-“এই রাতের বেলা ব্রিজের তলায় অন্ধকারে কে তুই?”
- “কে আবার? আরে আমি এক বস্তির মেয়ে।”
- “কী নাম তোর?”
- “নাম ছিল। কিন্তু
অনেকদিন আগেই সে মরে গেছে। তবে এখন আমার নতুন নাম শরীর। কেউ কেউ আমাকে বলে আগুন।
হ্যাঁ, সত্যিই তাই। আমি আগুন। নিজে
পুড়ি অন্যকে পোড়াই। যাদের খুব খিদে পায় তারা রাতের অন্ধকারে আমাকে চেটেপুটে
খায়।”
- “হেঁয়ালি না করে
সোজাসুজি বল। এই বৃষ্টিতে এখানে একলা একলা তুই কি করছিস?”
- “কী আর করব? রাতের অন্ধকারে প্যাঁচার মত শিকার ধরতে
বেরিয়েছি। দিনের আলোয় আমি কানা। তাই রাতের অপেক্ষায় থাকি।”
- “এবার বুঝলাম। শিকার
কি পেয়েছিস?”
- “না এখনও কোন বাবু
আসেনি। দেখছিস না দুপুর থেকে কেমন টানা বৃষ্টি পড়ছে। বাবুরা সব সোফায় বসে এই
সন্ধ্যেবেলা টিভি দেখছে। আর আমার কপাল পুড়ছে। আমার সাত বছরের মেয়েটার জ্বর।
তিনদিন থেকে জ্বর ছাড়ছে না। দ্যাখ, দ্যাখ, আমার গায়ে হাত
দিয়ে দ্যাখ, আমারও জ্বর। আমাদের
পাড়ায় কত্ত লোকের জ্বর।”
- “এই জ্বর গায়ে তুই
এলি কেন? দেখি দেখি, আরে তোর গা তো পুড়ে যাচ্ছে। তোর কি মরার ইচ্ছে
হয়েছে? তুই বাঁচতে চাস না। ফাঁপি
দিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। তোর জামা কাপড় তো সব ভিজে। ভিজে জামা কাপড়ে থাকলে তোর জ্বর
তো আরো বাড়বে।”
- “বাড়ুক। আর না ভিজলে
যে খদ্দের পাবো না। খদ্দের তো আর আমার ঘরে যাবে না। পোড়া কপাল! প্রায় ঘন্টা
দুয়েক দাঁড়িয়ে আছি। কোন বাবুর আজ টিকিটি নেই। আরে তোদের না হয় অনেক আছে।
কিন্তু আমার চলবে কী করে? আমাকে তো
রোজ গতর খাটিয়েই খেতে হয়। দিনে বড়জোর চার পাঁচশো টাকা রোজগার। তাও আবার কোনদিন
হয় কোনদিন হয়না। তবে কেউ কেউ খুশি হয়ে পঞ্চাশ একশো টাকা বকশিস দেয়। ওতেই
পুষিয়ে যায়। কেউ আবার বকশিস চাইলে গালাগাল দেয়। আমাদের তো মান সম্মান নেই। ও সব
সয়ে গেছে। এই ছোকরা, আমার সঙ্গে
চল।”
- “কোথায় যেতে বলছিস?”
- “আরে ওই যে ছিটে
বেড়ার ঘরটা দেখতে পাচ্ছিস ওখানে।”
- “কেন, কী জন্য?”
- “আজ আমি তোকে আদর
করবো। তুই যা চাইবি তোকে সব দেব। দেখবি তোকে কত্ত খুশি করে দেব। একবার যদি ওখানে
যাস তাহলে বারবার যেতে ইচ্ছে করবে। আরে কত বাবুরই তো ঘরে মাগ ছেলে আছে। তবু রাতের
অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার কাছে আসে। মজা লোটে। আরে এ তো দুনিয়ার সেরা মজা।
একবার চল না। দেখে তো মনে হচ্ছে তোর মাগ-ছেলে নেই। কি ঠিক বলছি তো?”
- “হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস।
আমি এখনও বিয়ে করিনি।”
- “ঠিক ধরেছি। তোর চোখ
মুখ বলছে তুই মেয়েছেলের স্বাদ এখনও পাসনি। আজ আমার সঙ্গে চল। বুঝবি মেয়েছেলে কি
জিনিস। এমন স্বাদ যে জিভে লেগে গেলে আর ছাড়বে না। এক্কেবারে স্বর্গসুখ। এই ছোকরা, আর দেরি করিসনে তাড়াতাড়ি চল। আমার হাতটা ধর।
মনে হচ্ছে আজ আর অন্য কোনও খদ্দের আসবেনা। তোকে যখন পেয়েছি তখন তোকে দিয়েই আজকের
মত কাজ চালিয়ে নিই।”
- “কিন্তু আমার খুব ভয়
করছে। আমার মন তোর সঙ্গে যেতে সায় দিচ্ছে না। তাছাড়া আমার কাছে অত টাকাও নেই।”
- “কত আছে?”
- “ওই দুশো টাকা মত।”
- “আরে ওতেই হবে। নেই
মামার চেয়ে কানা মামাই যথেষ্ট।”
- “কিন্তু আমাকে যে ওই
টাকা দিয়ে বাজারে কয়েকটা মাল কিনতে হতো। না না আমি যাব না। আমি বরং চলে যাই। তুই
অন্য খদ্দের দ্যাখ।”
- “আরে তুই ব্যাটাছেলে
না মেয়ে ছেলে? মেয়ের গন্ধ পেলে কত
ব্যাটা ছেলের মুখ দিয়ে লালা ঝরে। আর তুই কিনা হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলছিস। আচ্ছা
তুই কত দিতে পারবি বল? একশো টাকা
দিতে পারবি? একশো টাকা হলেই আমি
চালিয়ে নেব। আজকের রাতের খাবারের খরচ। জানিস হাতে একটাও পয়সা নেই। মেয়েটাকে
বুড়ি শাশুড়ির কাছে রেখে এসেছি। এলাম তখন জ্বরে ঠকঠক করে কাঁপছিল। আসতে ইচ্ছে
করছিল না। কিন্তু একটু ওষুধও তো ওকে দিতে হবে। হাতে ওষুধ কেনার মত পয়সা নেই। রাতে
একটু সাগু খাওয়াব ভাবছি। কিন্তু সাগু তো দোকানদার মাগনাতে দেবে না। দোকানদার আমার
বাপ ঠাকুরদা হয় না। তিন দিন কাজ করতে পারিনি। মেয়ের শরীর খারাপ সেই সঙ্গে আমারও।
তাই এই সন্ধ্যেবেলা একটু সুস্থ হয়ে জলে ভিজতে ভিজতে এসেছি এই ব্রিজের তলায়। এটাই
আমার ঠেক। এখান থেকেই শিকার ধরি। তারপর নিয়ে যায় ওই ছিটে বেড়ার ঘরে। কিন্তু
বাবুরা তো আজ কেউ এলোনা। জলে ভিজতে আসবেই বা কেন। ওদের ঘরে তো অভাব নেই। ঘরের
মাগকে দিয়েই আজ কাজ চালিয়ে নেবে। আর আমার হয়েছে যত মরণ। শালা বরটা চার বছর আগে
পটল তুলল। এক নম্বর মাতাল ছিল। লরিতে খালাসিগিরি করে যা পয়সা পেতো, সব উড়িয়ে দিত মাল খেয়ে। রাস্তাঘাটে বেহুঁশ
হয়ে দাঁত কেলিয়ে পড়ে থাকতো। লিভার ক্যান্সারে শালা অকালেই চলে গেল। নাও বোঝো
ঠেলা। সংসারের দায়-দায়িত্ব হারামিটা সব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেল। জানিস
আমাকে সংসারে তিনটে পেটের ভাত জোগাড় করতে হয়। বুড়ি শাশুড়িটা পর্যন্ত গলার
কাঁটা হয়ে লেগে আছে। ভাত-কাপড় সব দিতে হয়। কবে যে মরবে জানিনা। এভাবে গতর
খাটিয়ে একলা মেয়েমানুষের পক্ষে তিনটে পেটের ভাত কাপড় জোগাড় করা কি চাট্টিখানি
ব্যাপার!
মেয়েটাকেও স্কুলে ভর্তি করেছি। তার খরচ আছে। খাতা কলম বই কত কি লাগে। লোকের ঘরে ঝিয়ের কাজ করে যা টাকা পাওয়া যায় ও দিয়ে সংসার চালানো যায় না। প্রথম প্রথম ঝিয়ের কাজ করেছি। দুবেলা ভালো করে খেতেই পেতাম না। তাই বাধ্য হয়ে অন্য রাস্তা খুঁজতে হলো। আমাদের পাড়ার অনেক বউ বেটি এই লাইনে কাজ করে। ওদের দেখে আমিও নেমে পড়লাম দেহব্যবসার কাজে। পাপ-পুণ্যির কথা ভাবি না। আরে পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। সংসারে এমনি এমনি কেউ খেতে দেবে না। যত বাবু আছে কেউ শালা দয়া করে বিশটা টাকাও দেবে না। কিন্তু শালারা মেয়েছেলের গন্ধ পেলে হাজার হাজার টাকা উড়িয়ে দেবে। আরে যত পারিস ওড়া টাকা। আমিও গতর খাটিয়ে ফন্দি করে ধরে নেব সে টাকা। জানিস লকডাউনের সময় আমার ব্যবসা কেমন মার খেয়েছে। মরার ভয়ে কোন লোকই আমাদের ধারে কাছে ঘেঁষত না। ঘন্টার পর ঘন্টা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতাম এই ব্রিজের তলায়। কিন্তু জন প্রাণী আসত না। মাঝে মাঝে না খেয়েও কাটাতে হয়েছে। বাবুরা সব ঘরে ঢুকে বসে আছে। ওদের তো আর পেটের ভাতের অভাব নেই। যত মরণ আমাদের মত চুনোপুঁটিদের। সে সময় লোকের দুয়োরে দুয়োরে কাজের জন্য ঘুরেছি। সবাই কাজের লোকও তখন নিচ্ছিল না। একটা বাড়িতে বাইরে বাইরে কাজ করে সামান্য কিছু রোজগার করেছি। ওতেই চালিয়েছি তিনটে পেট। তারপর ভ্যাকসিন নিয়ে দুনিয়াটা শান্ত হলো। আস্তে আস্তে ব্যবসা শুরু করলাম। শুকিয়ে যাওয়া গাছটা জল সার পেয়ে আস্তে আস্তে বেঁচে উঠলো। এই ছোকরা, আমি তো আমার কথাই বলে গেলাম তোর কথা কিছু বল।”
- “কী আর বলবো। আমি এমএ
পাশ। কোন চাকরি পাইনি। একটার পর একটা চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি। কিন্তু চাকরি কোথায়? সব শালা দু-নম্বরিতে ভরা। যাদের টাকা আছে তারাই
চাকরি পাচ্ছে। আর পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে আমার চটির শুকতলা ক্ষয়ে গেল। দু একটা
চাকরির বিজ্ঞাপন বেরোলেও একটার পর একটা কোর্ট কেস হয়ে যাচ্ছে। লে হালুয়া। এদিকে
আমার বয়সও পেকে যাচ্ছে। আর দু তিন বছর পেরিয়ে গেলে পরীক্ষাতে বসতেও পাবো
না।টিউশনি সম্বল করেই কাল কাটাতে হবে। টিউশনির কি কোন ভবিষ্যৎ আছে? লোকের দরজায় দরজায় কুকুর বেড়ালের মত
লাথিঝাঁটা খাওয়া। এখন তো টিউশনি করেই কোনরকমে সংসারের হাল টানছি। বাড়িতে বিধবা
মা আর কলেজে পড়া এক বোন রয়েছে। বোনের বিয়েও দিতে হবে। কোথায় পাবো অত টাকা। সাত
বছর আগে বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। এক পয়সাও পুঁজি রেখে যেতে পারেননি।
আমারও বিয়ের বয়স হয়েছে। কিন্তু বিয়ে করতে পারিনি। এতেই সংসার চলে না। তার উপর
আমি সংসার করে আর খরচ বাড়াতে চাইনি। তাছাড়াও বোনের বিয়ে না দিয়ে নিজে বিয়ে
করি কী করে?”
- “আরে ছোকরা তোর
অবস্থা তো আমার মতই। এই অন্ধকারে তোকে যখন প্রথম দেখলাম তখন ভাবলাম তোর কাছে মাল
আছে। তোকে নিংড়ে তোর রস বের করে নেব। এখন দেখছি তোকে নিংড়াতে গেলে তো তুই ছিবড়ে
হয়ে যাবি। মরা কে মেরে লাভ কী! ধর্ম বলে তো একটা জিনিস আছে। দেহব্যবসা করতে পারি
কিন্তু মানুষের দুঃখ কষ্ট বুঝি তো! অনেক দুঃখ কষ্ট পেয়েই এই লাইনে আসতে বাধ্য
হয়েছি। লোকে আঙুল তুলে বেশ্যা বলে। কখনো প্রকাশ্যে কখনো আড়ালে গায়ে থুতু দেয়।
ঘেন্না করে। মাথা উঁচু করে সমাজে বাঁচতে পারি না। তবু পেটের দায়ে সব সহ্য করতে
হয়। কিন্তু কি জানিস ওই শালা যত বাবু দেখছিস যারা রাতের অন্ধকারে এখানে আসে আমরা
যদি না থাকতাম শালারা রোজ ধর্ষণ করত। রাস্তাঘাটে আর সব মেয়েরা চলাফেরা করতে পারত
না। তবু শালা সমাজ আমাদেরকে গালাগালি দেয়, থুতু দেয়, ঘেন্না করে। আর
শালা ওই সব বাবুগুলো মুখোশ পরে সমাজে ভদ্রলোক সেজে ঘুরে বেড়ায়। এই ছোকরা যা তুই
বাড়ি চলে যা। তোর অনেক সময় নষ্ট করলাম। আমি অন্য খদ্দের খুঁজে নেব। দেখি যদি
ভগবান কাউকে জুটিয়ে দেয়।”
- “আচ্ছা একটা কথা বলবো
তোকে?”
- “কী বলবি? বল।”
- “বলছিলাম তোকে যদি
আমি একশো টাকা দিই তাহলে তোর আজকের রাতের খাবারটা হবে?”
- “হ্যাঁ তা হবে।
কিন্তু আমাকে টাকা দিলে তোর চলবে কী করে? তুই বাজারই বা করবি কী করে?”
- “সে চিন্তা নেই। আমার
কাছে আরো একশ টাকা তো থাকবে। আজ অল্প কিছু মাল কিনে নিয়ে যাব। বাকিটা কাল কিনে
নেব।”
- “তুই শালা একটা বেকার
ছেলে, এত বড় দরাজ মন তোর! তুই
মানুষ না ভগবান? তোর নিজের সংসারেই
নুন আনতে পান্তা ফুরোয় আর তুই আমাকে একশো টাকা এমনি এমনি দিয়ে দিবি। এমন তো আগে
কাউকে দেখিনি। তুই আমার কে?”
- “কে আবার, ভেবে নে আমি তোর একটা ভাই। বৃষ্টিভেজা রাতের
অন্ধকারে এই ব্রিজের তলায় আমি বহুদিন পর তোকে খুঁজে পেলাম।”
- “তুই আমার ভাই! তোর
কথা শুনে আমার চোখে কেন জল আসছে রে? মনে হচ্ছে বুকের উপর একটা ভারি পাথর এতদিন কে যেন চাপিয়ে রেখেছিল। তুই
এসে হঠাৎ সেটা সরিয়ে দিলি। দ্যাখ দ্যাখ আমি এখন কেমন বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছি।
আমার কষ্টগুলো যন্ত্রণাগুলো এখন ভালোবাসার ঢেউয়ে নাচছে। এই রাতের অন্ধকারে আকাশের
হাজার হাজার তারা যেন আমাকে ডাকছে। বুঝলি ভাই, আমি বিপদে আপদে ভগবানকে ডেকেছি কিন্তু কোনদিন তাকে দেখিনি। কিন্তু কি
আশ্চর্য! আজ এই সন্ধ্যায় তোকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সত্যি সত্যিই জ্যান্ত ভগবান
স্বর্গ থেকে এসে আঁধারে আলো হয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ভালো থাকিস ভাই।”
গল্পটা অসাধারণ হতে পারত। শুধু অতি কথনে সামান্য বিরক্তির উদ্রেক করেছে। সংলাপগুলো আরও ঠিকঠাক হলে জমে যেত।
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন