দীর্ঘশ্বাস - সুনীল কর্মকার


 

অফিস থেকে ফিরে দেবাশিস বাইকটা গ্যারাজে ঢুকিয়ে জামা কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হতে দোতলায় ওঠে। তখন করোনার ব্যাপক প্রকোপ। মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড আতঙ্ক।  আকছার মানুষ মারা ও যাচ্ছে। এক্ষেত্রে যুবক বয়স্ক বলে রেহাই নেই।  দেবাশিস মিনিট দশেকের মধ্যেই স্নান সেরে জামাকাপড় পাল্টে নিচে নামতেই ছোট্ট রণজয় ছুটে এসে বাবার কোলে ওঠার জন্য হাত বাড়ায়।

পৃথা একটা তৃপ্তির শ্বাস ছেড়ে বলে, বাব্বা এবার বাঁচলাম। সারাদিন ধরে জ্বালাতন। আর পারছিনা বলে  সোফায় হাত পা ছড়িয়ে  রিমোট নিয়ে টিভির চ্যানেল ঘোরাতে থাকে। 

দেবাশিস রণকে কোলে নিয়ে  খাটে বসে। টিভিতে চোখ রেখে পৃথা দেবাশিসের উদ্দেশ্যে  বলে, যা বলে ছিলাম সব আনা হয়েছে তো? বলো ভুলে গেছি?

- এই যাঃ সত্যিই ভুলে গেছি। অফিসে কাজের চাপে... 

দেবাশিস কথাটা শেষ না করতেই পৃথা বলে, এবার যাও। সকালেই রণর খাবার লাগবে। সবার সব কথা মনে থাকে আমারটাই ভুলে যায়। তুমি পুরো পাল্টে গেছো

- এখানে পাল্টানোর কী হলো?  অতি সাধারন বিষয়কে ভীষণ জটিল করে তোলো। সিম্পল ভাবে ভাবতে পারোনা? দেবাশিস বলে

তুমিই আমাকে ক্রিটিক্যাল করে দিচ্ছ। একদিন নয় এভাবেই তুমি আমাকে উপেক্ষা করো,পৃথা বলে।

সারাদিনের ধকল তারপর বাইকে পঁচিশ-পঁচিশ পঞ্চাশ কিমি রাস্তার আপডাউন শরীর মন বলে কিছু অবশিষ্ট থাকেনা। তারপর বাড়িতে যদি এরকম স্ত্রীর কথা শুনতে হয় মেজাজ ঠিক রাখা  কঠিনই। তথাপি দেবাশিস নিজের অপরাধ স্বীকার করে বলে, বেশ আমি এক্ষুনি বাজার যাচ্ছি। মনের দুঃখ মনেই থেকে গেল। মানুষ কীভাবে এত পাল্টে যায়?

যখন ভালোবেসে বউ করে এবাড়িতে এনেছিল, পৃথাও ভাবেনি এবাড়ির বউ হবার যোগ্যতা কতখানি! থাকতো একটা এঁদো গাঁয়ে। খুবই নিম্নবিত্ত পরিবার। দেবাশিসের বন্ধুর মাধ্যমে যোগাযোগ। আসাযাওয়া। এখানে নিয়ে এসে  মুঠোমুঠো আলো ছড়িয়ে দিয়েছিল পৃথার প্রাণে। জল, আলো ও প্রাণের স্পর্শে  নূতন শাখা প্রশাখায় জীর্ণ প্রাণে সবুজ স্নিগ্ধতায় সতেজ হয়ে উঠল। 

সেসব আজ অতীত। এখন সেই সবুজের ভিতর থেকে বিষধরের ফণা ছোবল মারে দেবাশিসকে

চটজলদি রণকে নিচে বসিয়ে উপরে গিয়ে মানিব্যাগটা হাতে নিচে নেমে বাইরে বেরোবার জন্য দরজার দিকে পা ফেলতেই মা রমলা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেবাশিসের উদ্দেশ্যে বলেন, খোকা এট্টু বোস। জল টল খেয়ে যাবি। এ্যাতো তাড়ার কী আছে??  

- না মা, নিয়ে আসি। তারপর ... 

- এট্টু পরে যাবি না হয়। 

কথাটা শেষ না হতেই পৃথা বেশ চড়া গলায় ঠোঁট বাঁকা করে বলে উঠল, উঁ! দরদ উথলে উঠছে যেন। ছেলে দোষ করেছে সেটা মনে হচ্ছেনা। যেহেতু আমি বলেছি সেহেতু বাগড়া দিতেই হবে। সবেতেই বাধা। দোষ করেছে খেসারত দিক্। 

কথা কয়টি রমলার বুকের ভেতর যেন তীরের ফলার মতো বিঁধল। মায়ের বুকের ভেতর থেকে গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, যা শুধু দেবাশিস অনুভব করল। দেবাশিস মাথা নিচু করে অন্ধকারেই বাড়ির বাইরে পা বাড়ালো




1 মন্তব্যসমূহ

  1. দেবাশিষ আর পৃথার তিক্ত সম্পর্কের একটা টুকরো খতিয়ান তুলে ধরেছেন লেখক।
    খুব সুন্দর লাগলো দাদা।
    অভিনন্দন।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন