর পড়াশোনা। সকালে গ্রামে গ্রামে ঘুরে জিনিস ফেরি করতেন এবং
অবসরে বই পড়তেন। গণিত, জ্যোতিষ, রসায়ন ইত্যাদি
নানা বিষয়ে অধ্যয়ণ চালিয়ে গেলেন পুরো দমে। আর যেটা শিখলেন—তার নাম ম্যাজিক। এরই সাথে ল্যাটিন
ও গ্রিক ভাষা চর্চাও শুরু করলেন। তিনি যে কটি বছর ফেরিওয়ালা হয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছিলেন,
সে কটি বছরে তাঁর পড়াশোনার প্রভুত উন্নতি ঘটে। কথাবার্তা, আচার ব্যবহার, শিক্ষাদীক্ষায়
তিনি শিক্ষিত ইংরেজদের থেকে কোনো অংশে কম ছিলেন না।
[১০]
ফিরিওয়ালা
হয়ে ঘুরতে ঘুরতে কেন্ট প্রদেশে এসে হাজির হলেন এবার। সেখানে
এক সার্কাস দল খেলা দেখাচ্ছিলো। তিনি যে হোটেলে থাকতেন, সার্কাসের লোকেরা সেখানে প্রায়ই গল্পগুজব, আড্ডা দিতে আসতেন। সেই সূত্ৰেই আলাপ জমে উঠল। সার্কাসের রোমাঞ্চকর জীবন
তাঁকে হাতছানি দিতে লাগল। ফেরিওয়ালার চাকরি তাঁর আর ভাল লাগল না। ঠিক করলেন সার্কাসের দলেই নাম লেখাবেন। পরের দিন ভোর হতে না হতেই তিনি সার্কাস
দলের ম্যানেজারের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। প্রাথমিক আলাপ পরিচয়ের পর্ব শেষ হলে তিনি নিজের
ইচ্ছাটার কথা ম্যানেজারকে বললেন, “যদি আমাকে আপনাদের সার্কাস দলে নেন, তাহলে আমি কুস্তি,
জিমন্যাস্টিক প্রভৃতির খেলা দেখাতে পারি।” শরীরের দিক থেকে
দেখলে সার্কাসে যোগ দেওয়ার যোগ্যতা তাঁর ছিল না। কিন্তু নিয়মিত ব্যায়ামে তাঁর
শরীরের গঠন লোহার মতো কঠিন এবং আঘাতসহ হয়ে উঠেছিল। ম্যানেজার
সুরেশের বাহ্যিক গড়ন দেখে একটু দোনোমনা করছিলেন। সুরেশ নির্ভয়ে তাঁকে বলেন, “চাইলে
আমাকে পরীক্ষা করে নিন।” একটু মজা দেখার জন্যই বোধ হয় ম্যানেজার রাজি হলেন, ডেকে পাঠালেন
দলের সবথেকে শক্তিশালী খেলোয়াড়কে। “এর নাম স্যাম, এর সাথে টিকতে পারবে?”
“কুস্তিতে
পারব।” নির্দ্বিধায় বললেন সুরেশ। অতঃপর দু’জনে কুস্তি লড়লেন
এবং দশ মিনিটের মধ্যে সুরেশ প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করে দিলেন। ম্যানেজার অবাক। সুরেশ বললেন, “আপনি চাইলে আমি হরাইজন্টাল এবং প্যারেলাল
বারের খেলাও দেখাতে পারি।” “তার আর দরকার পরবে না। তুমি আমাদের দলে যোগ দিতে পার। থাকা
খাওয়ার খরচ সার্কাস থেকেই পাবে, তাছাড়া সপ্তাহে ১৫ শিলিং করে মাইনে পাবে। যদি রাজি
হও, তাহলে আজই যোগ দিতে পার।” সুরেশ যেন হাতে চাঁদ পেলেন। অন্য
খেলোয়াড়রা আরও বেশি মাইনে পেতেন। কিন্তু তিনি নতুন, ক্রমে
কাজ শিখলে মাইনেও বাড়বে। এই ভেবে তিনি তখনই সেই সার্কাস দলে যোগ দিলেন। ম্যানেজারও ভাবলেন সস্তায়
এক ভারতীয়কে পেয়ে তিনি একটা বড়ো
দাঁও মেরে নিলেন।
কেন্ট
থেকে সার্কাস দল চলে গেল সাসেক্সে। সুরেশও গেলেন তাদের সাথে। সুরেশের মুখ দেখিয়ে পোষ্টার
দিলেন ম্যানেজার, “অদ্য রাত্রে এক ভারতবর্ষীয় যুবক অদ্ভুত ক্রীড়া দেখাইবেন।” তাতেই
ফল হল। ভারতীয় কালা আদমির খেলা দেখতে গোটা শহর যেন সার্কাসের তাঁবুতে ভেঙে পরলো। সুরেশও
রঙ বেরঙ্গের পোষাক পড়ে দর্শকদের সামনে নানা রকমের খেলা দেখাতে লাগলেন। প্রতিপদেই করতালি,
প্রতিপদেই প্রশংসা। অভিষেকেই সুরেশ বাজিমাত করে দিলেন। তাঁর প্রস্থানের পরও দর্শকদের
করতালীতে তাঁবু যেন ফেটে পড়ছে। ম্যানেজার উৎফুল্ল, উৎফুল্ল সারকাসের অন্যান্য খেলোয়াড়রাও।
সকলেই সুরেশের সাফল্যে আনন্দিত; সকলেই সুরেশের প্রশংশায় পঞ্চমুখ।
সার্কাসই
সুরেশের ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠল। যে সার্কাস তাঁকে খ্যাতি এনে দিচ্ছিল, সুরেশও সেই সার্কাসের
জন্য প্রাণপাত করতেও রাজি। একের পর এক শো, সব শোই হিট, হাততালিতে
সার্কাসের তাঁবু আলোড়িত হতে থাকল প্রতিটি শোয়ে। । আর সবেরই
মধ্যমণি সুরেশ। ইংল্যান্ডের এই শহর থেকে সেই শহর – সব জায়গাতেই সার্কাসে একজনই শেষ
কথা- বাংলার সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস। তবে এত কিছুর পরও কিন্তু তিনি নিজের দেশের কথা ভুলে
জাননি। সুরেশ নিজের সাফল্যের কথা লিখে পাঠালেন দেশে
কৈলাসকাকাকে। মায়ের অভাব এই দূরদেশে বসে তিনি খুব অনুভব করতেন। এখন তাঁর মাইনে
বেড়েছে, ভাল জামাকাপড় পরেন, ভদ্রসমাজে মেশেন—তাঁর এত সুখ যদি মা নিজের চোখে
দেখতেন!
[১১]
কৈশোর
পেরিয়ে যৌবনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছেন সুরেশ। যৌবন-সুলভ
ভাবাবেশে তাঁঁর দেহ মন সমস্তই
উৎফুল্ল। নিজের অজ্ঞাতসারেই তাঁর হৃদয়ে প্রেমের উঁকিঝুঁকি।
সুরেশ সার্কাস দলের মেয়েদের সঙ্গেও গল্পগুজব করেন। কিন্তু
জার্মান মেয়েটি যেন একটু আলাদা সবার থেকে, ইংরেজিও বেশ ভাল বলেন। তাঁর সঙ্গে মনের কথা বলেন। দু’জনেই নিজের দেশ ছেড়ে
দূরে—সুরেশ তাঁকে তাঁর দেশের কথা, বাবা-মা সবার কথা জিজ্ঞাসা করেন—কিন্তু ভিতরে কোনও ব্যথার কারণে তিনি
কাউকেই নিজের কথা বলতে চাইতেন না। খুব গম্ভীর হয়ে উঠতেন। একটা মর্যাদাবোধ, একটা আভিজাত্য বালিকাটিকে ঘিরে থাকত। সুন্দরী
তো অবশ্যই, কিন্তু তাঁর ঘনকৃষ্ণ চুল
যেন সুরেশকে বেশি আকর্ষণ করত। তাঁরা শুধু দু’জনে যখন থাকতেন— তখন কিন্তু তাঁর চোখে
প্রেমের স্বপ্ন উচ্চারিত হয়ে যেত। কিন্তু উচ্ছ্বাস দমন করতেন দু’জনেই। অবকাশ পেলেই
সুরেশের মনে তাঁর কথাই বার বার ছবি হয়ে উঠত। প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে— কখন যে
তাঁরা তাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন কেউ
জানে না!
একদিন এমন একটা ঘটনা ঘটে
গেল যাতে বালিকাটির পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ল। সুরেশ একদিন বাজার থেকে টুকিটাকি
জিনিস কিনে এনে ঘরে রেখেছেন, জার্মান
কিশোরীটি সেগুলির গুছিয়ে রাখতে গিয়ে দেখলেন একটি জিনিস একটি পুরনো খবরের কাগজে
জড়ানো। সেটি বার করে রেখে সেই পুরনো কাগজটা পড়তে গিয়ে একটা বিজ্ঞাপনে তাঁর চোখ
আটকে গেল।তাঁর মৃত্যুপথযাত্রী জননী নিরুদ্দিষ্টা কন্যাকে মৃত্যুর আগে একবার ফিরে
আসার জন্য কাতর প্রার্থনা জানিয়েছেন। কাগজটি হাতে নিয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে তিনি
হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলেন। সুরেশ তা দেখে তাঁর হাত দুটি ধরে সপ্রেমে সান্ত্বনা
দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইলেন। তিনি আরও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে
তাঁর বুকে মুখ লুকিয়ে কাগজটি সুরেশের হাতে তুলে দিলেন। সেটি পড়ে বুঝতে পারলেন
কিশোরী সার্কাসে যোগ দিতে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলেন।
আর
ওই কিশোরীটিকে কেউ আটকে রাখতে পারলেন না। সবার কাছে বিদায় নিয়ে তিনি মায়ের কাছে
ফিরে গেলেন। সুরেশ, বিরহী সুরেশ—
তাঁকে লন্ডন পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এগিয়ে গেলেন। বন্দরে পৌঁছে তাঁর চোখে বাঁধ
না-মানা অশ্রুরাশি দৃষ্টিকে করে দিল অস্বচ্ছ। জাহাজে সুরেশকে
বিদায় দেওয়ার সময় মেয়েটি আর নিজের মনের ভাব গোপন করতে পারলনা। একরাশ বাঁধ ভাঙ্গা আবেগ নিয়ে সুরেশের কাছে নিজের ভালোবাসার কথা
স্বীকার করলেন। সুরেশের মন হরষে-বিষাদে পূর্ণ হল। তিনিও সজল নয়নে মেয়েটিকে বিদায় গ্রহণ করলেন, বললেন, “তোমার আমার মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। আমাদের বিয়ের সম্ভাবনা নেই। আমাকে
ভুলে যাও। যদি পারি, আমিও ভুলবার
চেষ্টা করবো।” চোখের জলে স্নান করে
জাহাজ ছেড়ে গেল জার্মানির উদ্দেশ্যে। দু’জনের বুকে তখন অশ্রুলবণাক্ত বিচ্ছেদের সমুদ্রতরঙ্গ। ঘর গড়ার স্বপ্ন সেই
ঢেউয়ের আঘাতে খান খান হয়ে গেল।
[১২]
সুরেশের
বয়স তখন ২০ পেরিয়ে ২১। সার্কাসে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন ততোদিনে। তবে ভবিষ্যৎ-এ
তিনি যে খেলা দেখিয়ে বিখ্যাত হবেন, যে কীর্তিকথা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এর
বীরেন কারান্ডিকার দেশ ছেড়ে সার্কাসের
দলে নাম লেখাবেন, সেই বাঘসিংহের খেলা দেখানো তখনও তিনি শুরু করেননি। বস্তুত তখনও তিনি
কুস্তি এবং ট্রাপিজের খেলা দেখিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন। তবে লন্ডনে থাকাকালীনই তাঁর কাছে
এমন একটি সুযোগ আসে যাতে তাঁর জীবনের মোড় অন্যদিকে ঘুরে যায়।
চার্লস
জ্যামরাখ ছিলেন তৎকালীন লন্ডনের সেরা পশুব্যবসায়ী, বন থেকে পশু-পাখি ধরে তাদের পোষ
মানিয়ে সার্কাসে, চিড়িয়াখানায়, ধনী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত পশুশালায় বিক্রি
করাটাই ছিল তার পেশা। এছাড়া তিনি নিজেও দক্ষ পশু বশকারী ছিলেন। ভদ্রলোক নিজেও ভারতবর্ষে
এসে পশুর ব্যবসা করে গেছেন। লন্ডনের র্যাটক্লিফ হাইওয়েতে ছিল এই চার্লস জ্যামরাখের
অফিস। সুরেশের সাথে এই প্রোফেসর জ্যামরাখের পরিচয় ঘটে। অনেকদিন ধরেই তিনি নিজের জন্য
এক দক্ষ সহকারী খুঁজছিলেন। একদিন সার্কাসে সুরেশের খেলা দেখে তার সাহস ও বুদ্ধিতে খুবই
প্রীত হলেন প্রোফেসর জ্যামরাখ, এমন ছেলেই তো চাই। খেলা ভাঙ্গার পর, সোজা তিনি সুরেশের
কাছে গিয়ে তাঁকে নিজের সহকারী হওয়ার প্রস্তাব জানালেন। সুরেশ এমন প্রস্তাবে আত্মহারা
হয়ে উঠলেন। তখনই তিনি সার্কাস দল থেকে ইস্তফা দিয়ে জ্যামরাখ সাহেবের পশুশালায় নিযুক্ত
হলেন।
জ্যামরাখ
সাহেবের প্রশিক্ষণে তিনি পশুবশে ক্রমেই পারদর্শী হয়ে উঠলেন। জ্যামরাখ সাহেব নিজে তাঁকে
প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। তার প্রশিক্ষণেই সুরেশ মহাদুর্দ্দান্ত
ভয়ানক ভয়ানক আফ্রিকান সিংহ-সিংহনিকে তিনি কুকুরের ন্যায় পোষ মানাতে পারতেন — অবলীলাক্রমে তাদের সাথে খেলা করতেন। সত্যি বলতে, সুরেশ পশুবশে অল্পদিনের মধ্যেই জ্যামরাখ সাহেবের
অনেক পুরনো সহকারীদের থেকেও দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন।
দুই
বছর তিনি জ্যামরাখ সাহেবের অধীনে ছিলেন। জ্যামরাখও নিজের এই শিষ্যটিকে নিজের সমস্ত
জ্ঞান উজাড় করে দিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ শিক্ষিত হয়ে সুরেশ আবার সার্কাসে যোগ দেন, তবে এবার আর ট্রাপিজের খেলা নয়। সুরেশচন্দ্র তখন জগদ্বিখ্যাত হয়ে পড়েছেন হিংস্র বনের পশুকে বশ মানানোর কসরতে। যখন যেখানে তার সার্কাস গিয়েছে, সেখানকার সকলেই তার সাহস দেখে মুগ্ধ
হয়েছিলেন। অনেক রাজন্যবর্গের সামনেও
খেলা দেখিয়ে
তিনি বিশেষ প্রশংসা লাভ করেছিলেন। তবে সুরেশের খ্যাতির মধ্যগগনে ওঠেন ১৮৮২ সালে। লন্ডনের রয়াল অ্যাগ্রিকালচারাল
হলে ওয়ার্ল্ড’স ফেয়ারে তিনি খেলা দেখিয়ে তিনি জগৎব্যাপী খ্যাতি লাভ করেন। সেই সঙ্গে
সম্মাননা হিসেবে পান প্রচুর মেডেল এবং সার্টিফিকেট।
সার্কাসের
দলের সাথে ঘুরতে ঘুরতে তাঁর দল জার্মানির হামবুর্গ শহরে
হাজির হয়। এই হামবুর্গেই থাকতেন আরেকজন পশুব্যবসায়ী কার্ল
হ্যাগেনবেক। ভদ্রলোক দেশে বিদেশে পশু রপ্তানি তো করতেনই, সেই সঙ্গে হামবুর্গ শহরে
‘তিয়ারপার্ক হ্যাগেনবেক’ নামে তার ব্যক্তিগত পশুসংগ্রহশালাও ছিল। সুরেশের হিংস্র পশু
বশ করার ক্ষমতার কথা জেনে তিনি সুরেশকে নিজের সংগ্রহশালায় মাস্টারট্রেনার হিসেবে নিযুক্ত
করতে চাইলেন। সুরেশও সার্কাসের থেকেও অনেক বেশি বেতনে হ্যাগেনবেক পশুশালায় নিযুক্ত
হলেন।
হ্যাগেনবেকের
পশুশালায় শুধু বাঘ সিংহ নয়, ভাল্লুক এবং হাতিকেও পোষ মানাতেন। তারা সুরেশের হাত চাটত,
গা চাটত, এমনকি সুরেশ তাদের মুখের ভেতরে নিজের মাথা ঢুকিয়ে দিতে পারতেন নিশ্চিন্তে।
একটি বাঘকে তিনি ছোট থেকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, তার নাম ছিল ফ্যানি। ফ্যানি পোষা কুকুরের
থেকেও বেশি অনুগত ছিল সুরেশের। বস্কো নামের একটি হাতিকেও
তিনি এমনই পোষ মানিয়েছিলেন যে, তিনি
না খাওয়ালে সে খেতোই না। এক প্রখ্যাত ব্যবসায়ী হোর্হে কার্ল
৫০০০ ফ্রাঁ মূল্যে হাতিটিকে কিনে নেন।
সে হাতি কিনেও এক ঝক্কি, সুরেশের অভাবে বস্কো অন্নজল ত্যাগ করল। বাধ্য হয়ে কার্ল মশাই
মোটা বেতনে সুরেশকেও নিজের পশুশালার কাজে নিয়োজিত করেন।
মি.
কার্লের পশুশালায় কাজ করে সুরেশের খ্যাতি বাড়ল বই কমল না। খ্যাতির সাথে অর্থাগমও হতে
লাগল প্রচুর। গোটা ইউরোপে পশুপ্রশিক্ষণে ক্রমেই অদ্বিতীয় হয়ে
উঠছিলেন সুরেশ। তার প্রশিক্ষিত পশু চড়া দামে বিকোতে লাগলো বাজারে। সত্যি বলতে, সুরেশ পশুদেরকে ‘পশু’ ভাবতেননা, ভাবতেন নিজেরই বন্ধুবান্ধব;
তাদের সাথেই দিনের বেশীরভাগ সময়টা কাটাতেন। সুরেশ নিজের হাতে পোষ মানানো পশুদেরকে অন্তর
থেকে ভালোবাসতেন, পশুরাও হয়তো সেই ভালোবাসাটাই সুরেশকে ফিরিয়ে দিত।
[১৩]
সাধারণ
মানুষের পক্ষে ইন্দ্রিয়দমন একরকম অসম্ভব ব্যাপার। এমন মানুষ বোধ করি এ জগতে নেই, যিনি জীবনের কোন না কোন
সময়ে হৃদয়ের সৌন্দর্য্যপিপাসায় পীড়িত হয়ে কামিনীর কমনীয়রূপে আকৃষ্ট হননি ও প্রেমের তরঙ্গে অবগাহন করে আত্মহারা হননি। দুর্দমনীয়
প্রেমবৃত্তিকে উচ্ছেদ করতে কেই বা সমর্থ? সুরেশ আগেই একবার
প্রেমে পড়েছিলেন, কেন্টের সেই সার্কাস দলের সেই জার্মান মেয়েটিকে তিনি হয়তো কোনোদিনই
ভুলতে পারেননি। মেয়েটি যখন লন্ডন ছেড়ে জার্মানি চলে আসে, তখন সুরেশ নিজের এবং মেয়েটির কথা ভেবেই তার সাথে সমস্ত
যোগাযোগ একসময় বিচ্ছেদ করে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, হয়তো একসময় ভুলে যাবেন। কিন্তু না,
ভুলতে পারেননি সুরেশ। ভুলতে পারেনি সেই জার্মান মেয়েটিও।
সুরেশ
তখন হামবুর্গের মি. কার্লের পশুশালায় ট্রেনার হিসেবে কাজ করছেন। একদিন বিকেলের দিকে
এদিক ওদিক ঘুরে বেরাচ্ছেন, এমন সময় রাস্তার ওপারে একটি দোকানে খুব চেনা একজনকে ঢুকতে
দেখলেন তিনি। ভালো ভাবে দেখার জন্য রাস্তা পেরিয়ে দোকানের সামনে আসতেই যেন হাজার ভোল্টের
শক খেলেন সুরেশ। একি! এ যে সেই মেয়েটি। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না সুরেশ।
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। মেয়েটিও ঘুরে তাকিয়ে অবাক হল। বহুকাল দুজনে দুজনকে
দেখেনি, বহুকাল কথা হয়নি, তাও সুরেশকে চিনে নিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলনা মেয়েটির।
দুজনেই
এতদিনে অনেক বদলে গেছেন। মেয়েটি সুরেশকে
ছেড়ে যখন জার্মানিতে চলে এল, তখন তারা
কিশোর। মেয়েটি এখন আর বালিকা নয়, রীতিমত যুবতী। সুরেশও যৌবনে পদার্পন করেছেন। দুজনেই
দুজনকে দেখে স্তম্ভিত, কিছুকাল তাদের মধ্যে কোনো বাকস্ফূর্তি হলনা। দুজনেই যেন বুঝল
যে, কেউই কাউকে ভুলে যায়নি, ভোলা সম্ভব হয়নি। শুধু দু’জনের
হাত এগিয়ে সব কথা, না-জানানো হাজার
প্রেমের বাণী দুজনের হৃদয়কেই মথিত
করতে লাগল। কিঞ্চিৎ নিষ্পন্দ থেকে দুজনেই দুজনের হাত ধরে দোকান
থেকে বেড়িয়ে সামনের একটি পার্কে গিয়ে বসলেন। গাছের তলায় বেঞ্চে বসে উভয়ে কত কথা বললেন!
কত দিনের কত জমানো কথা, সেই কথার শেষ নেই, শুরু নেই।
সেদিনের
মত তারা উভয়ে উভয়কে প্রেমালিঙ্গন করে বিদায় নিলেন বটে, কিন্তু এই দেখাই শেষ দেখা হল
না। তারপর প্রায়ই দেখা৷ শেষ পর্যন্ত
অভিসারিকা গোপনে প্রতিদিনই সুরেশের আবাসে আসতে থাকলেন, “দূতের পন্থা গমনে ধনী সাধয়ে মদিরে যামিনী জাগি৷” এবং অনিবার্য পরিণাম ঘটে গেল৷ দুজনেই দুজনের
প্রেমে হিতাহিত কাণ্ডাকাণ্ড সবই ভুললেন, এবং এসব ক্ষেত্রে যা হয় আরকি, হামবুর্গে মেয়েটির
নামে অকথা-কুকথা রটতে লাগল। মেয়েটির পরিজনবর্গ সুরেশের
প্রাণনাশের চেষ্টা করতে লাগলেন৷ একে তো মেয়েটি সম্ভ্রান্ত, ধনী পরিবারের মেয়ে, তায়
পিতৃমাতৃহীন অর্থাৎ সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিনী, সুতরাং তাঁকে বিয়ে করতে হামবুর্গের
অনেকেই ব্যগ্র। কাজেই গোটা শহর যেন সুরেশকে সরিয়ে দিতে বধ্য পরিকর হয়ে উঠল।
১৮৮৫
সালে উম্বওয়েল সাহেবের বিখ্যাত গ্রেট লন্ডন মিনাজেরি জার্মানিতে তাঁবু ফেলেছিল। সুরেশ
তাদের দলে যোগ দিলেন এবং তাদের সাথেই জার্মানি ত্যাগ করে প্রথমে লন্ডনে ফিরলেন। তারপর,
এঁদের সাথেই ইউরোপ ত্যাগ করলেন। বস্তুত, লন্ডনও সুরেশের জন্য সুরক্ষিত ছিলনা। জার্মানির
ফেউ লন্ডনেও তাঁকে ধাওয়া করেছিল। ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়ে তিনি নিজের দলের সাথে মার্কিন
মুলুকে পারি জমালেন। জার্মান মেয়েটির সাথে প্রেম সেবারও পূর্ণতা পায়নি, এবারও পেলনা।
ঘর-বাঁধার স্বপ্ন এবারেও ছত্রখান৷
[১৪]
উম্বওয়েলের
দলেও প্রধান আকর্ষণ ছিলেন সুরেশ। আর সুরেশের সব থেকে বিখ্যাত কসরত ছিল সিংহের সাথে
কুস্তি; বিশেষ করে সিংহের মুখে নিজের মাথা ঢুকিয়ে দেওয়া। দর্শকরা এমন রুদ্ধশ্বাস ব্যাপার
হাঁ করে গিলতো। এমন নয় যে সুরেশ ছাড়া আর কোনো সার্কাসে অন্য কোনো ট্রেনার ছিলনা। কিন্তু
সুরেশের মতো দুঃসাহস তাদের কারই ছিলনা। বাঙালি সন্তানদের মধ্যে তিনিই প্রথম যিনি বাঘ
সিংহ ট্রেন করতেন, সার্কাসে তাদের খেলা দেখাতেন। নিউ ইয়র্ক থেকে ফিলাডেলফিয়া, ব্রুকলিন
থেকে শিকাগো, বোস্টন থেকে সেন্ট লুইস; সেখানেই তার দল যেত, সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে
তিনিই থাকতেন। তার নামেই পোষ্টার পড়তো শহর জুড়ে, বিজ্ঞাপনে, খবরের কাগজে তার ছবি বেরোত।
যাইহোক, আমেরিকা
থেকে সার্কাস দলের সাথে ঘুরতে ঘুরতে মেক্সিকো হয়ে তিনি প্রবেশ করলেন ব্রাজিলে ১৮৮৫
সালে। ধারণা করা হয়, এই প্রথম কোনও
বঙ্গসন্তান এ দেশের মাটিতে পা রাখলেন৷ । এখান থেকেই গল্প নেয় অভাবনীয়
মোড়।
ব্রাজিলে সুরেশ বিশ্বাসের সার্কাসের বিজ্ঞাপন
কালো-সাদা-মেটে
মানুষের দেশ ব্রাজিলে এসেও তিনি খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয়তা পেয়ে গেলেন৷ বাঘ সিংহের খেলা ছাড়াও আরেকটি বিষয়ে সুরেশের বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। খেলা
দেখানোর পর অবসর সময়ে তিনি নানা বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন। আগেই বলা হয়েছে, সার্কাস ও হিংস্রপশু
বশ করার ব্যস্ততার মাঝেও সুরেশ নিজের মতো করেই পড়াশোনাটা চালিয়ে গিয়েছিলেন। গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য, গণিত, রসায়ন এবং দর্শনশাস্ত্রে
তিনি বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। এরই সঙ্গে তিনি বেশ কয়েকটি ভাষাও রপ্ত করেছিলেন।
কাজেই কেবল ইংরেজি মাত্র নয়, সুরেশ যেখানেই যেতেন, সেখানকার স্থানীয় ভাষাতে বক্তৃতা
দিতেন। ইংরেজি ছাড়াও তিনি জার্মান, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, পর্তুগিজ, ইতালিয়ান, ড্যানিস
এবং ডাচ – এই সাতটি ভাষাতে অনর্গল কথা বলে যেতে পারতেন। এই
সকল বিষয়ে তিনি যে সাতিশয় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। সেই সময়ে ল্যাটিন আমেরিকার সর্বাধিক
প্রসিদ্ধ সংবাদ পত্র ‘লা ক্রনিকা’তে, তাঁর এই সকল বক্তৃতার বিশেষ
প্রশংসাও করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের
ডিগ্রি তাঁর ছিল না বটে, কিন্তু
সমস্ত বিষয়ে তাঁর মতো শিক্ষিত মানুষ কদাচিৎ দেখা যেত৷
নয়ামুলুকে
ভাষা আর সমস্যা হলো না। ব্রাজিলে এসেই দেশটাকে একেবারে ভালবেসে ফেললেন। আজন্ম ভবঘুরে সুরেশ এইবার একটু থিতু হওয়ার পরিকল্পনা করলেন, ঠিক করলেন বাকি জীবনটা এই সুন্দর দেশটাতেই কাটিয়ে যাবেন বাড়ি-ঘরদোর বানিয়ে। হয়তো সুরেশ নিজেও এই ভবঘুরে জীবন থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। সুযোগও এসে গেল। ঘটনাক্রমে ব্রাজিলের রয়াল জু-এর ডিরেক্টর-সুপারিন্টেনডেন্টের
পদ খালি পরেছিল। সুরেশের মতো পশুপ্রশিক্ষককে পেয়ে তাকেই নিযুক্ত করতে চাইলেন পশুশালার
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। অতএব, সুরেশ সার্কাস থেকে ইস্তফা দিয়ে পশুশালার সুপারিন্টেনডেন্ট
পরে আসীন হলেন।
[১৫]
ইংরেজিতে
একটা প্রবাদ আছে - “Nature abhors a vacuum”, প্রকৃতি নাকি
শূন্যতাকে পরিহার করে। প্রেমও কি তাই করে? হয়তো, তাই করে৷ নইলে ইউরোপ ত্যাগ
করে ঘুরতে ঘুরতে সুরেশচন্দ্র ব্রাজিলে এসে পৌঁছবেন কেন? তা
সুরেশের জীবনেও আবার প্রেম এল, এবার প্রায় ঝড়ের মতো।
একদিন
ঘটনাচক্রে ব্রাজিলের এক স্থানীয় সার্জেনের মেয়ে মারিয়া অগুস্তা
ফার্নান্ডেজ সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়ে গেল৷ এবং যাকে বলে
প্রথম দর্শনেই প্রেম৷ সুরেশ উচ্ছ্বসিত কিন্তু ব্রাজিল কন্যা খুবই সংযত৷ হিংস্র পশু তিনি
পোষ মানাতে পারেন৷ কিন্তু পাখি পোষ মানানোর বিদ্যাটা এখনও বুঝি রপ্ত হয়নি৷ ধরা দেব-দেব
করেও তিনি ধরা দিতে চান না— যদিও পথে-ঘাটে, গাড়িতে, নানা দোকানে, বন্ধুর বাড়িতে— সর্বত্র তাঁদের মেলামেশা
চলছিলই৷ রোমান্সের ব্যাপারে সাধারণত মেয়েরাই এগিয়ে থাকেন৷ এই কুমারী কিন্তু
গভীর এবং গম্ভীর৷ কিন্তু কৃত্রিম জলের বাঁধ আর কতদিন টিকে থাকবে? এত বাঘ-সিংহকে বশ করেছে যে অকুতোভয় হৃদয়, তিনি কি পরাজয় মেনে অন্তরালবর্তী হয়ে যাবেন?
মারিয়া অগুস্তা বিশ্বাস
অতএব
মেলামেশা দ্রুত বদলে যেতে লাগল বন্ধুত্বে, বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে ঘনিষ্ঠতায়৷ ব্রাজিলে পুরুষদের সঙ্গে অবাধে
মেলামেশা সেখানকার রমণীদের পক্ষে শোভন ছিল না— বাঁধভাঙ্গা স্রোতে সব সামাজিক নিয়ম
এলোমেলো হয়ে যেতে থাকল৷ পঞ্চশরের ক্রিয়া কখনও দেশ-বর্ণ-জাতির সীমা মেনেছে কি? শ্বেতবর্ণের
মারিয়া এসে সুরেশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন৷ সুরেশের কাছে বসে তাঁর বীরত্বের কাহিনি
শুনতে শুনতে মারিয়ার হৃদয় তরঙ্গায়িত হতো, গণ্ডদেশ ক্ষণে ক্ষণে রক্তবর্ণ ধারণ করত, চোখ ক্রমাগত বিস্ফারিত হত— একটা দিব্য জ্যোতিতে সমস্ত আনন প্রোজ্জ্বল হয়ে
হয়ে উঠত। মারিয়া যেন দেখতেন, পৃথিবীতে আর কিছুই নেই; কেবল দেশে বিদেশে আমাদের সুরেশচন্দ্র মহামহিমায়, সৌন্দর্য্যে, বীর্য্যে সর্বস্থানে শ্রেষ্ঠত্বের বিজয়মালিকা পরে
দেবমূর্তিতে চারিদিক আলো করে আছেন।
তিনিই অন্তরে, তিনিই বাইরে। সুরেশের প্রশংসা করতে ভাষায় অভাব হত বলে মারিয়া কেবল মুগ্ধ দৃষ্টিতে সুরেশের প্রতি চেয়ে থাকতেন ও দৃঢ় মুষ্টিতে সুরেশের করপেষণ করতেন। মারিয়া ভারতীয় বাঙালি সুরেশের বাহুবন্ধনে বাঁধা
পরলেন।
[১৬]
এমনই
কাটছিল দিন। একদিন কথায় কথায় মারিয়া একটা কৌতুকমিশ্রিত আবদার
করে বসলেন, “তোমাকে মিলিটারি পোশাকে কিন্তু দারুন মানাবে।” “বটে?”, সুরেশের কাছে সেই আবদার
যেন আদেশ হিসেবে প্রতিপন্ন হল। একটা তিলের জন্যে বাবর সমরখন্দ
বাজি রাখতে চেয়েছিলেন, আর এ তো
সামান্য একটা পোশাকের আবরণ৷ এই আবদারেই সুরেশচন্দ্রের জীবনে আবার পরিবর্তন এল।
তিনি সামরিক বিভাগে যোগদানের জন্য আবেদন করলেন৷ আবেদন
মঞ্জুর হল এবং ১৮৮৭ সালে তিনি ব্রাজিলের রাজকীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন৷ কিন্তু
এখানেও বাঁধা পরল। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার শর্ত ছিল তাঁকে তিনবছরের জন্য অবিচ্ছেদ্য
ভাবে সৈন্যের কর্তব্যে নিযুক্ত থাকতে বাধ্য থাকবেন। অর্থাৎ, তিনবছরের জন্য ডেসডিমনার
থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবেন সুরেশ। প্রেমের খাতিরে সুরেশ তাও মেনে নিলেন। সুন্দরীর সঙ্গে এ সময় তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল,
কিন্তু মনের তন্ত্রীতে প্রেমের সঙ্গীত নিত্য মূর্ছিত হত৷
সমপদস্থ
সৈনিকদের তুলনায় সুরেশ শিক্ষা, দীক্ষা সব দিক থেকেই অনেকাংশে উন্নত ছিলেন। সবদিক থেকেই
অন্যান্যদের থেকে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও খুব সহজে তাঁর পদোন্নতি হয়নি। তাঁর কারণ, ব্রাজিলের
চিরাচরিত বর্ণবিদ্বেষ। ১৮৮৭-তেই তিনি স্যান্টা ক্রুজে ছোট্ট সেনাদলের
নায়ক ‘কর্পোরাল’ পদে উন্নীত হলেন। কিছুকাল
পরে, স্যান্টা ক্রুজ থেকে তাঁকে নন-কমিশন্ড অফিসার হিসেবে বদলী করা হয় রিও-ডি-জেনেইরোর
এক সেনা হাসপাতালে। এখানে থাকাকালীন সুরেশ মন দিয়ে চিকিৎসাবিদ্যাও রপ্ত করেন, বিশেষ
করে সার্জারিতে তিনি পারদর্শি হয়ে ওঠেন। ক্রমে ১৮৮৯ সালে সেনাবাহিনীতে তাঁর ৩ বছরের
চুক্তিপত্রের মেয়াদ পূর্ণ হল। তিনি চাইলেই ইস্তফা দিয়ে নিজের পুর্ববর্তী সুখের চাকরতে ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়
সুরেশ সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করলেন না।
১৮৯১
সাল নাগাদ কর্পোরাল থেকে পদোন্নতি হয়ে সুরেশ ফার্স্ট সার্জেন্ট পদ লাভ করেন। এরপর বেশ
কয়েকবছর সুরেশ সুনামের সাথে নিজের কর্তব্য করে গেলেও তাঁর পদোন্নতি সম্ভাবনা ছিলনা।
কারণ একটাই, তাঁর চামড়ার রঙ কালো। এটা ঠিক যে এই সময়ে তাঁর পদমর্যাদার তুলনায় অনেক
বেশি দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল এবং তা তিনি খুব ভালো ভাবেই পালন করেছিলেন, কিন্তু
বর্ণবিদ্বেষের জন্যই তাঁর পদোন্নতি হচ্ছিলনা। লেফটেন্যান্ট হওয়ার পর সুরেশ নিজের কাকা
কৈলাশচন্দ্রকে লেখা একটা চিঠিতে ক্ষেদভরা অনুযোগ করেছিলেন,
“খুড়া মহাশয়! আমি এখন যে পদ লাভ করেছি, ভাবিবেন না, আমি ইহা সহজে
পাইয়াছি। আমি যে এদেশে সেনানীমধ্যে
একজন সেনাপতি হইব, ইহা আমি কখনও
ভাবি নেই। অনেক সময়েই আমার পদোন্নতির কথা উঠিয়াছে এবং প্রত্যেকবারেই আমার নাম
চাপা পড়িয়াছে, আমি বিদেশী বলে
আমার পদোন্নতিতে প্রত্যেক বারেই ব্যাঘাত ঘটিয়াছে।”
তবে
ইতিমধ্যে সুরেশের প্রেমিক জীবনের ইতি ঘটল। ১৮৯১ সালেই রিও শহরেই তিনি এবং ডেসডিমনা
বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। প্রায় ৩ বছর যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও উভয়ই যেন উভয়কে একদিনের
জন্যও ভোলেননি। এরই মধ্যে ডেসডিমনার কাছে অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের পুরুষের থেকেই বিবাহ
প্রস্তাব এসেছিল, কিন্তু তিনি তাঁর হৃদয়ে একমাত্র সুদূর ভারতবর্ষ থেকে আগত সেই বাঙালি
যুবকটিরই একমাত্র স্থান ছিল- যার দেশ কোথায় তিনি জানেন না, যার আত্মীয়স্বজন কেমন তিনি
জানেন না, যার ভাষাও তিনি জানেন না; এমন একজনকেই চিরজীবনের মতো নিজের হৃদয় আসনে বসিয়েছিলেন
মারিয়া।
মহাধুমধাম
করে দুজনের বিবাহ সম্পন্ন হল। রিও শহরের অনেক সম্ভ্রান্ত মানুষজন এই আনন্দোৎসবে যোগ
দিয়েছিলেন। অবশেষে সুরেশের জীবনে প্রেম পূর্ণতা পেল। বিবাহের ১ বছর পর, ১৮৯২ সালে তাদের
কোল আলো করে এক ফুটফুটে পুত্রসন্তানের আগমন ঘটে। সুরেশের নামেই মারিয়া তাঁর নাম রেখেছিলেন
‘সুরেশ জুনিয়র’।
[১৭]
১৮৯৩
সাল। ব্রাজিলের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক টালমাটাল পরিস্থিতি। ব্রাজিলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট
ফ্লোরিয়ানো পেহোতোর শাসনকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়ে ব্রাজিল নৌসেনার ১৩ জন জেনারেল
প্রেসিডেন্টকে এক চরম পত্র প্রেরণ করেন। তাদের দাবী, এই মুহুর্তেই প্রেসিডেন্ট পেহোতোকে
পদত্যাগ করতে হবে এবং ব্রাজিলে অবিলম্বে সাধারণত নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। পেহোতো সেই চরম পত্রের জবাব চরম ভাবেই দিয়েছিলেন।
প্রতিবাদী ১৩ জন জেনারেলকে তৎক্ষণাৎ বরখাস্ত করে গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রেফতারীতে অসন্তুষ্ট
নৌসেনা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। নৌসেনার অ্যাডমিরাল কাস্তোদিও হোসে দে
মেলো এবং অ্যাডমিরাল সালদানিয়া দা গামা এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
দেশ
জুড়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল। এক দিকে সরকার বিরোধী নৌসেনা অপর দিকে সরকার অনুগত
স্থলসেনা। দেশের প্রায় সমস্ত রণপোতে বিদ্রোহের পতাকা উড্ডীয়মান। ব্রাজিলের স্থলসেনার
থেকেও নৌসেনা সেইসময় অস্ত্রশস্ত্র, লোকবল ও বহরে অনেক উন্নত, নৌসেনার আধিকারিকগণও অনেক
বেশি দক্ষ। ফলস্বরূপ, প্রথম দিকে তাদেরই জয় হতে লাগল। বিদ্রোহী নৌসেনাগণ হুমকি দিলেন,
অবিলম্বে পেহোতোকে পদত্যাগ করতে হবে, নচেৎ রিও শহরে নৌসেনার রণতরী বোমাবর্ষন শুরু করবে।
ইতিমধ্যে
রিও ডি জেনেইরোর সেনাদুর্গে হুলুস্থুলু অবস্থা। যেনতেন করে হোক দুর্গ সুরক্ষিত করার
প্রয়াস শুরু হল। ওদিকে সরকার নৌসেনার সাথে আলাপ আলোচনা শুরু করল। কিন্তু, সরকার নৌসেনার
দাবী দাওয়া মানল না, উলটে তাদেরই কোর্টমার্শালের হুমকি দেয়। আলোচনা ভেস্তে যায়। ক্রুদ্ধ
নৌসেনাগন পূর্ণবলে রিও শহর আক্রমণ করে। নৌসেনার রণতরী আকিদাবা, তামান্দারে, রিপাবলিকা,
ত্রাহানো প্রভৃতি ২০টি জাহাজ থেকে রিও দুর্গের উপর গোলাবর্ষণ শুরু হয়।
দুর্গের
সেনারাও তাঁর যথাযোগ্য প্রত্যুত্তর দেয়। প্রত্যেক দুর্গের
প্রত্যেক কামান অনর্গল গোলা উদগীরণ
করতে থাকল। একদিকে রণপোতের বজ্রনাদ
গোলাসমুহ রিও শহরের ঘরবাড়ি
অট্টালিকাদি চূর্ণ বিচূর্ণ করছিল, অন্যদিকে
দুর্গস্থ গোলারাশিও সমুদ্রকে আলোড়িত করে তুলছিল। সুরেশ তখন রিওতে সেনার ফার্স্ট সার্জেন্ট পদে কর্মরত। যুদ্ধে একদল সেনা
পরিচালনা করার ভার তাঁর উপর বর্তালো। সেনাপতির অধীনে থেকে সুরেশ ও তাঁর ব্যাটালিয়ন
বিশেষ দক্ষতার সাথে নৌসেনার হামলার প্রতিরোধ করছিলেন। বিদ্রোহীদের
বিরুদ্ধে বদলা নিতে পাল্টা সাঁড়াশি আক্রমণ চালায় ব্রাজিলীয় সৈন্যদল। কেউ কাউকে এক
ইঞ্চি জবাব দিতেও পরোয়া করছে না৷ এককথায় টালমাটাল অবস্থা। বিদ্রোহী থেকে ব্রাজিলীয় সৈন্যদল সকলে নাজেহাল হয়ে
পড়ে।
এখানে
নৌসেনা একটা ভুল করেছিল। তারা ভেবেছিল স্থলসেনার যেরকম অবস্থা, তাতে তাদের কে হারানো
স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু প্রতিপক্ষকে কখনই কম ভাবতে নেই। স্থলসেনার প্রতিরোধে নৌসেনা
কিছুতেই রিও শহর অধিকার করতে পারছিলনা। বিদ্রোহীরা ততক্ষণে
বুঝে গেছে, এভাবে সম্ভব নয়। তারা নিজেদের পরিকল্পনা বদলে রিও আক্রমণ তখনকার মতো স্থগিত রাখল। রিও
থেকে তারা এবার মনযোগ দিল রিওর অদূরেই ছোট্ট এক শহর নিতেরয়ের দিকে।
[১৮]
রিওর
যুদ্ধে সুরেশের রণদক্ষতা ও সাহস সকলের নজর কাড়ে। আর এই দক্ষতার আধারেই এবার সুরেশের
পদন্নতি ঘটেছিল। ১৮৯৩ সালে, ফার্স্ট সার্জেন্ট হওয়ার প্রায় ৩ বছর পর ব্রিগেডিয়ার পদে সুরেশের পদাভিষেক ঘটে।
রিও
অধিকার করতে না পেরে নৌসেনা ফেব্রুয়ারি মাসে, অ্যাডমিরাল দা গামার নেতৃত্বে নিতেরয়
আক্রমণ করে বসে। কিন্তু স্থলসেনা নিদ্রিত ছিলন না, তাৱা সর্বদাই সতর্ক থেকে দেশরক্ষা করতে প্রস্তুত ছিলেন। নৌসেনার জাহাজ নিতেরয়-এ
গোলাবর্ষণ করে শহরের স্যান্টা ক্রুজ, লাজেস ইত্যাদি ৭টি দুর্গ এবং সরকারপক্ষীয় সেনার
২০টি ম্যান অফ ওয়ার জাহাজ গুড়িয়ে দেয়। তাও সুরেশ কিম্বা স্থলসেনার মনোবলে একটুকুও চীড়
ধরেনি। এছাড়াও, উভয় পক্ষের সৈন্যই স্থানে স্থানে মুখোমুখি
যুদ্ধ করহিল, কিন্তু কোন পক্ষই জয়ী
বা পরাভূত হয়নি।
এই শহর
রক্ষার্থে লেফটেন্যান্ট সুরেশ সদলে
উপস্থিত ছিলেন। অবশ্য, যখন নগরে
গোলাবর্ষণ হচ্ছিল, তখন তিনি ও তাঁর সেনাদল বিশেষ কিছু করতে পারেনি, কারণ তাঁর সেনাদলের তখনও
একমাত্র কাজ ছিল কামান থেকে গোলা ছোঁড়া এবং সেই গোলা যাতে সঠিক লক্ষ্যে নৌসেনার জাহাজগুলিতে আঘাত করে সে দিকে নজর
রাখা। হাতাতি সম্মুখ যুদ্ধ না হলে সুরেশ নিজের সাহস ও দক্ষতা কিছুই দেখাতে পারছিলেন না। তবে, শীঘ্রই সেই সুযোগ এল।
এক,
দুই করে ক্রমে ছ ঘণ্টা কেটে গেল, কিন্তু নৌসেনার গোলাবর্ষণে কোনো খামতি নেই। ক্রমে
দিনের আলো ফুরিয়ে এল। চারিদিকে অন্ধকার। গোলাগুলির ধোঁয়া যেন সেই অন্ধকারকে আরও গাঢ়
করে তুলেছে। নিতেরয় শহর তখন কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। স্থলসেনাকে একেবারে শেষ
ধাক্কা দেওয়ার জন্য বিদ্রোহীরা স্থির করল নিতেরয় শহরে সেনা নামানো হবে। বিদ্রোহীরা তখন সমুদ্রের তীরে
বিপুল সংখ্যক সেনা নামিয়ে শহরের পেছনদিক থেকে সুরেশ ও তাঁর বাহিনীকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা
করল।
এইবার
সুরেশের বাহিনীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। একে ঘোর রাত্রি, কে শত্রু কে মিত্র সেটা নির্নয়
করাই দুরুহ; তার উপর সামনের থেকে জাহাজের গোলাবর্ষণ আর পেছনের থেকে শত্রুসেনার গুলিবর্ষণ-
এই ত্র্যহস্পর্শে সুরেশের বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে উঠল। তিন
ঘণ্টা ধরে এই রূপ তুমুল সংগ্রাম
চলল। উভয় পক্ষেই শতশত হত ও আহত।
বিদ্রোহী সেনাগণ ক্ষিপ্তের ন্যায় সুরেশের বাহিনীকে এমনভাবে আক্রমণ করছিল যে, পালটা আঘাত দুরের
কথা, তাদের
প্রাণ রক্ষাই দুষ্কর হয়ে উঠছিল। আক্রমণের তীব্রতা এমনই ছিল
যে সুরেশের বাহিনীর মাত্র ৫০ জন শেষ অবধি জীবিত ছিলেন।
বিদ্রোহীগণ
ততক্ষণে নগরের এক দিক অধিকার করে নিয়েছিল। তাদেরকে সেখান থেকে না সরালে নিতেরয়
শহরকে রক্ষার আর কোন আশাই নেই। যুদ্ধজয়ে সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে
সুরেশের বাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিজের সৈনিকদলের মধ্য
থেকে কেউ যদি এই অসমসাহসিক, দুরুহ কাজ করতে প্রস্তুত থাকে তার জন্য আহ্বান করলেন। এদিকে লোকবলও
কম। কেবল মাত্র ৫০ জন সৈন্য নিয়ে কেউ
এই মরণকুপে ঝাঁপ দেবেন কিনা; এটাই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।
সুরেশ
এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। ব্রাজিলকে তিনি নিজের মাতৃভুমি ভারতের মতোই ভালবাসতেন। ব্রাজিলকে
রক্ষা করতে তিনি যেকোনো দুঃসাধ্য কাজ করতে পারেন। মাত্র ৫০ জন সেনাকে সঙ্গে করেই তিনি
অসাধ্যসাধনের পণ করলেন।
[১৯]
ঘোর
অন্ধকার রাত্রি, মেঘের আড়ালে চন্দ্রমা
ক্রমেই মলিন হয়ে আসছেন, এই সময়ে ওই ৫০ জন সাহসী বীর নিয়ে সুরেশ ভগ্নাবশেষ নিতেরয় শহর থেকে বেড়িয়ে, যেখানে বিদ্রোহী সেনাগণ
অবস্থিত ছিল, সেই দিকে বিপুল
বিক্রমে আক্রমণ করলেন। অন্ধকারে শত্রুপক্ষীর সেনারা তাকে জিজ্ঞাসা করল “কে তোমরা?” সুরেশ বীরদর্পে উত্তয় দিলেন, “আমরা ব্রাজিলিয় গণতন্ত্রের
সেনা।” “আত্মসমর্পন কর নয় মর।” এই বলে বিদ্রোহীরা গর্জন করে উঠল।
সুরেশ
তখন সদর্পে উত্তর করলেন, “গণতন্ত্রের সেনা আত্মসমর্পণ কাকে বলে তা জানে না” এবং নিজের সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হয়ে নিজের টুপি ঘোরাতে
ঘোরাতে তাদেরকে মার্চ করার হুকুম দিয়ে ক্ষিপ্ত সিংহের নায় শত্রুগণকে বিপুল বিক্রমে আক্রমণ করলেন। কিন্তু বিদ্রোহীরা এমন ভীষণ ভাবে গুলি চালাতে লাগল, সুরেশের বাহিনী সেই আক্রমণের সামনে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে পরল। তারা এগোতে সাহস পাচ্ছিলনা, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তারা যখন পালানোর উপক্রম করল, তখন সুরেশ
রোষকষায়িতনয়নে নিজ সৈনিকদের প্রতি তীব্র দৃষ্টিপাত করে যুদ্ধের সেই মহাঘোর কলরবের উপর অভ্রভেদী স্বরে ঘোষণা
করলেন, “কমরেড, শত্রুগণের বন্দুক আমাদের
উপর অগ্নিবর্ষণ করা শুরু করেছে। তোমরাও তাদের বুঝিয়ে দাও যে, ব্রাজিলের বীরপুত্ররা মরতে ভয় পায়না, মারতেও ভয় পায়না।
আর তোমরাও দেখো, পবিত্র ভারতভুমির এই সন্তান কেমন করে এই সকল কামানকে এক লহমায় খান খান করে দেয়, প্রস্তুত হও।”
এই
এক ঘোষণাতেই কাজ হল। সুরেশের দীপ্ত কণ্ঠ যেন তাঁর বাহিনীকে নতুন ভাবে উদ্দিপীত করে
তুলল। তারপর সুরেশ উচ্চৈঃস্বরে অনুচরবর্গকে আদেশ করলেন, “চার্জ।” এবং স্বয়ং শত্রুদল মধ্যে
ভীমবেগে প্রবেশ করলেন। এখন সুরেশ আর একা নন, তাঁর ছোট্ট বাহিনীও সঙ্গে সঙ্গে এমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে হামলা করল যে, বিদ্রোহীরা সেই আক্রমণ বেগ সহ্য করতে পারল না। এই
দুর্ব্বার গতিতে সুরেশ ও তার ৫০ সেনার বাহিনী শত্রুদেরকে ছিন্নভিন্ন
করতে করতে এগোতে লাগলেন। সুরেশের বাহিনীর বিক্রম বালাক্লাভার যুদ্ধে ব্রিটিশ লাইট ক্যাভালরির
আক্রমণকে স্মরণ করাচ্ছিল। এদিকে হামলার তীব্রতায়
শত্রুগণ তখন ধীরে ধীরে পেছোতে লাগল,
কিন্তু সুরেশ ও তাঁর অনুচর সৈন্যদল অমিততেজে বীর বিক্রমে
যুদ্ধ করে যেতে লাগলেন। সুরেশ বাহিনীর তীব্রতায় সিংহভাগ শত্রু মারা পরল, কিছু কিছু পালিয়ে গেল আর
কিছু বন্দি হল। সুরেশ গোলন্দাজদের নিজের নিজের স্থানেতেই
বর্ষা ও তরবারির আঘাতে বিনাশ করলেন।
হত্যাকাণ্ডও অতি ভীষণ হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু প্রায় সারাদিনের সেই
যুদ্ধে সুরেশের সেনাদলই জয়লাভ করল। নিতেরয় শহরকে
সুরেশের বাহিনী এভাবেই পুনরুদ্ধার করলেন।
সারাদিনের
এই ক্লেশ ও পরিশ্রমের পর সন্ধ্যাবেলায় সুরেশ দশজন বিদ্রোহীকে বন্দী করে সহিত শিবিরে ফিরলেন। শিবিরে তখন আহতদের পরিচর্যা চলছে। সুরেশ তখন কিছুক্ষণ বায়ুসেবনের জন্য শহরে বের হলেন। এইভাবে একাকী বেড়াচ্ছেন, হঠাৎ এক মহিলার সাথে তার সাক্ষাৎ হল, পরনে ভদ্রস্থ বেশ ভুষা, মহিলাটিও
সম্ভবত ভদ্রঘরেরই। মহিলা সম্ভবত তার কোনো নিখোঁজ কিম্বা মৃত আত্মীয়ের সন্ধান করছিলেন।
মৃত ব্যক্তিদের কোথায় রাখা হয়েছে, এটাই তার জিজ্ঞাস্য। সুরেশ তাকে নিজের শিবিরের কাছেই
এক গোরস্থানে নিয়ে
গেলেন। সহসা দুই জন বিদ্রোহী নৌসেনা উন্মুক্ত তরবারী হাতে তাঁকে আক্রমণ করল। সুরেশ মুহূর্তমধ্যে কোষ থেকে অসি নিষ্কাসিত করে তাদেরকে
আক্রমণ করলেন, তাঁর সাথে যুদ্ধ সামান্য ব্যাপার নয় বুঝে দুজনই একসময় চম্পট দিল। সেই মহিলাও যেন কোথায় গা ঢাকা দিলেন। ওই ভদ্রমহিলা কী শত্রুপক্ষীয়? কে জানে।
নিস্তব্ধ
রাত্রীতে সেই শত্রুপূর্ণ স্থানে ঘুরে বেড়ানো
বিপজ্জনক ভেবে তিনি দ্রুত পায়ে নিজের শিবিরের দিকে ফিরতে চাইলেন। কিন্তু, যুদ্ধের ক্লেশেই
হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, তার শরীর অবসন্ন হতে লাগল। এক
পাও চলতে না পেরে অগত্যা নিজেকে সামলাতে তিনি একটা পাথরের উপর বসে পড়লেন। সুরেশ লিখছেন,
“আমিও তৎক্ষণাৎ স্বস্থানে প্রত্যাগমন মানসে ফিরিবার কালে
স্থানীয় দুর্গন্ধে কষ্টবোধ হইল এবং বিশ পঞ্চাশ হাত যাইতে না যাইতে আমার মস্তক এমন
ঘুরিয়া গেল যে, উপায়ান্তর না
দেখিয়া নিকটস্থিত একখণ্ড প্রস্তরোপরি বসিয়া পড়িলাম এবং স্বতঃই নিজ অবস্থার
বিষয় আলোচনা করিতে লাগিলাম। চারি দিক অন্ধকার দেখিলাম এবং পায়ে ঠাণ্ডা অনুভব
করিলাম। সেই ঠাণ্ডা ক্রমে জানু ও ঊরু বহিয়া বুক পর্য্যন্ত উঠিল। অনন্তর ঠিক
সেইরূপ শৈত্য কর্ণে অনুভূত হইয়া গণ্ডদেশ বাহিয়া বুকে আসিয়া থামিল আর আমি
সংজ্ঞাহীন হইলাম।”
টানা
তিন দিন সুরেশ অচৈতন্য থাকেন। সুরেশের জবানিতে, “তিন দিবস
পরে আমার জ্ঞান হইল। দুই জন অপরিচিত ব্যক্তি কর্তৃক অর্দ্ধ উলাঙ্গাবস্থায় আমি
হাসপাতালে নীত হই। অষ্টাহ পরে কথা কহিতে পারিলে স্বস্থানে আসিবার ইচ্ছা প্রকাশ
করিলাম ও যথাস্থানে ফিরিয়া আসিলাম। সকলে মনে করিয়াছিল যে, আমি হারাইয়া গিয়াছিলাম।”
সুরেশ
নিতেরয়ের অভিযানে ৮ দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। হাসপাতালে তিনি এমন অবস্থায় ছিলেন যে স্থানীয়
ডাক্তাররা তাকে চিনতেই পারেনি। এদিকে কোনো খোঁজ না পাওয়ার জন্য তার বাহিনীর লোকজন তাকে
মৃত ঘোষণা করে। এমনকি, অনেকে তার স্ত্রী মারিয়াকে শোকপ্রশমনের সহানুভুতি পত্রও লিখেছিলেন।
৮ দিন পর যখন তার খোঁজ পাওয়া গেল, তখন তার আত্মীয়, বন্ধু, বান্ধব, পরিবারের আনন্দের
সীমা ছিলনা।
[২০]
নিতেরয়
ও রিওর যুদ্ধে অসীম বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য ১৮৯৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সুরেশের পদোন্নতি
হয়। ব্রিগেডিয়ার থেকে এবার তিনি লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দেন। সুরেশের নিজের জবানিতে,
“সম্প্রতি দেশে বিপ্লব উপস্থিত হইয়াছে, আমি ও আমার সমপদস্থগণ একজন সেনাপতির অধীনস্থ
হইয়াছি। ইনি আমাকে চিনিতেন না, কিন্তু
ইনি ন্যায়বান ব্যক্তি, লোকের গুণ
গ্রহণে সঙ্কুচিত নহেন। আমি কোন
দেশবাসী, আমি কে, ইনি তা একবারও দেখেন নাই। যুদ্ধক্ষেত্রে ইনি আমার সাহস ও দক্ষতা দেখিয়া প্রীত হইয়া আমার
পদোন্নতির জন্য রাজপুরুষদিগকে লিখিয়াছিলেন, তাতেই আমার এই পদোন্নতি ঘটিয়াছে। তিনি আমার সম্বন্ধে এ দেশের মার্শাল
ভাইস প্রেসিডেণ্টকে বিশেষরূপে লিখিয়াছিলেন, তাতেই আমি লেফ্টানেণ্টের পদলাভ করিয়াছি।”
রিও শহরের স্থানীয় সংবাদপত্রে
সুরেশ বিশ্বাসের জীবনাবসানের খবর
এরই
মধ্যে সুরেশ ও মারিয়ার আরও ৫ সন্তান জন্মলাভ করে – হোর্হে ক্লিভল্যান্ড, লুইজ মেরোড্যাক,
ক্ল্যারিস, হার্মিস এবং স্টেলা। ১৯০৫ সালের ২৬শে জুন আরও একবার পদোন্নতি হয়ে সুরেশ
‘কাপিতাও’ বা ক্যাপ্টেন পদাভিষিক্ত হন। তবে এই সম্মান বেশিদিন ভোগ করে যেতে পারেননি
সুরেশ। ১৯০৫ এরই ২২শে সেপ্টেম্বর রিও শহরেই মাত্র ৪৪ বছর বয়সে নিজের বাসভবনে মৃত্যু
ঘটে এই বঙ্গবীরের। সাও হোয়াও বাপ্তিস্তা সিমেট্রিতে তাকে সমাধিস্ত করা হয়। সেই সমাধি অবশ্য এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। শোনা যায়, শ্বেতাঙ্গরা বিদ্বেষের বশে ১৯১১ সালে তাঁর
সমাধি ধ্বংস করেছিলেন। কিন্তু কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের বিচিত্র জীবনকাহিনি মুছে
ফেলতে পারেননি।
ঊনবিংশ
শতকের বাংলা তথা সমগ্র ভারতের বুকে সাহসিকতার লেলিহান অগ্নিশিখা জ্বেলে দিয়েছিলেন
এই বীর বাঙালি সন্তান সুরেশ বিশ্বাস। নদিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম নাথপুর থেকে
ব্রাজিল– পথটা সহজ ছিল না। কিন্তু তারপরেও তাঁকে অবলীলায় অতিক্রম করেন এই
অগ্নিপুরুষ। আত্মবিস্মৃতিতে জর্জরিত বাঙালি কি এই বীরত্বের কাহিনি মনে রেখেছে? সুরেশ বিশ্বাসের জীবনীকার শ্রী উপেন্দ্রকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়,
“…এক জন কপর্দ্দক শুন্য নিতান্ত নিঃসম্বল বঙ্গবাসী,
যাঁহার পরিধানে দ্বিতীয় বস্ত্রমাত্র ছিল না—বিদেশে অপরিচিত
মণ্ডলীর মধ্যে আপন অসাধারণ ক্ষমতাগুণে কিরূপে সৈনিক জীবনে গণ্যমান্য হইয়াছেন, যাঁহার অপূর্ব্ব বীরত্বে ব্রেজিলবাসী
মুগ্ধ—শৌর্য্যবীর্য্যে যিনি জগতের বীরেন্দ্র সমাজের বরণীয়;—যাঁহার কার্য্যে মেকলে প্রমুখ বাঙালীবিদ্বেষীর
বাঙালীর ভীরুতাপবাদ অমূলক অতীত কাহিনীর মধ্যে দাঁড়াইয়াছে। টাইম্সের ন্যায়
রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের মুখপত্রও যাঁহার উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন,—যে দেশে একই সময়ে সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস, জগদীশ বসু ও অতুলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মিতে
পারে, সে জাতিকে অবজ্ঞা করা যাইতে
পারে না।”
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন