রতন একটা টুল নিয়ে বসে পড়ল মাছ কাটার জায়গায়, রঘু জেলে একটা স্টিলের চামচ নিয়ে ঘষে ঘষে
মাছের আঁশ গুলো ছাড়াচ্ছে। রতনের দিকে একবার আড়ালে দেখে নিয়ে আবার কাজে মন দিল।
আজ সুমির বিয়ে, সুমি ওর বড় মামার মেজ মেয়ে। পরশু থেকে এসেছে রতন, মামা বলেছিল, “ক’দিন আগে থেকে আসবি রতন, একটু
তদবির তদারক করবি, তোরই তো বোনের
বিয়ে”।
তা কদিন ভালই খাটুনি চলছে রতনের, ফর্দ ধরে মুদিখানা আনা,
ভোর ভোর গিয়ে মায়াপুরের হাট থেকে সব্জি নিয়ে আসা, মিষ্টির ভিয়েনের তদারকি থেকে শুরু করে সমস্তই।
অবশ্য বড় মামার ছেলে গৌতমও সঙ্গে যাচ্ছে, কিন্তু সে সবে ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র, এখনো সাবালক হয়নি, তাই
মামার ভরসা বলতে রতনই। আর শুধু মামাই বা কেন, মামীমা, দিদা, রাধুনি, কাজের মাসী সবাই কোনো না কোনো দরকারে কাল থেকে রতনকে হাঁক দিচ্ছে। রতন ও
এসব ব্যাপারে এক পায়ে খাড়া। আত্মীয়স্বজনদের যেকোন বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশন বাড়িতে রতনের এরকমই চাহিদা। রতন সেটা উপভোগ করে, কেউ কেউ বলে এতো খাটিস কেন রতনা, বাকিরা সব পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করছে আর তুই
খেটে মরছিস! একটু বোস দিকিনি!
রতন হেসে বলে, “সে কি গো, আমারই তো অমুকের
বিয়ে কি পৈতে কি ভুজনো, আমি খাটবো
না তো কে খাটবে”।
ছোটবেলা থেকেই এই একটা জিনিস খুব ভাল পারে রতন, খুব খাটতে পারে, আর দায়িত্বও নিতে পারে, শুধু
লেখাপড়াতেই একটু কমতি এই যা। কোনরকমে ঘষেঘষে হায়ার সেকেন্ডারিটা সেকেন্ড ডিভিশনে
পাশ করে ওদিকটা উদযাপন করে দিয়েছে। বাবা বলে, “তুই কি কুটুমদের কাজবাড়ি উদ্ধার করেই জীবনটা কাটিয়ে দিবি! নিজের
ভবিষ্যতের দিকে একটুও তাকাবি না?”
রতন তখন কিছু না বললেও মনে মনে ভাবে মামার বাড়ি, পিসির বাড়ি, দাদার শ্বশুরবাড়ির লোক এরা সবাই ওকে এত ভালবাসে,
ওকে সবাই মাথায় করে রাখবে। নিজেকে নিয়ে চিন্তিত নয় সে, আত্মীয়স্বজনের পালে পার্বনে, বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াবে না কি করবে!
এই তো কদিন আগেই মেজপিসির শাশুড়ি মরমর, রতনের ডাক পড়লো কোলকাতার পিজি হাসপাতালে নিয়ে
যাওয়ার জন্য। রতন পিসেমশাইকে সঙ্গে করে ঠাকুমাকে পিজিতে ভর্তি করলো, আট দিন পর সুস্থ করে তারপর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে
তবে ওর ছুটি।
পিসেমশাই সেদিন পৌঁছে দিয়ে তারপর চলে এল, পিসেমশাই চাকরি করে, কতো কাজ, তার থাকলে চলবে
কেন!
রতনই এই মাঝের কদিন ভিজিটিং আওয়ারে রোগীর সাথে
দেখা করত, ওষুধপত্র ফলমূল কিনে দিত, ফুটপাথের দোকানে পাউরুটি, ঘুঘনি, টোষ্ট খেত। রাতে থাকত ধর্মশালায় আর লাঞ্চ-ডিনার করত পাশাপাশি ফুটপাথেরই
একটা হোটেলে।
“মাছ কাটা হয়ে গেছে
ভাগ্না বাবু, এবার রান্নার কাছে
নিয়ে যেতে বল”, রঘু জেলের কথায়
সম্বিত ফিরে পেল রতন। শশব্যস্ত হয়ে কাজের লোক শম্ভুকে হাঁক দিল, “ও শম্ভুদা, মাছগুলো ঝুড়ি করে রান্না চালায় নিয়ে যাও, এখুনি ভাজা হবে” ।
তারপর আমবাগানের যেদিকটায় খাসি কাটা হচ্ছিল, সেদিকে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল, ওদিকটাও নজর রাখতে হবে,
মামা বলেছে, “রতন
খাসির মাংসে যেন বেশি জল না ঢোকায় খেয়াল রাখবি, জল ঢুকলেই ওজনে বাড়বে, তাতে
আমাদের লস”। গাছের নীচু ডালে ঝুলিয়ে খাসির ছাল ছাড়ানো হচ্ছে, রতন একটা চেয়ারে বসে কড়া নজর রাখল।
সারাদিন দৌড়োদৌড়ি করে কাটানোর পর বিকেলে আর এক
ফ্যাচাং, সুমি বলল, “ও রতনদা, বিউটি পার্লারে সাজতে যাবো, বাবা বলেছে রতনকে সঙ্গে নিয়ে যাবি”। তা কি আর করা যাবে, ছোট বোন বলে কথা, তার ওপর কনের সাজ সাজতে যাবে, নিয়ে যেতে তো হবেই। রতন বলল, “দেখ সুমি, কনে সেজে আসবি
যখন বাইকে গেলে হবে না, সৌরভের
মারুতি ওমনিটা বলে দিই। মামাকে বলিস ভাড়াটা দিয়ে দিতে”।
এমন করে বিয়েবাড়ি কাটল, সুমি যাবার সময় বললে,
“আমার ঘরে একটা অ্যাটাচিতে আমার জিনিসপত্র সব গোছানো আছে, বৌ-ভাতের দিন যখন যাবে ওটা নিয়ে যেয়ো রতন দা, গাড়িতে আর জায়গা নেই”। কি আর করা যাবে, ছোট বোনের অনুরোধ, বৌ-ভাতের নেমন্তন্ন খেতে যাবার বাসেও রতন একটা ঢাউস অ্যাটাচি হাতে উঠে
বসল।
বিয়েবাড়ির শেষে মামা বললে, “রতন রে সব এলোমেলো হয়ে আছে, কটা দিন থেকে একটু গুছিয়ে দিয়ে যা না বাবা”।
অগত্যা রতনকে আরো দিন চারেক থেকে সব গুছিয়ে দিয়ে আসতে হল।
কদিন বাড়িতে থেকে আবার মেজপিসির নাতনির
অন্নপ্রাশনে যেতে হবে সেখানেও রতনকে ছাড়া চলবে না। রতন একদিন আগে থেকে গেল, মেলা কাজ! ডেকরেটর থেকে আনা কড়া গামলা, ডেকচি, সব লোক দিয়ে মাজানো থেকে শুরু করে ক্যাটারারের দল ঠিক মতো পরিবেশন করছে
কি না সমস্তই ওকে দেখতে হল।
দুপুরে সবার শেষে পিসতুতো ভাই হারুর সঙ্গে যখন
খেতে বসল তখন চারটে বেজে গেছে। মাছের মাথা দিয়ে পুঁইশাকের তরকারিটা অপূর্ব
হয়েছিল, ওটা দিয়েই দু থালা ভাত
খেয়ে নিল রতন। পরে যখন মাছ, মিষ্টি, দই এসব আসছে তখন আর ওর পেটে বিশেষ জায়গা নেই।
পিসতুতো ভাই বোনেরা সবাই হাসাহাসি করতে লাগল, “কি রতনদা, পুঁইশাক দিয়ে
পেট ভরিয়ে ফেললি, দই রসগোল্লার কি
হবে”!
রতন বললে, “আরে পেট ভরা নিয়ে তো কথা, তৃপ্তি
করে খেয়েছি এই ব্যস, কি দিয়ে পেট
ভরেছে তাতে কি যায় আসে”!
তবে শুধু যে কাজবাড়ি থাকলেই রতন কুটুমবাড়ি
যায় তা কিন্তু নয়। রতনের মা বলে, “তোর পায়ের তলায় সর্ষে আছে”। রতন বেশিদিন বাড়িতে বা একজায়গায় থাকতে
পারে না। বাড়িতে দাদা সংসার চালিয়ে নেয়, ও তেমন রোজগারও করে না, সংসারের
ব্যাপারে মাথাও ঘামায় না। বরং ঘামাতে গেলেই খটাখটি। কদিন ঘরে থাকলেই মনটা
হাঁফিয়ে ওঠে, ওর সেই পায়ের তলার
তথাকথিত সর্ষেগুলো সুড়সুড়ি দেয় যেন, একটা ব্যাগে গামছা, সাবান, টুথব্রাশ আর খানকতক লুঙ্গি, জামা, প্যান্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
সঙ্গে ছোট ফোন ধরা ছাড়া মোবাইলটা, এর মাধ্যমেই যোগাযোগ হয়ে যায়। ছোট মামার ছেলে
তমাল কলকাতার হোস্টেলে ভর্তি হবে, তাকে
বাক্স-বিছানা সহ পৌঁছে দেবে কে? না, রতন। মেজমাসির বাতের ব্যাথাটা বেড়েছে, তিন মাইল দুরে বিশালাক্ষ্মী মায়ের মন্ত্র পড়া
তেল নিয়ে পৌঁছে দেবে কে? সেই রতন।
এ ছাড়াও এমনিতেই এখান ওখান যায় রতন, মামাবাড়ি থেকে পিসিবাড়ি, সেখান থেকে, মামাতো পিসতুতো যে সব বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে তাদের শ্বশুরবাড়ি, গিয়ে বলে, “সবাই কেমন আছো দেখতে এলুম, মনটা
কেমন করছিল”।
সবার ঘরেই ওর অবারিত দ্বার, সবাই কে দেখাও হল, তাদের কোন কাজকর্ম আটকে গেলে সেটাও উদ্ধার হল। এই তো সেদিন সুমির শাশুড়ি
বললে, “বাবা রতন, অনেক দিন ধরেই ভাবছি গুরুবাড়ি গিয়ে একবার
গুরুদেব কে শেষ দেখা দেখে আসবো, গুরুদেব
খুবই অসুস্থ! তুমি কি একবার আমাকে নিয়ে যেতে পারবে?
তাহলেই বোঝ! এবার সেই বিষ্ণুপুর ছুটতে হল
গুরুদেব কে দর্শন করাতে। রতন কখনোই অকাজে দৌড়োদৌড়ি করে না।
রতন এরকম ভাবেই তার দিন চালিয়ে যেতে লাগল, কালে সকলেরই বয়স বাড়ে, রতনেরও হল। রতনের বয়স এখন চল্লিশ, দুপাশের জুলফিতে সামান্য রূপোলি ছোঁয়া। বাবা
গত হয়েছেন মাস ছয়েক হল, মা এখনও
টিমটিম করে টিকে আছেন। রোজগার নেই বলে বিয়েটাও করা হয়নি। অবশ্য এ নিয়ে রতনের
কোন আফশোষ নেই। ও বলে, “আরে সবাই
বিয়ে করলে বাকিদের কে দেখবে? নিজের
ঘর সংসার নেই বলেই তো সবার বিপদে আপদে দেখতে পারছি”। মা বলেন, “আমি মরলে তোকে দেখার কেউ থাকবে না রে রতন। এই
বেলা বিয়েটা করে নে। জমিজমা দু-চার বিঘে যা ভাগে পাবি তার সঙ্গে দু-চারটে
বাচ্চাকে টিউশনি পড়ালে কোনোরকমে চলে যাবে”। রতন হেসে উড়িয়ে দেয়।
তবে, ইদানিং রতনও খেয়াল করেছে যে কুটুমবাড়ি গেলে আদর-আপ্যায়ণ একটু ভাটার
দিকে, পিসতুতো, মাসতুতো, মামাতো ভাই বোনেদের সব বিয়ে হয়ে গেছে। বোনেদের শ্বশুরবাড়ি গেলে তাও
খাতির করে বসায় কিন্তু ভাইদের বউয়েরা রতনকে ততটা আমল দেয় বলে মনে হয়না। সে না
দিকগে, রতন তো সবাইকে ভালোবাসে, খবর নিতে যেতে কি আর অসুবিধে। রতন যথারীতি তার
ভ্রমণ চালিয়ে যায়।
এরকমই এক সকালে রতন অনুভব করল তার পায়ের তলায়
সর্ষে। বেশ কিছুদিন কোথাও যাওয়া হয়নি, ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রতন। কেশবপুরে সুমির শ্বশুরবাড়ি, অনেকদিন যাওয়া হয়নি, শেষবার গিয়েছিল সুমির শাশুড়ির শ্রাদ্ধে। ওর নিজের যেহেতু কোন বোন নেই, তাই মামাতো বোনের ওপর একটা বাড়তি টান আছে।
“যাই, গিয়ে দেখে আসি বোনটা কেমন
আছে”, এই মনে করে বাসে উঠে বসল রতন।
মাঝে বাস ছিল না অনেকক্ষণ, তাই যখন
পৌঁছল তখন বেলা একটা প্রায়। জামাই স্কুলমাষ্টার, আজ সোমবার এখনও স্কুল থেকে ফেরেনি। তা বেকার রতনের তো আর রবিবার সোমবার
খেয়াল থাকে না। সুমি ছেলেকে ভাত মেখে খাওয়াচ্ছিল, ওকে দেখে যেন অপ্রস্তুত হল একটু। শুকনো গলায় বলল,
“ও রতনদা, এসো”।
রতন দুয়ারে রাখা বেতের মোড়াটার ওপর জমিয়ে বসে
বললে, “তারপর, সবাই কেমন আছিস বল”। সুমি ছেলেকে খাওয়ানো শেষ
করে একটা প্লেটে করে চারটে মিষ্টি আর জল দিয়ে বললে, “জলটা খেয়ে একটু বোসো, রান্না
তো হয়ে গেছে, তোমার জন্য আবার ভাত
বসাতে হবে, একটু তো খবর দিয়ে
আসবে!” রতন হো হো করে হেসে বললে, “আরে
আমি কি কখনও খবর দিয়ে এসেছি! রাস্তায় বেরিয়ে তারপর ঠিক করি কোথায় যাবো।
তাছাড়া যে তিথি নক্ষত্র গণনা না করে আসে সেই তো অতিথি, বলে কয়ে এলে আর অতিথি কিসের”?
সুমি রান্নাঘরের দিকে চুপচাপ চলে গেল, রসিকতাটা ওর খুব একটা মনঃপুত হয়নি সেটা রতনও
বুঝতে পারল। বিকেলে জামাই এসে বললে, “দাদা কি কাল সকালেই বেরোবেন”? রতন একগাল হেসে বললে, “কাল
সকালেই কি হে। সবে তো আজ এলাম, দু
চারদিন থেকে যাবো ভাবছি। এখান থেকে আবার মেজ পিসির বাড়ি যাব ভাবছি, পিসির শরীরটা খুব খারাপ, একবার খবর নিয়ে যাবো”।
রাতে পশ্চিম দিকের ঘরটায় থাকার ব্যবস্থা হল
রতনের। রতনের কোন ভাবনা চিন্তা নেই, তাই ঘুমও খুব গাঢ়। রাত বারোটা নাগাদ তর্কাতর্কির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল
রতনের, সুমি আর জামাইয়ের ঘর থেকেই
শব্দ ভেসে আসছে, মাঝে কেবলমাত্র
একটা ডাইনিং স্পেসের ব্যবধান। শব্দ গুলো সহজেই কর্ণগোচর হল রতনের, তাছাড়া বোধহয় ওকে শোনানোর জন্যই একটু উচ্চস্বরে কথাগুলো বলছিল জামাই, “আমি কাল স্কুলে যাবো আর তুমি ঐ আইবুড়ো
কাত্তিকের সাথে সারাদিন কাটাবে? এত
ঘন ঘন আসে কেন আমি বুঝি না ভেবেছো? আমি
কি ঘাসে মুখ দিয়ে চরি?”। সুমি পাল্টা
তর্কের সাথে চাপা গলায় জামাই কে থামাবার চেষ্টা করছে।
রাতে আর ঘুম হয়নি রতনের। ঘুমোবার প্রয়োজনও বোধ
করে নি। ভোর বেলা উঠে দেখল সদর দরজা চাবি দেওয়া আছে কি না।
নাঃ, শুধু ভেতর থেকে ছিটকিনি দেওয়া। রতন দরজা খুলে সোজা বাসস্ট্যান্ডে, প্রথমে যে বাসটা পেল সেটাই ধরল, কোথায় যাবে বাসটা কে জানে!
মাঝরাস্তায়, কি মনে করে একটা নাম না জানা স্টপেজে নেমে পড়ল রতন, তারপর ইতস্তত হাঁটার পর একটা অশ্বত্থ গাছের
তলায় বসে পড়ল। এখন শীতকাল, আশেপাশের
গাছগুলোর পাতা সব ঝরে গেছে। ডালপালাগুলো রিক্ত হয়ে যেন দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
রতনের ভেতরটা কেমন যেন খালিখালি লাগছে। আজ এই
প্রথম সে নিজেকে এমন রিক্ত, নিঃসঙ্গ
অনুভব করল, তারপর জীবনে প্রথমবারের
জন্য ডুকরে কেঁদে উঠল রতন। শীতকালীন শুকনো খটখটে মাটিতে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়েই
সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে গেল।
ভালো লাগল বেশ।
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন