আশির দশকের এক সকাল। রাস্তা দিয়ে হেঁটে স্কুলে চলেছে বাপী আর পলাশ। মাটির রাস্তা, মাঘ মাস, তাই বর্ষার কাদা শুকিয়ে শক্ত হয়ে তারপর গুঁড়ো ধুলোয় রূপান্তরিত হয়েছে। দুজনেরই খালি পা, কাঁধে কাপড়ের সাইড ব্যাগ। তাতে কিশলয়, সহজ পাঠ, নব গণিত মুকুল আর শ্লেট পেন্সিল। উভয়েই কাষ্ঠদহি শীতলামাতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। একটা করে আমুল দুধের কৌটো বগলদাবা করে চলেছে। ওতে আছে মুড়ি, ছোলা ভাজা, একটু এখো গুড়, একটা কাঁচালঙ্কা। টিফিনের সময় স্কুল গ্রাউন্ডের টিউবওয়েল থেকে জল ভরে নিলেই তাড়াতাড়ি খাওয়ার সুবিধে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলে খেলার জন্য সময় বেশি পাওয়া যায়।
জেঠাতো কাকাতো দুই ভাই মিলে দু’পায়ে ধুলো উড়িয়ে চলছিল, উড়ন্ত ধুলোর কিছু সামনের দিকে, কিছু তাদের মাথার ওপরেও এসে পড়ছিল, চুলে একটা ধূসর আস্তরণ তৈরি করছিল, কিন্তু সেদিকে ওদের ভ্রূক্ষেপ নেই।
হঠাৎ ধুলোর মধ্যে একটা চকচকে জিনিস দেখতে পেয়ে নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিল পলাশ। একটা সিকি, মানে চার আনা। আশেপাশে আরো পয়সা পড়ে থাকতে পারে এরকম একটা ধারণা নিয়ে দুজনে রাস্তার মাঝের ওই জায়গার সমস্ত ধুলো ওড়াতে শুরু করল।
বাপী বললে – আচ্ছা, যদি এখন একটা একশো ট্যাকার নোট কুড়িয়ে পাস, কি করবি?
পলাশ এরকম আকাশকুসুম কল্পনা কোনদিন করেনি, তবু ধুলো সরানোর কাজ চালু রেখে বললে – আমি একটা মোটর সাইকেল কিনব, রাজদূত। কেমন আওয়াজ দেখেছিস! বড় হয়ে চালাবো।
- আমি পেলে, একটা সিনেমা হল করব, নিজের হল। যত্ত খুশি সিনেমা দেখো, ধর্মেন্দ্রের, বচ্চনের, কেউ বলার নেই!
- তাহলে আমি একটা ট্যাক্সি কিনব, যেখেনে খুশি যাও, কেউ বলার নেই। এবার মত পরিবর্তন করলে পলাশ।
- আমি একটা বাস কিনব, আরামবাগ থেকে তারকেশ্বর চলবে। লাভের পয়সা দিয়েই সিনেমা হল হয়ে যাবে! নিজের বুদ্ধিতে নিজেই চমৎকৃত হয়ে গেল বাপী।
একশো টাকা কুড়িয়ে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর দুজনে নিজেদের অজান্তেই ধুলো সরিয়ে সরিয়ে রাস্তার মাঝখানে অন্ততঃ দু ফুট ব্যাস ও ছয় ইঞ্চি গভীরতার একটা গর্ত সৃষ্টি করে ফেলল।
হয়ত উক্ত গর্তের আয়তন এবং ওদের কল্পনার বহরে একশো টাকার নোটে লব্ধ সামগ্রীর পরিমাণ আরো বাড়ত, যদি না একজন ফর্সা, রোগা, সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরা ভদ্রলোক ওদের দেখে সাইকেল থেকে নেমে পড়তেন।
লোকটি
বিস্মিত হয়ে ওদের কান্ড দেখলেন, তারপর বললেন - কি রে, রাস্তায় গর্ত করছিস কেন?
ওরা অবাঞ্ছিত এই প্রশ্নকে অনধিকারচর্চা মনে করে উপেক্ষা করলে প্রথমে।
- বলি কথাটা কি কানে যাচ্ছে না তোদের? ভদ্রলোকের গলায় এবার বেশ কর্তৃত্বের সুর।
বাপী ওদের দুজনের মধ্যে বয়সে সামান্য হলেও বড়। সে এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ বাক্যের জবাব দেওয়ার অধিকারী মনে করলে নিজেকে। এবং ঝাঁঝিয়ে বললে – ধুলো ওড়াচ্চি বেশ করচি, তোমার তাতে কি?
ভদ্রলোক সাইকেলটা স্ট্যান্ড দিয়ে দাঁড় করালেন এবং বাপীকে জিজ্ঞেস করলেন - তোর বাবার নাম কি রে?
- রামরতন অধিকারী, কেন বাবার নাম নিয়ে কি করবে?
ভদ্রলোক এরপর বিনা বাক্যব্যয়ে এগিয়ে এলেন এবং বাপীর ডান দিকের কানটা সজোরে মুলে দিলেন।
পলাশ তো হাঁ!
বাপী তিন মাসের ছোট কাকাতো ভাইয়ের সামনে এই ঘোর অপমানে বেজায় অপ্রতিভ হল। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে মুখ লাল করে বললে – ফের যদি দেখতে পাই এই রাস্তায়, তো ইঁট ছুঁড়ে মারবো।
ভদ্রলোক বিস্মিত ওদের দিকে তাকালেন, বললেন - বাঃ।
তারপর সাইকেলে উঠে চলে গেলেন। বাপী ও পলাশ বিজয়গর্বে ধুলো উড়োতে উড়োতে স্কুলের পথে এগিয়ে চলল।
এই কাহিনী টিফিনের সময় বন্ধুদের কাছে ফলাও করে এবং কিঞ্চিৎ অতিরঞ্জিত করে বর্ণিত হল - কোথাকার কোন অজ্ঞাত কুলশীল ব্যক্তির অকারণ নাক গলানো এবং দুই বীর বালক কর্তৃক সমুচিত জবাব পেয়ে শত্রুর পলায়নের কাহিনী।
স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরে দুজনেই থ।
বাড়ির দুয়ারে চেয়ারে বসে আছেন সেই সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরা ভদ্রলোক, পাশে ওদের দাদু। উনি নাকি পাশের কালীদনা গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের হেডমাষ্টারমশাই! এর পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত এবং অনুল্লেখযোগ্য, মাত্র পঞ্চাশ বার কান ধরে ওঠবোস করা কি আর এমন মনে রাখার বিষয়!
বলা বাহুল্য এ কাহিনী আর স্কুলে বন্ধুদের কাছে বর্ণনা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি দুই ভাই।
সারল্যে ভরপুর খুব সুন্দর একটা গল্প শুধু নয়, গভীর বার্তাও রয়েছে গল্পটির মধ্যে। খুব ভালো লাগল...
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন