লোকে
বলে,
বিষয় না বিষ। জায়গা জমি। জায়গা মানে যায়েগা। যেমন আসে তেমনি
যায়। ধরে রাখতে পারে না কেউ। যখন আসে মিঠে পানি নোনা পানি এক হয়ে যায়। যখন যায়
মিঠে পানিও নোনা হয়ে বেরিয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে মিল্লাতের।
- কি হলো রে? অত পেছিয়ে পড়লে পাই তুলবি কখন? অবশিষ্ট তলা গোছা সামনে ছুড়ে দিয়ে বলে নিতাই।
মিল্লাত
অসহায়ের মতো না বাঁদিকে তাকালে। পাশের দুজন তাকে মাঝে গলি রেখে বেরিয়ে যাচ্ছে। আবারো
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক ঠেলে। সকলেই যেন তাকে চারপাশ থেকে ফেলে এগিয়ে
যাচ্ছে। এই কিছুদিন সে অনুভব করেছে ব্যাপারখানা। যে বউয়ের জন্য সে নিজের ভাইদের
ছেড়েছে। বিষয়-সম্পত্তি তিল তিল ভাগ করেছে। দেবতুল্য দাদাকে বেইমান সাজিয়ে লোকের
চোখে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে। সেই বউ তাকেই এখন দেখতে পারে না। ছেলের
চোখ রাঙানি সহ্য করতে হয় পেটের দায়ে।
মন চলে যায় কয়েক বছর পিছিয়ে। নিজের ভাগের বিঘে তিনেক জমি। পাকা সোনার মতো ধান উঠতো তার গোলায়। কয়েক মাসের চিন্তা থাকতো না। সোনামুগের চাষ করতো জাঁকিয়ে। ডাল-ভাতের অভাব হতো না। মেজো ছেলে টা তখন হাসিনার পেটে। মাঝরাতে সেদিন প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল বৌটা। দাইমার ফুঁকো ভরসায় রাত কেটে দুপুর গড়িয়েছিল। বউটার কষ্টে নিজেও জখম হচ্ছিল সে বারবার। শেষমেষ হাসপাতালে দিতে হল কষ্টের নিষ্পত্তির জন্য। টাকা লেগেছিল কয়েক কিস্তি, আর সেই জন্যই হাত পাততে হয়েছিল মোল্লাজানের কাছে। মোল্লাজান হাসিমুখে দিয়েছিল বউকে বাঁচানোর টাকা। দিন কয়েক পর সোনার ছেলে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল বউ। কিন্তু মিল্লাতের চোখে এবার অমাবস্যার অন্ধকার ।
কয়েকদিন পর মোল্লাজান বাড়িতে হাজির হলো।
- তা দিও। তাতে যেমন আপত্তি নেই। তবে হিসেব রেখো বাপু। টাকাটা তো বাড়ছে বই কমছে না। শোধ দেবার সময় যেন কান্নাকাটি না হয়। কথায় বলে টাকার মুখ বাঁকা। নেবার সময় যে হাত চিৎ হয় । সে হাত আবার উপুড় হতে বড় বিপত্তি ঘটায়।
- সে তোমাকে ভাবতে হবে না মিয়া। তুমি কি হিসেবে বেশি লিখে রাখবে?
উদাসী দিনগুলো কেমন ছটফটিয়ে এগিয়ে যায়। কয়েকটা মাস পেরিয়ে হিসেবের খাতা নতুন বছরের পা দেয়। মিয়া জোর করে তাগাদা দেয়। বার কয়েক এসে ছোট বড় কথা শুনিয়ে গেল। তাতে অবশ্য কিছু মনে করেনি মিল্লাত। পাওনাদার অনেক কথাই বলে ওসব কথা নাকি কানে ঢোকাতে নেই। কিন্তু হিসেবের খাতা দেখে সেদিন চোখ দুটো তার দিনের আলোতেই অন্ধকার ঠেকেছিল। কানে যেন গরম শীশে ঢেলে দিয়েছিল কেউ।
- তোমার কাছে তো পাঁচ কিস্তিতে চোদ্দশো টাকা নিয়েছি গো মিয়া। তিন হাজার পেরিয়ে আবার অতগুলো টাকা কি করে হলো? কত ধরো? মানে কত করে ধরেছ?
- সকলের থেকে তোর কাছে কমই নিয়েছি। কুড়ি টাকা করে। তোর তো তেরো মাসে পড়লো। বারো মাসের হিসাব হচ্ছে গিয়ে তিন হাজার দুশো আশি টাকা। আমি বলি কি? তুই এক কাজ কর। তোর যা অবস্থা তুই এখন শোধ দিতে পারবি না। শুধু শুধু মাস গেলে টাকার বোঝা বাড়বে। তার থেকে তোর ওই বনঢিপিতলার জমিটা আমায় দে। কিছু টাকাও পেয়ে যাবি।
- না, না মিয়া! ওটুকুই তো সম্বল। ছেলেপুলে নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে তাহলে। দু চোখের পাতা ভারি হয় মিল্লাতের।
- অথচ এক সময় এই দেনার দায়ে জমিখান দিতেই হলো মিল্লাতকে মিয়ার হাতে তুলে। এখন চাষী থেকে সেই জমিতেই চাষা মিল্লাত।
অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখেছিল শুধু মিল্লাত। কোন জবাব দেয়নি কথার। তার এখন ভাটার টান। নোংরা ময়লা তার বুকের উপর দিয়েই যাবে। প্রতিবাদের ভাষা তার বুক থেকে কিছুদিন আগেই শেষ হয়ে গেছে। অথচ একটা সময় গেছে, যখন অন্যায় পথকে ন্যায় বলে ঝাঁপিয়ে প্রতিবাদ করত নিজেদের দাদার উপর। চেঁচিয়ে লোকজন জড়ো করতো। চিৎকার চেঁচামেচি লোক জড়োর ভয়েই দাদারাও মিল্লাতকে অনেক ভাগের জিনিস ছেড়ে দিত। এরকম পাওয়াতেই মিল্লাতের নেশা ধরেছিল যেন। সেবার যখন পুরাতন বাড়ি থেকে ভেঙে চুরে হলদিবাড়ির ডাঙ্গাতে নতুন চালা বেঁধে উঠে এল, পুরাতন বাড়ির গুদাম ঘরে পিতল কাঁসার জিনিসগুলো সবই নিয়ে এসেছিল।
কেউ প্রতিবাদ করতেই পারেনি। আসলে কেউ প্রতিবাদ করে নি। পুরাতন দু’কামরা টিনের বাড়ি ভাঙার সময় টিনের অংশ একটু বেশিই খুলে নিলে। কিছুই বলল না কেউ। যদিও মিল্লাতের ভাইপো কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাই ওর দাদাই তাকে ধমকে দিয়েছিল।
ঠিক হয়েছেও তাই। দাদাদের সত্যিই কমেনি, অথচ মিল্লাতের সেই চোখে দেখা পাহাড় আজ ক্রমশ মরুভূমি হতে চলেছে।
নতুন পাই ধরে এক আঁটি শেষ করে বিড়ি ধরায় মিল্লাত। পশ্চিমে সূর্য কিছু পরেই ডুব দেবে।
তুই আবার নতুন করে পাই ধরলি কেন? আমাদের এতেই তলা শেষ হতো। ওই আঁটি দুটো পেছিয়ে দে। বাদল মিয়া এ যাত্রা রেহাই দিলে কাজে।
রাতে চুপচাপ শুয়ে ছিল মিল্লাত। পাশে বউ। সে এখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। বড় ছেলে মোবিন নেশা করে বাড়ি এসেছিল আজ। তাই নিয়ে বাপ - ছেলে এক প্রস্থ হয়েছে সন্ধ্যে রাতে। ঘটনা বেশি দূর এগোয়নি। মিল্লাত ভাঁটার টের পায়। সে জানে এ তার দাদা নয়। তারই জন্ম দেওয়া ছেলে। নিজের মন মানসিকতায় তৈরি তার যোগ্য সন্তান।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে মিল্লাতের। ছবিগুলো মনের পর্দা দিয়ে আস্তে আস্তে সরে সরে যায়। সংসারে লোক বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় যোগান কমেছে ততোধিক। সকলের পেট ভরাতে মাথার চুল ছিঁড়তে হয়েছে বারে বারে। তাই, এই ক’বছরেই তার জমিগুলো মোল্লা জানের মুঠো ভরিয়েছে। যারা তখন কতো সহযোগিতা করেছে তারা এখন চিনতেই পারেনা। বউয়ের শুকনো ডাঁটে মনটা তিতো হয় তার। প্রতিবাদ করতে ভয় হয় মনে।
মিল্লাত এখন নখদন্ত্হীন সিংহ মাত্র। গর্জে ওঠার দম বুকে জমেনি আর। তবুও চেষ্টা করে। সেদিন মাঝরাতে গর্জে উঠেছিল বউয়ের প্রতি। বাড়িছাড়া করেছিল দুদিনের জন্য। প্রতিবাদী ছেলের ঘুসিতে কষ বেয়ে রক্ত ঝরেছিল একটু। বাকিটুকু মোল্লাজানের জিম্মায় দিয়ে পথে বসাবে ভেবেছিল মিল্লাত।। কিন্তু পাশের বাড়ির হায়দার আলীর মধ্যস্থতায় বাড়িতে ঠাই দিয়েছিল বউকে। তবে ছেলের নামে ঘাড় হেলেনি।
যাদের কথাতেই আমি আজ পথের ভিখিরি। বাঁধা ঘর ভেঙে এনে এই বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। মাথায় - মাথায় ঠেকে গেলেও ভাইদের সঙ্গে কথা বলতে পারিনি।
- তার জন্য তো তুমি দায়ী। বউয়ের কথা শুনলে কেন? হায়দারের জবাব।
সবকিছুরই এক সময় যেমন সমাধান হয়, তেমনি মিল্লাতের ছেলে বাড়ি ফিরেছিল একসময়। বাপের পায়ে হাত রেখে ক্ষমা চেয়েছিল। ভালোভাবে চলার শপথ নিয়েছিল বাপের সামনে। আস্তে আস্তে উঠে বসে মিল্লাত। সব কিছুর মতো ঘুমও তার থেকে আজ সরে বসেছে যেন। বিড়িটা মুখে নিয়ে দেশলাই গেলে আগুন দিলে তাতে। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে সামনেটা অন্ধকার করলে। এই মুহূর্তে জীবনটা ওর কাছে তেতো মনে হচ্ছে। ছেলের কথাটা বারে বারে কানে বাজছে।
- কি রেখেছো আমাদের জন্যে? এরপর তো মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও থাকবে না।
বউয়ের অভিযোগের কথা মনে আনতে চায় না মিল্লাত। নারীর মন চেনা কত দুষ্কর! সে হাড়ে হাড়ে চিনছে এখন। দিন যায়। রাত যায়। পৃথিবীর বয়স বাড়ে। এক একটা দিন পৃথিবীতে কত পরিবর্তন আনে। মিল্লাতের দিনগুলো অন্ধের দিন- রাতের মতোই কাটে। এখন অপেক্ষায় থাকে মিল্লাত কবরের সাড়ে তিন হাত জমির জন্য।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন