কাহিনীসমূহের পৌনঃপুনিকতা ও গোয়েন্দার তদন্তপদ্ধতিঃ মিতিন - লিপিকর


একটা চরিত্র বা চরিত্রগোষ্ঠী নিয়ে অনেকগুলো আখ্যানের একটা জগৎ অনেকটা সময় ধরে কোনো লেখক তৈরী করলে, সেগুলোর একত্রপঠনে কিছু প্রকট ও কয়েকটা অন্তর্লীন পৌনঃপুনিকতার সন্ধান পাওয়া সম্ভব, যার দুটো উৎসের কথা আমরা ভাবতে পারিঃ

যেহেতু কেন্দ্রীয় কুশীলবরা অনেকেই অপরিবর্তিত এবং তাদের যাপন, বাসস্থান, বা বয়সেও দারুণ কোনো পরিবর্তন দুটো কাহিনীর মধ্যে ঘটে নি, তাই চরিত্রদের পারম্পর্য্য ও আখ্যানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে কিছু অভ্যাস বা পরিস্থিতি ফিরে ফিরে আসে।

স্রষ্টার কোনো বিশেষ ঘটনা, তদন্তপদ্ধতি বা চরিত্রবৈশিষ্ট্য ব্যবহারের অবচেতন আকর্ষণ, প্রচুর সময়ের ব্যবধানে লেখা হলেও, একই সঙ্কলনে বন্দী হওয়ার সুবাদে খুব সহজেই পাঠকের কাছে ধরা পড়ে।

আমরা এই আলোচনায় ১৪টি উপন্যাসের পাঠ-ভিত্তিতে এরকমই কিছু বৈশিষ্ট্য আবিষ্কারের চেষ্টা করব। সুচিত্রা ভট্টাচার্য-এর মিতিনমাসি ও তাঁর সহকারী-তথা-বোনঝি টুপুর-এর রহস্যভেদ কাহিনীগুলোর অধিকাংশই প্রকাশ পেয়েছিল বিভিন্ন বছরের শারদীয়া আনন্দমেলা পত্রিকাতে, ফলতঃ সৃষ্টিগুলোর গায়ে “কিশোরপাঠ্য” তকমাটি বেশ জোরের সঙ্গে সেঁটে থাকে, যা কাহিনীর পরিকল্পনা, বুনন ও বর্ণনায় অনেক নিষেধ আপনা থেকেই নিয়ে আসে এবং কিছু চরিত্রের ও উপন্যাসগুলোর বৈশিষ্ট্যের সম্ভাব্য মূল প্রেরণা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠতে পারে। (কাহিনী-তালিকা শেষে দেওয়া হল)

এর বাইরেও সুচিত্রা ভট্টাচার্য্য মিতিনকে কেন্দ্র করে অন্ততঃ তিনটে প্রাপ্তবয়স্ক গল্প লিখেছেন, কিন্তু সেগুলোর গঠন এতটাই আলাদা এবং বিদেশী জনপ্রিয় আখ্যানের অনুসারী, যে সেগুলোকে আলোচনায় ঢোকালে লেটমোটিফগুলো মলিন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা জাগে।

প্রেক্ষিতঃ

১) ভ্রমণঃ-

মিতিনমাসি-টুপুরের অধিকাংশ অভিযানের সূচনা আমরা প্রধানত দুটো ছাঁচে ফেলতে পারি-

প্রথমত, যেখানে টুপুর-মিতিন-পার্থ-বুমবুম (কখনো-সখনো টুপুরের মা সহেলী এবং বাবা অবনীও) কোনো পর্যটকপ্রিয় সুরম্যস্থানে বেড়াতে গিয়ে অপরাধের স্থান-সময়ের সমাপতনে ঘটনাচক্রে রহস্যজালে জড়িয়ে পড়ে (উদাহরণ, “সারান্ডার শয়তান” গল্পের মেঘাতুবুরু-থলকোবাদ-করমপদা ভ্রমণ, “কেরালায় কিস্তিমাত” হওয়ার মাঝে কোচি এবং আশেপাশের এলাকাগুলো ঘুরে বেড়ানো, পার্থ-র খবরের কাগজের উত্তর পাঠানো “ছকটা সুডোকুর” সূত্রে সিঙ্গাপুর যাত্রা, কুলু-নগ্গর-মণিকরণ বেড়াতে গিয়ে “কুড়িয়ে পাওয়া পেনড্রাইভ” নিয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, “টিকরপাড়ার ঘড়িয়াল”দের চুপ করে থাকার পর্দা ফাঁস, এবং সবশেষে “স্যান্ডরসাহেবের পুঁথি” খুঁজতে (এখানে অবশ্য পার্থ-র বন্ধুর সৌজন্যে “কেস” ও পাথেয় দুই-ই কোলকাতায় বসেই লব্ধ) জাঁসকর উপত্যকা ভ্রমণ।

এই পটভূমিগুলোকে জীবন্ত করে তুলতে লেখিকা প্রধানত তিনটি স্তরে পাঠককে স্থান সম্বন্ধে অবহিত করার চেষ্টা করেছেনঃ

১. অভিযাত্রীদের ভ্রমণের দীর্ঘ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, দুটি জায়গার মধ্যে যাতায়াতের বাহনগুলো এবং তাতে চড়ার অভিজ্ঞতার স্বাদ ভাগ করে নেওয়া।

২.  মূলত, পার্থর জবানিতে সেইসব জায়গার ঐতিহাসিক বিবর্তনের গল্প, যার অনেকটাই হয় তো বর্তমানে অন্তর্জাল-লভ্য, কিন্তু লক্ষ্য-গণ্ডীর পাঠক-পাঠিকার মনে জায়গাটা সম্বন্ধে প্রারম্ভিক জ্ঞানটুকু দিতে এবং কৌতূহলের সলতেটুকু পাকাতে সক্ষম।

৩. অভিযান-চলাকালীন এবং শেষে টুপুরের অনুভূতি, যা যৌক্তিক অপেক্ষা বৌধিক আবেদনে অধিকতর সমৃদ্ধ। অন্তত, বন-জঙ্গলের প্রেক্ষাপটের উপন্যাসদুটো, সারান্ডার শয়তান বা টিকরপাড়ার ঘড়িয়াল-এর ক্ষেত্রে অপরাধ তার পটভূমির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে প্রকৃতি, প্রাণী ও পরিবেশ সম্বন্ধে এক মর্মস্পর্শী কাহিনীর বুননে সহায়তা করে, যেখানে অপরাধের দায় আর সম্পূর্ণত ব্যক্তিগত থাকে না, গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান, দ্বিপদ প্রাণীটির লালসার দিকে অনিবার্য্যভাবেই নির্দেশ করে। অন্য অনেক উপন্যাসে প্রেক্ষিতের স্থান-মাহাত্ম্য নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর, যেমন সিঙ্গাপুরের ঘটনাটা যে কোনো শহরের হোটেলেই (ন্যূনপক্ষে, যেকোনো বিদেশী শহরের হোটেলেই) ঘটতে পারত।

লেখিকা যেসব জায়গায় আমাদের মানসভ্রমণে নিয়ে যান, তার অধিকাংশই নিয়মিত ভ্রমণ-পিপাসুদের কাছে নতুন সহস্রাব্দের গোড়ায় অতি-আবিষ্কৃত, ফলতঃ সেখানে বেড়ানোর বর্ণনায় নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সর্বক্ষণ তুলনা করা চলে, কিন্তু নতুন, অনাবিষ্কৃত গন্তব্যে মনে মনে বেড়ানোর মজা কমই মেলে। (ব্যতিক্রম কিছুটা জাঁসকর উপত্যকা যাওয়ার কাহিনী, কিন্তু সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যও বেড়ানোর নয়, ট্রেকিং করারই বেশী হতে বাধ্য।)

২) কলকাতা শহরঃ-

দ্বিতীয় গোত্রের উপন্যাস, যেখানে লেখিকা কাহিনীর ছক সাজিয়েছেন কলকাতা মহানগরীতে - সেই আখ্যানমালার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য যে এগুলির অধিকাংশই শহরের অত্যন্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ কোনো জনগোষ্ঠীর মানুষদের কেন্দ্রে রেখে আবর্তিত – “জোনাথনের বাড়ির ভুত” গল্পে অ্যাঙলো-ইন্ডিয়ানরা (যাদের সত্যজিৎবাবু তাঁর একাধিক রহস্যকাহিনী, উদাহরণ হিসেবে স্মর্তব্য “গোরস্থানে সাবধান” ও “শকুন্তলার কণ্ঠহার”, ঘনিয়ে তুলতে ব্যবহার করেছেন), “ঝাও ঝিয়েন হত্যারহস্য” চৈনিক অভিবাসীদের ইতিহাস ও বর্তমান, “আরাকিয়েলের হিরে” উপন্যাসে শহরে প্রায় অজ্ঞাত আর্মেনীয় মানুষরা, “হাতে মাত্র তিনটে দিন” উপন্যাসে পার্সী সম্প্রদায়, ‘মার্কুইস স্ট্রিটে মৃত্যুফাঁদ” কাহিনীতে কলকাতা থেকে প্রায় বিলুপ্ত ইহুদীরা, “দুঃস্বপ্ন বারবার” গল্পে জৈন মানুষরা, এবং “স্যান্ডরসাহেবের পুঁথি”-র শেষ আখ্যানে চট্টগ্রাম-থেকে-আসা বৌদ্ধরা তাঁদের আচার-নীতিসহ বর্ণনার পাদপ্রদীপে উপস্থিত হয়েছেন।


এখানেও কাহিনীতে কিশোর ও কিশোর-মনস্কদের আকৃষ্ট রাখতে লেখিকার কলমে (এবং আবারো প্রধানত পার্থর অন্তর্জাল-সংগৃহিত-তথ্যের বক্তৃতায়) এই জনসংখ্যার-নিরিখে-প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলির কলকাতা-সম্পৃক্তির ইতিহাস সম্বন্ধে আমরা জ্ঞাত হই। যেহেতু তাঁরা বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী, শুধু আচারের বাহ্যেই নয়, স্বভাবগত চিত্রায়ণেও জাতিগত স্টিরিওটাইপটি ( কিপ্টে ইহুদী, রাগী আর উন্নাসিক অ্যাঙলো-ইন্ডিয়ান যুবক, মিতভাষী পার্সী, ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেও প্রতারণায় নির্দ্বিধ জগৎশেঠের উত্তরসূরী) অপ্রকাশ্য থাকে না।

ভ্রমণ-আখ্যানের মত এখানেও লেখিকা শব্দ ও সময় ব্যয় করেছেন এইসব সম্প্রদায়ের বিশেষ বিশেষ উৎসব ও উদযাপনের বিশদ বর্ণনায়, কিন্তু একমাত্র মার্কুইস স্ট্রিটে মৃত্যুফাঁদ কাহিনীতে র‌্যাচেল-এর পোশাক সংরক্ষণ ব্যতীত কোথাওই এই প্রেক্ষিত মূল অপরাধ বা তদন্তবিবরণে অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠতে পারে না বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়। অবশ্য, বিরুদ্ধে দাবী উঠতেই পারে, যেসব দুর্মূল্য ধন-জহরৎ উদ্ধার করার কৃতিত্ব এইসব আখ্যানগুলির সমাপ্তিতে নায়িকা নিয়ে যান, এই বিশেষ সম্প্রদায়গুলির অনুপস্থিতিতে সেইসব রত্নদের গল্পে আমদানী করা আরো দুষ্কর হতো।

ছকঃ

১) ধনদৌলতঃ-

অনেকগুলি কাহিনীতেই গোয়েন্দা মিতিন-এর সাফল্য শুধুমাত্র অপরাধী-সনাক্তকরণের একমাত্রায় থেমে থাকে না, বহুযুগ ধরে গোপন, দুষ্প্রাপ্য ধনরাশির পুনরুদ্ধারেও প্রজ্ঞাপারমিতা অপরিমিত প্রজ্ঞা দেখান, তা সিপাহী বিদ্রোহের স্পর্শধন্য তলোয়ার হতে পারে (জোনাথনের বাড়ির ভুত), বা পেন্টাটিউক স্ক্রল (কেরালায় কিস্তিমাত), কিংবা চৈনিকদের দুষ্প্রাপ্য ঐতিহাসিক মানচিত্র (ঝাও ঝিয়েন হত্যারহস্য), বা রোয়েরিক-এর আঁকা ছবি (কুড়িয়ে পাওয়া পেনড্রাইভ), পাঁচ ক্যারাটের হীরকখন্ড (আরাকিয়েলের হিরে) বা বদ্খশানি চূণী (মার্কুইস স্ট্রিটে মৃত্যুফাঁদ)। অনেক ক্ষেত্রেই দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাওয়া এইসব ধনদৌলতের সঙ্গে কাহিনীর মূল অপরাধটি তেমন নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকে না। তাই একদিকে যেমন এগুলো গোয়েন্দার সাফল্যের শিরস্ত্রাণে পৃথক পালক হিসেবে গণ্য হওয়ার দাবী জানায়, অপরদিকে তেমনি এই প্রশ্নটিও পুরোপুরি থামানো যায় না যে সমস্ত সম্পর্ক-দুর্বল উপসূত্রগুলোকে আরো নিপুণ ভাবে আখ্যানমালায় গেঁথে তোলা যেত কিনা। আবারো একবার ফেলুদা-কাহিনী স্মৃতি-চর্বণ করলে আমরা দেখতে পাবো, দুর্মূল্য ধনরত্নের উপস্থিতি দিয়ে কাহিনীর আকর্ষণ বৃদ্ধি সত্যজিৎবাবুরও একটি বহু-ব্যবহৃত অস্ত্র।

২) গুপ্তকক্ষঃ-

রহস্য-সৃষ্টিতে লেখিকার আরও একটি প্রিয় কৌশল গল্পের কেন্দ্রীয় আবাসটিতে একটি গোপন স্থানের অবতারণা। গুপ্তধনের গুজব গল্পে তা আড়ালে থাকে জানিত পাতালঘরের, মার্কুইস স্ট্রিটে মৃত্যুফাঁদ কাহিনীতে ফাঁক খুঁজে পাওয়া যায় দেওয়ালের থামে, দুঃস্বপ্ন বারবার ফিরে আসে শিশুবয়সে গোপন ঘরটিতে ঢুকে হতাশ হওয়ার স্মৃতি নিয়ে। কিছুটা সংলগ্ন আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয়, মিতিন কাহিনীর অনেক অপরাধেরই প্ররোচনা হিসেবে কাজ করে স্থাবর সম্পত্তির প্রতি লোভ, অন্য সব মাত্রায় শিশুপাঠ্য হওয়ার তীব্র লিপ্সা এই এক বয়সে বড় হয়ে উঠে ছোট মানসিকতালাভের অপরাধকে কেন আড়ালে রাখে না, সে প্রশ্ন করা যেতেই পারে।

রহস্যভেদের অস্ত্রঃ

১) টোপ ও ধাপ্পা

অপরাধীকে বেফাঁস কাজে প্ররোচিত করতে মিথ্যে ঘোষণা বা বিজ্ঞাপনের টোপ ব্যবহার করা রহস্যসাহিত্যে বহুলব্যবহৃত কৌশলগুলির একটি। মিতিনকে আমরা দেখতে পাই, বারংবার এর উপযোগ করে অপরাধীদের হাতেনাতে পাকড়াও করতে । গুপ্তধনের গুজবে এই ভাবেই জালে পড়ে অস্ত্র পাচারকারী, মার্কুইস স্ট্রিটে মৃত্যুফাঁদ পাতা ধারাবাহিক খুনী মৃতা র‍্যাচেলের পোশাক বা ঝাও ঝিয়েন হত্যারহস্য-র খলনায়ক দুর্লভ পুঁথি সংগ্ৰহ করতে গিয়ে ঠিক এই ভাবেই পাকড়াও হয়, ঠিক যেমনভাবে ছদ্মবেশ ঘুচে যায় টিকরপাড়ার ঘড়িয়াল-এর ঘাতকদের। এই পৌনঃপুনিকতায় যেটা অতিমানবীয় ঠেকে তা হলো প্ৰচেষ্টাগুলির অব্যর্থতা; একটিতেও অপরাধীরা গোয়েন্দার মনস্তত্ব বুঝে পাল্টা চাল দেওয়ার মত সপ্রতিভতা দেখতে সক্ষম হয় না।

একই সঙ্গে গোয়েন্দা মিতিনের আরও একটি বহু-ব্যবহৃত পদ্ধতি আচম্বিতে কোনো রূঢ়, ধাক্কা-দেওয়া সংলাপে চমকে দিয়ে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কোনো লুকোনো কথা বের করে নেওয়ার চেষ্টা করা - এর প্রচুর উদাহরণ প্রায় সমস্ত আখ্যানেই ছড়িয়ে আছে, কিন্তু এই প্রয়াসগুলোতে যেটা পরিণত রহস্যগল্প, পাঠকের কাছে বিস্ময়কর লাগতে বাধ্য, তা হলো দীর্ঘ পারিবারিক সম্পর্ক ও সান্নিধ্য সত্ত্বেও টুপুর প্রতিবারই এই বৈপ্রতীপ্যে অবাক হয়, হয়তো এই ছদ্মকোপগুলো কোন অসততায় কোপ দিয়ে উদ্যত তা অনুধাবন করে তার গোপন মজাটি টুপুরকে পেতে দেখলে তাকে হয় তো আরও বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে পারতো।

২) পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা

প্রজ্ঞাপারমিতা-র অনুসন্ধান আখ্যানে তাঁর কোন বিশেষত্বটি সবচেয়ে চোখে পড়ে? প্রচন্ড তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতা। যে ইঁটভাটার মধ্যে মাটির খালি ব্যাগ দেখে বুঝে নিতে পারে গর্ত খোঁড়া না বোজানো হচ্ছিল (গুপ্তধনের গুজব), লোকাল ট্রেনের টিকিট থেকে টিকি ধরে টেনে আনতে পারে জমজ অপরাধীকে (সর্পরহস্য সুন্দরবনে), কুড়িয়ে পাওয়া পেনড্রাইভ-এর ছবি থেকে অনুমান করতে পারে, কাছের কোন চিত্রশালায় কীরকম আঘাত আসতে চলেছে। তবে কখনো কখনো এই দক্ষতাটি কিছুটা অতিমানবিক ঠেকে যখন দেখি জঙ্গলের মাটিতে পড়ে থাকা সবুজ গুঁড়োকে ক্রোমিয়াম সালফেট বলে সনাক্ত করে তার ব্যবহার আন্দাজ করে ফেলা বা দূরবীনে আগ্নেয়াস্ত্র দেখে তা সামরিক বাহিনীর সার্ভিস রিভলবার কিনা বুঝে ফেলার প্রজ্ঞা সমাধানের অপরিহার্য্য অঙ্গ হয়ে উঠছে (টিকরপাড়ার ঘড়িয়াল)।

মানুষ মিতিন

তো, মিতিন ব্যক্তিটিকে ব্যক্তিগতভাবে কেমন লাগে? যাপনের দিক থেকে প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জীকে উচ্চমধ্যবিত্ত, শহুরে, আবির্ভাবসচেতন নারী হিসেবে চিনতে অসুবিধে হয় না। পরিধেয় হিসেবে সালোয়ার-কামিজ বা জিনসের প্যান্ট - উভয়েই স্বচ্ছন্দ, আইফোন ব্যবহারকারিণী, নিজেদের ছোট গাড়িটি চালাতে অভ্যস্ত, পাঁচ বছরের সন্তান বুমবুম-এর রক্ষয়িত্রী ভারতী বা গৃহসেবিকা আরতিকে (যদিও দুজনে কোনো আখ্যানে একত্রে উপস্থিত নয়) রাখার আর্থিক সামর্থসম্পন্না, ১৭/৩/বি বাবুবাগান লেন ঢাকুরিয়ার বাসিন্দা শুধুমাত্র লেখিকার অঞ্চল-সহবাস বা ফেলুদার (১৭বি, রজনী সেন রোড) প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যেই চিহ্নিত হন না, তাঁর সামাজিক পরিচয়টি সন্দেহাতীতভাবে সেই তলকে নির্দেশ করে, যেখানে স্বামীর দামী ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা ছবির কেন্দ্রীভূত দৃশ্য বা জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমে দ্রষ্টব্য ব্যক্তিপরিচয় তদন্তে ব্যবহৃত না হলেই অবাক হতে হতো। লক্ষ্যণীয়, অর্থলোভ না থাকলেও মিতিনের অর্থলাভ কম কিছু হয় না। বাংলা সাহিত্যের আদি সত্যান্বেষীর তুলনায় মা লক্ষ্মীর কৃপা তার উপর অনেক বেশী বর্ষিত হয়েছে।

খাদ্যপ্রীতি

মিতিন, টুপুর, বুমবুম এবং বিশেষভাবে পার্থ - সবাই রসনারসিক। বিশেষত, দুর্গম যাত্রাতেও তাদের খাওয়া-দাওয়ার অভিযানগুলি রহস্যভেদের তুলনায় একটুও গৌণ থাকে না। রহস্যজালে আগাগোড়া স্নায়ু টানটান রাখার ব্যাপারে এই কিশোরপাঠ্য উপন্যাসগুলি ব্যক্তিগতভাবে আংশিকভাবে সফল বলে মনে হয় এবং এইসব সুখাদ্য ও প্রেক্ষিতের সৌন্দর্য্য এক সুখানুভব বসবাসের মাধ্যমে সেই থমথমে হতে চাওয়া পরিবেশকে হালকা রাখে - তা রহস্যকাহিনীর গৌরববর্ধনে নেতিপ্রভাব আনে, না শিশুপাঠ্যতার দাবীকে প্রাধান্য দিয়ে উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, তা নিয়ে মতদ্বৈধ থাকা অস্বাভাবিক নয়। অতিরিক্ত রাজনৈতিক সঠিকতার প্রিজ্মে দেখলে লেখিকাকে জিহ্বা-সন্তোষ জাঙ্ক-ফুডের পরোক্ষ প্রসারের অপবাদ দেওয়াই যায়। এই সুখাদ্যপ্রীতিটিও বাংলা সাহিত্যের অনেক দাদাই মিতিনের আগেও সরসতার উপাদান হিসেবে পাঠককে দিয়ে গিয়েছেন।

ফেলুদা-অনুসরণ

প্রদোষ মিত্রের প্রভাব হয় তো আরও বড় একটু বিশ্লেষণ দাবী করে। ব্যক্তিগতভাবে, আমার এই কাহিনীগুলির গঠনে সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা গল্পের সাহিত্যিককুলে জনপ্রিয় টেমপ্লেটটি বড় বেআব্রু রকমে চোখে পড়ে, যেখানে কিশোরপাঠ্যতার সীমানার মধ্যে উপভোগ্যতার যোগান দিতে বেড়ানো, সুখাদ্য, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ, অল্প-বিস্তর বুদ্ধি খাটানো, কিছু শারীরিক মারামারি (বা ক্ষেত্রবিশেষে এক-দুটো গুলি) এবং মধুরেণ সমাপয়েৎ-এর গতেই গল্পগুলি ঘুরপাক খায়, বৃহত্তর কোনো ভাবনা, নৈতিক সঙ্কট বা বাস্তবজগতের প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধ থেকে তাদের সচেতন দূরত্ব বজায় থাকে আগাগোড়া। সুচিত্রাদেবী এটিকেই নিজের মত করে পরিমার্জনা করে নিয়ে ব্যবহার করে গিয়েছেন মিতিন গল্পের সর্বত্র, তাই গল্পমালায় ভৌগোলিক বা ঐতিহাসিক জ্ঞান যতটা ঝলসে উঠতে থাকে, মানবিক সম্পর্কগুলির টানাপোড়েন সে তুলনায় অধিকাংশ সময়েই থেকে যায় গৌণ, আবৃত, নিছকই উপরিতলস্পর্শী। আশ্রিতের বিশ্বাসঘাতকতার বা সচিবদের অপরাধপ্রবণতার যে লেটমোটিফ ফেলুদাকাহিনীতেও আমরা বারেবারে দেখেছি, লেখিকার কলমে তা-ই পরবর্তী প্রজন্মের অর্থলালসাতাড়িত কৃতঘ্নতারূপে উদ্ভাসিত হয়। এমনকী, ফেলুদা-জগতের নারীহীন পৃথিবীও নারীবাদী, নারী স্রষ্টার কলমেও (আংশিক ব্যতিক্রম মার্কুইস স্ট্রিটে মৃত্যুফাঁদ এবং দুঃস্বপ্ন বারবার) উঠে এসে শিশুমনে অবচেতনে গেঁথে দেয় যে চিকিৎসক, বিজ্ঞানী বা পেশাসফল ব্যক্তিত্ব তো বটেই, এমনকী তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কের অপরাধ করার দক্ষতাও মেয়েদের নাগালের বাইরে। ঠিক একইভাবে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মের মানুষদের উপস্থিতি ফেলুদা গল্পে ক্কচিৎ গৌণ ভূমিকায় দেখতে পাওয়ার উদাহরণটিও এখানেও সার্থকভাবে অনুসৃত হয়।

অন্য দুর্বলতা

১) সবসময় সঠিকঃ

গোয়েন্দা হিসেবে আমরা কখনোই মিতিনকে দ্বিধান্বিতা বা ভুল পথে অগ্রসর হতে বিশেষ দেখি না। এই অতিমানবিক ক্ষমতা আরও দৃষ্টিকটু রকমের প্রকট লাগে যখন বহুবছর আগে পড়া খবর থেকে প্রজ্ঞাপারমিতা নিখুঁত ও নিশ্চিতভাবে গর্জন রায় বা রণেন সেনদের বর্তমান স্বরূপটি সহজেই বুঝে ফেলেন, বা শক্তিধরের দশক-পুরোনো শারীরিক সাফল্য মিতিনের স্মৃতিতে থেকে যায়; কারো বাড়িতে গিয়ে আওয়াবেন বিষ উৎপাদক স্ট্রোফানথাস গাছ একবার দেখেই চিনে ফেলার মতোই তা অবিশ্বাস্য ঠেকে।

২) সঙ্কেত ব্যবহারঃ

খুব কম মিতিন কাহিনীতেই কোনো গোপন বার্তা বিনিময় করার জন্য গুপ্তসঙ্কেতের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। কথা নিয়ে খেলা করার রহস্য উপন্যাসের এই ধ্রুপদী দক্ষতাটি স্টেগানোগ্রাফির উল্লেখ (ছকটা সুডোকুর) বা ‘বিনামা’, ‘উপাক্ষ’, ‘যাবক’ শব্দের অর্থ বাৎলে সেই ঘাটতি পূরণ হয় না বা “Someone Who Once Ruled Destiny” বা “Aurum 13578” শব্দবন্ধে সেই প্রত্যাশা মেটে না।

৩) দুর্বলবুদ্ধি সহকারীঃ

অধিকাংশ কাহিনীতে টুপুরের উপস্থিতি নিতান্তভাবেই দর্শকের ও বর্ণনাকারিনীর, যার ক্ষীণপ্রভ বুদ্ধির দীপালোক উপন্যাস-নায়িকার মস্তিষ্ককে আরও বিচ্ছুরিত হিসেবে উপস্থাপন করা ছাড়া অন্য ভূমিকায় নিতান্তই গৌণ হয়ে থাকে। একমাত্র দুঃস্বপ্ন বারবার কাহিনীতে তাকে আমরা সমস্যা-উদ্বিগ্ন বান্ধবী ও মাসিকে জুড়ে দিতে দেখি, এবং স্বপ্নের অর্থ উদ্ধারের শেষ সমাপতনটি তার মুখনিঃসৃত শব্দাবলী থেকেই আসে।

৪) স্থূলোদর আরক্ষা-আধিকারিকঃ

হেমেন্দ্রকুমার সুন্দরবাবুর যে উদাহরণটি আমাদের সামনে রেখে গেছেন, মিতিন-কাহিনীতে অনিশ্চয় মজুমদারকে তার আধুনিক সংস্করণ ঠাওরালে খুব ভুল হবে না। খাদ্যপ্রীতি, উচ্চকিত কথোপকথন, শখের গোয়েন্দাকে ঈর্ষা করেও রহস্যভেদে তারই সাহায্য নিতে বাধ্য হওয়া - এই স্টিরিওটাইপটির লেবু বাংলা অভিযানগল্পে অনেক কচলানো হয়েছে।

শারীরিক সংঘর্ষ মিতিন-অভিযানে সৌভাগ্যক্রমে পরিমিত, যদিও সর্পরহস্য সুন্দরবনে কাহিনীতে তার যোগাভ্যাসের ক্রমিক বর্ণনার সুফল দৃষ্ট হয়। একইভাবে গুলি-গোলা চালানোর অবকাশ লেখিকা কমই এনেছেন (ব্যতিক্রমী উদাহরণ টিকরপাড়ার ঘড়িয়াল)। ‘স্যান্ডরসাহেবের পুঁথি’ গল্পে বিজন জায়গায় স্রেফ রিভলবারের ভয় দেখিয়ে পেশাদার, বহুদিন ধরে চক্রান্ত-করা নিষ্ঠুর অপরাধীকে এত দীর্ঘসময় আটকে রাখা সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।

বহুলপ্রচলিত বেশ কিছু ধাঁচ ও মারপ্যাঁচকে আত্মীকরণের মাধ্যমে জনপ্রিয় হলেও অভাবগুলো -উপন্যাস-নির্যাসের অনুপমত্ব, বিপদের টানটান রোমাঞ্চ, প্রচন্ড বুদ্ধিমান বা শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর -এই চরিত্র-আখ্যান মালার সার্বজনীন ও কালোত্তর হয়ে ওঠার পথে প্রতিবন্ধ হয়ে থাকে।

কাহিনী-তালিকা (কোনো নির্দিষ্ট ক্রম মেনে নয়)ঃ-

১.  সারান্ডার শয়তান

২.  কেরালায় কিস্তিমাত

৩.  ছকটা সুডোকুর

৪.  কুড়িয়ে পাওয়া পেনড্রাইভ

৫.  টিকরপাড়ার ঘড়িয়াল

৬.  স্যান্ডরসাহেবের পুঁথি

৭.  জোনাথনের বাড়ির ভুত

৮.  ঝাও ঝিয়েন হত্যারহস্য

৯.  আরাকিয়েলের হিরে

১০.  মার্কুইস স্ট্রিটে মৃত্যুফাঁদ

১১.  দুঃস্বপ্ন বারবার

১২. গুপ্তধনের গুজব

১৩.  সর্পরহস্য সুন্দরবনে

১৪.  হাতে মাত্র তিনটে দিন

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন