স্মার্ট ওয়াচের স্ক্রীনে দেখলাম রাত একটা! খানিক আগেই নিউটাউনে বিশ্ব বাংলা গেট ক্রস করে ডানদিকে বড় রাস্তা ছেড়ে সার্ভিস রোড বরাবর একটু যেতেই খালপাড় সংলগ্ন কাঁচা-পাকা রাস্তাটা ধরলাম। অফিসে আজকেই ছিল প্রজেক্ট জমা দেবার ডেড-লাইন অর্থাৎ শেষ দিন। ভেবেছিলাম রাত দশটার মধ্যে সব মিটে যাবে। কিন্তু, প্রজেক্ট রেডি করে, সমস্ত কিছু দেখে জমা করতে রাত্রি সাড়ে বারোটা বেজে গেল। আগামীকাল এবং পরশু দুদিনই অফ ডে, তাই যত রাতই হোক না কেন একবার বাড়ি ফিরতে পারলে নিশ্চিন্ত। প্রায় তিন বছর পরে কিছুদিন হল গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে নিয়েছি। বাইপাসে আমার একটা অ্যাক্সিডেন্টের পরে ডাক্তার এবং বাড়ির লোক আর গাড়ি চালাতে বারণ করে দিয়েছিল। কারণ সেবারে অ্যাক্সিডেন্টের ফলে মাথায় চোট লাগে। সাময়িক স্মৃতিভ্রষ্ট হয়। পরে যখন আমার নার্সিং হোমে জ্ঞান ফেরে তখন প্রায় কিছুই মনে ছিল না। পরে জেনেছিলাম, আমাকে যখন উদ্ধার করা হয় তখন গাড়িটার ইঞ্জিনের সামনের অংশ ভাঙা ছিল! আমার মাথার সামনের অংশ গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের ওপরে ঝুঁকে ছিল এবং সেখান থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছিল। অর্থাৎ আমি গাড়ি নিয়ে, আমার সামনে থাকা কোন বাস বা লরির পিছনে ব্রেক ফেল করে অথবা অন্য কোন কারণে স্বজোরে ধাক্কা মেরেছিলাম। গাড়ির এয়ার ব্যাগ খোলার জন্য মাথাটা গুরুতর আঘাত পাওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছিল। পরে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়। স্মৃতি ফিরে এলেও এখনও মাঝে মাঝে অনেক কিছু ভুলে যাই। বিশেষ করে ওই অ্যক্সিডেন্টের দিনের কথা আমার কিছুই মনে নেই। তাই কি ভাবে এবং কোন পরিস্থিতিতে সেদিন অ্যক্সিডেন্ট হয়েছিল তা এক অজানা রহস্যময় অধ্যায় হিসাবে আমার জীবনে রয়ে গেছে।
শেষ কবে এত রাত্রে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরেছি
আমার ঠিক মনে নেই। প্রথমে ভেবেছিলাম অফিসেই থেকে যাব। কিন্তু, পরে ভাবলাম আবার সেই সকালে উঠে যাবার ঝামেলা, রাত্রে খাবার ব্যবস্থা করা এর থেকে একটু কষ্ট
করে বাড়ি চলে যাওয়া ভালো। যে রাস্তাটা ধরলাম, গুগল ম্যাপে দেখলাম সেটা সোজা গিয়ে বাইপাসে উঠবে,
অনেকটাই শর্টকার্ট তাই সময়টা কম লাগবে। এই রাস্তা দিয়ে
কখনও গেছি কিনা মনে করতে পারলাম না। ভুলে যাবার রোগ বা ডিমেনশিয়া নেচার ঠিক হতে
ডাক্তার বলেছেন আরও সময় লাগবে। তার জন্য ওষুধও চলছে। রাস্তাটা বেশ শুনশান, তার সাথে চারিদিকে ভেঙে গর্ত হয়ে প্রায়
পুরোটাই খারাপ হয়ে গেছে। তবুও এসবের মধ্যেই বেশ জোরেই গাড়িটা ছোটাতে লাগলাম। বাম
হাতের স্মার্ট ওয়াচের ভয়েস বলছে, রাত্রি
দেড়টা! নিউটাউন থেকে সুদূর গড়িয়া অবধি আমার রোজকার বাড়ি থেকে অফিস যাওয়া আসা
করতে হয়। অফিস শুরুর প্রথম ছয় মাস বাসে করে, যাতায়াত করতে দু-ঘণ্টার ওপর সময় লেগে যেত। অগত্যা নিরুপায় হয়ে এই
গাড়িটা কেনার ব্যবস্থা করতে হয়। ভাঙা রাস্তাটা ধরে মোটামুটি স্পিডে গাড়ি চালাতে
চালাতে খেয়াল করলাম বাইপাসের রাস্তাটা প্রায় এসেই গেছে। এরপরে রাস্তাটা বাঁদিকে
বেঁকে গেছে। গাড়িটা রাস্তা অনুযায়ী বাঁদিকে ঘোরাতেই, আচমকা...
জোরে ব্রেক মারলাম। গাড়িটা বেসামাল হয়ে
সামান্য ঘুরে, চাকা আর মাটির ঘর্ষণে
ধুলো উড়িয়ে সেটা কোনওরকমে থামল। সাদা রঙের শার্ট, ব্লু-জিন্স, পায়ে হাল্কা
হিল জুতো পরা অবস্থায় রাস্তার ওপরে আড়াআড়ি ভাবে একটা মেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে
রয়েছে। মেয়েটির সামনের জায়গাটা রক্তে লাল হয়ে আছে। সামনে রাস্তার ওপরের পুরো
দৃশ্যটাই আমার গাড়ির হেডলাইটে, ধুলোর
মধ্যেও স্পষ্ট হয়ে উঠল। মেয়েটির অবস্থা দেখে আন্দাজ করলাম আমার ঠিক আগেই কোন
গাড়ি ধাক্কা মেরে বেরিয়ে গেছে! মেয়েটিকে দেখার পরে কি করব বুঝতে পারছিলাম না।
এই রাত দুপুরে এরকম একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে কখনও ভাবতেই পারিনি। আফসোস
হল, কেন এই সময়ে শর্টকাট ধরে আসতে
গেলাম? এর চেয়ে অফিসে যদি থেকে
যেতাম তাহলে ভালো হত। মেয়েটি বেঁচে আছে কিনা গাড়িতে বসে থেকে বুঝতে পারলাম না।
যদি আমি মেয়েটিকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে নিয়েও যাই, মাঝ রাস্তায় কিছু হলে সব দায় আমার ওপরেই পড়তে পারে। তার ওপরে পুলিশের
ঝামেলা তো রয়েছেই। এখন আশেপাশে যদি কোন লোক আমায় দেখে নেয়, তাহলে আরেক বিপদ। ওরা ভেবেই নেবে যে আমিই হয়তো
জোরে গাড়ি চালিয়ে এসে মেয়েটিকে ধাক্কা মেরেছি।
গাড়ি থেকে নেমে পিছনের সিটে আস্তে করে
মেয়েটিকে কোনওরকমে রাস্তা থেকে তুলে শুইয়ে দিলাম। মেয়েটিকে গাড়িতে তোলার আগে
তার হাতের কব্জির কাছে নাড়ি ধরে দেখলাম পালস্ রেট কম হলেও রয়েছে! তার মানে
মেয়েটি জীবিত, ঠিক সময়ে হাসপাতালে
নিয়ে গেলে বেঁচে যাবে। মেয়েটির কপালের ডানদিকটা অনেকটা কেটে গেছে, সেখান থেকে রক্ত পড়ছে। মেয়েটির জামাটা রক্তে
ভিজে প্রায় পুরোটাই লাল হয়ে গেছে। আমার প্যান্টের পকেট থেকে রুমালটা বার করে
কোনওরকমে মেয়েটির কপালে কাটা জায়গাটা বেঁধে দিলাম। ভাবলাম তাতে যদি রক্ত পরাটা
একটু বন্ধ হয়। মনের দোলাচল কাটিয়ে ভেবেছিলাম এইভাবে মরণাপন্ন একজনকে ফেলে চলে
গেলে সেই ভাবনা আর অনুশোচনা থেকে পরে কিছুতেই আমি বেরোতে পারব না। সারাদিন
মেয়েটির রক্তাক্ত শরীরের ছবি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠবে! তাড়াতাড়ি করে গাড়ি
স্টার্ট দিলাম, মেয়েটি বেঁচে থাকবে
কিনা বুঝতে পারলাম না। মেয়েটির কাঁধে একটা ব্যাগ ঝোলানো ছিল। ভাবছিলাম ব্যাগটা
খুলে দেখব যে ভেতরে কোন আই কার্ড বা পরিচয় পত্র পাওয়া যায় কিনা! তাহলে মেয়েটার
অন্তত নাম আর ঠিকানা জানতে পারলে তার বাড়িতে একটা খবর দেওয়া যাবে। কিন্তু, তারপরে কি মনে হল আবারও মেয়েটির হাতের কব্জির
কাছে নাড়ি টিপতেই অনুভব করলাম পালস্ প্রায় না পাবার মতনই! তার ওপর আমার মনে ভয়
আর উত্তেজনা থেকে মাথা ঠিক মতন কাজই করছিল না। আর এক মুহুর্তও দেরী না করে গাড়ি
স্টার্ট দেবার পরে, তড়িঘড়ি সেখান
থেকে বেরিয়ে এসে বাইপাসের রাস্তায় উঠে গাড়ির স্পীড প্রায় ডবল করে দিলাম। হঠাৎ
পার্থদার কথা মনে পড়ে গেল। আমার মাসতুতো দাদা যে এখন কসবা থানার সাব-ইন্সপেক্টর।
ওর কথাটা তো ভুলেই গেছিলাম। পার্থদার কথা মনে পড়তেই এক সেকেন্ডও দেরী না করে
গাড়ি চালনো অবস্থায় পার্থদাকে ফোন করলাম। স্টিয়ারিংয়ের সামনে স্পিডোমিটারের
উপরের জায়গায় রাখা মোবাইল হোল্ডারে ফোনটা রেখে স্পিকারে কথা বলতে লাগলাম। গাড়ি
তখন সাইন্স সিটির দিকে ছুটছে, ততক্ষণে
স্পীড একশো ছাড়াল!
রুবি
মোড়ের সামনে একটি বেসরকারী হাসপাতালের সামনে নিয়ে যেতে বলেছিল পার্থদা। নাহলে
অন্য কোন জায়গায় নিয়ে গেলে পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হত! ভাগ্যক্রমে আর কিছুদিন
পরেই দুর্গা পুজো তাই আজ থেকেই পার্থদার নাইট ডিউটি পড়েছে। সে হাসপাতালে অন্য
অফিসারও পাঠাচ্ছে। বলল আমার কোন অসুবিধা হবে না, পার্থদা নিজেও আসবে এবং যা ব্যবস্থা নেবার সে নিজেই নেবে। শুধু আমায়
মেয়েটিকে পৌঁছে দিতে বলেছিল। খানিক নিশ্চিন্ত হতে সমান জোরেই গাড়ি ছোটাতে লাগলাম, মনে মনে প্রার্থনা করলাম মেয়েটি যেন অন্ততঃ
প্রাণে বেঁচে যায়। ভিআইপি নগর ঢোকার আগে আচমকা রিয়ার মিররে কিছু দেখতে পেয়ে
আতঙ্কিত হয়ে ওই স্পীডে গাড়ি চলা অবস্থায় ব্রেক মারলাম! গাড়িটা প্রায়
পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী রাস্তার বাম দিকে বেঁকে প্রচণ্ড শব্দে ধুলো বালি উড়িয়ে থামল।
রাস্তায় গাড়িটা থামার আগে টায়ারগুলো এতটাই ঘষা খেয়েছে যে রাস্তায় গোল গোল
চাকার দাগ রাতের আলো আঁধারিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। গাড়িটা থামার কয়েক সেকেন্ডের
মধ্যেই এসি চলা অবস্থাতাতেও ঘামতে শুরু করলাম কারণ পিছনের সিটে শোয়ানো মেয়েটি
উঠে বসেছে! মাথায় বাঁধা আমার রুমালটাও রক্তে ভিজে পুরো লাল হয়ে গেছে।
“হ্যালো! আমি মেহেরিন নূর, পার্ক
সার্কাসের কাছে আমার বাড়ি। এটা আমার অফিসের আই ডি কার্ড!” খুবই শান্ত কিন্তু বেশ
ধরা গলায় কথাগুলো বলার পরে মেয়েটি তার শার্টের পকেট থেকে একটা আই ডি কার্ড বার
করে আমার হাতে দিল। পিছনে মুখ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থেকেও আমি যে কিছু উত্তর
দেব, ঘটনার আকস্মিকতায় ততক্ষণে
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কোন কথাই যেন মুখ দিয়ে আর বেরোচ্ছে না। হঠাৎ
দেখলাম, আমার রুমালটা বাঁধা
অবস্থায় যে মেয়েটির মাথায় ছিল, সেটা
এখন আর নেই! মেহেরিনের চোখগুলো আগের থেকে অপেক্ষাকৃত অনেকটাই লাল হয়ে আছে। কিন্তু, যেরকম ভাবে মাথাটা ফেটেছে সেই তুলনায়
মেহেরিনের মুখে যন্ত্রণার কোন ছাপই নেই। আমি ওর দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম না, মুখটা সামনে করে নিলাম। পিছন থেকে মেহেরিনের
কথাগুলো কানে এল, “আমার অফিস নিউ
টাউনে বিশ্ব বাংলা গেটের সামনে। অফিস থেকে আজ বেরোতে রাত হওয়াতে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য ওই খালপাড়ের
রাস্তাটা ধরে রাস্তাটার নিউ টাউনের মুখ থেকে একটা ই-রিক্সা ভাড়া করে আসছিলাম।
রিক্সাওয়ালা আমাকে ডবল ভাড়ার বিনিময়ে আমাকে বাইপাস অবধি নিয়ে যাবার জন্য রাজি
হল। রিক্সা নিয়ে প্রায় বাইপাসের কাছাকাছি চলে এসেছে, ঠিক তখনই পিছন থেকে একটা বড় কালো গাড়ি এসে রিক্সার বাম দিকের পিছনে
চাকার ওপরে মেরে বেরিয়ে যায়। গাড়িটা ধাক্কা মারার ফলে রিক্সাটা রাস্তার ডানদিকে
উল্টোদিকে হেলে যেতেই আমি আর রিক্সাওয়ালা দুজনেই ছিটকে রাস্তার ধারে পড়ে যাই।
আমার মাথাটা রাস্তার ওপরে পড়ে থাকা একটি ইঁটের ওপরে কপালটা লেগে অনেকটা কেটে
যায়।
আমি যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকি। রিক্সাওয়ালা
ছিল একজন কমবয়েসী ছেলে। সে পড়ে যাবার পরে, নিজেকে ঠিক সামলে নিয়ে উঠে পড়ে। আমাকে ওরকম অবস্থায় দেখেও কোনওরকম
ওঠানোর চেষ্টা না করেই আমাকে ফেলে রেখে উল্টে আমার হাত থেকে ছিটকে যাওয়া
মোবাইলটাও কুড়িয়ে নিয়ে নিল। নাহলে অন্তত অফিসে ফোন করে সাহায্য চাইতে পারতাম।
তার ওপর ছেলেটাকে সামান্য একটু জল খেতে চেয়েছিলাম, সেটাও দিল না। মুহুর্তের মধ্যে তার উল্টে যাওয়া রিক্সাটা সোজা করে নিল।
পিছনের দুটো চাকা ভেঙে বেঁকে গেলেও, সেটা নিয়েই টানতে টানতে ঠিক বেরিয়ে গেল। রাস্তাটা এমনিতেই শুনশান তার
ওপর অন্ধকার ছিল। আমি কারও কাছে কোনওরকম সাহায্যও পেলাম না।”
গাড়িটা আবার আমি স্টার্ট দিলাম। মেয়েটিকে আমার
জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে যতটা সম্ভব আবারও জোরে গাড়ি চালাতে শুরু করলাম। মনে মনে
একটাই সান্ত্বনা ছিল যে মেয়েটি বেঁচে আছে। মেহেরিন আবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে শেষে
একটা কথাই বলেছিল, তার যদি কিছু
হয়ে যায়, আমি যেন তার বাড়িতে খবর
দিয়ে তার আম্মির হাতে ব্যাগটা যেন তুলে দিই। বলে সে তার ব্যাগটা আমার দিকে
বাড়িয়ে দিল, আমি সেটা পাশের সিটে
রেখে দিলাম। আমার গলা দিয়ে তখনও কোন কথা বেরোচ্ছে না, উত্তরে শুধু “হুঁ” বললাম। একটাই ফিরতি কথা মেহেরিন বললো, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। আমি পড়ে থাকা
অবস্থায় অনেক গাড়িকেই হাত দেখিয়েছি কিন্তু কেউ দাঁড়ায়নি। আপনি অন্ততঃ
মানবিকতার খাতিরে দাঁড়ালেন। আমাকে হাসপাতালেও নিয়ে যাচ্ছেন। যদি...” মেহেরিন
হঠাৎ চুপ করে গেল।
প্রায় চার পাঁচ সেকেন্ড পরে আমার কানে শুধু
জলের বোতলের ছিপি খোলা আর ঢোক গেলার একটা মৃদু আওয়াজ এল। এরপর আর মেয়েটি কোন কথা
বলেনি। আমি ঘুরিয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসাও করিনি। রুবি মোড় প্রায় এসেই গেছে! কিছুটা
দুরে একটা কলকাতা পুলিশের গাড়ি আর সাদা ইউনিফর্মে পার্থদা ক্রমশঃ স্পষ্ট হতে
লাগল। কিন্তু, আচমকা মেহেরিন পিছন
থেকে চিৎকার করে ওঠে, “বাঁদিকে
ঘোরান!” ঠিক তখনই পাশ দিয়ে একটা বড় গাড়ি স্বজোরে হর্ণ বাজিয়ে হাই স্পিডে আমার
গাড়িটাকে ওভারটেক করে রাস্তার বাম দিকে চেপে! আমিও রিফ্লেক্সে স্টিয়ারিংটা
বামদিকে ঘোরাতে যাবার আগেই গতির কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমি গাড়িটা নিয়ে
স্বজোরে মারলাম বাসটার পিছনে, আর
তারপর...
পার্থদা
আমার গাড়ির দিকে এগিয়ে এলেন। পার্থদা আসার আগেই, আমি গাড়ি থেকে নেমে পিছনের দরজা খুলে মেহেরিনকে নামাতে যাব দেখলাম পিছনের
সিট পুরো ফাঁকা! কোন মানুষের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। সিটের ওপরে শুধুই আমার রুমালটা
পড়ে আছে, সেটাও একদম ধপধপে সাদা, পরিষ্কার। তাতে রক্তের ছিটে ফোঁটা পর্যন্ত
কোথাও লেগে নেই। ব্যাপারটা দেখে প্রায় একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছিলাম হঠাৎ কানে
একটা তীব্র আওয়াজ আসতেই, ভাবনার
ঘোর কাটিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল! গাড়ির সামনে ড্রাইভিং সিটে
বসা অবস্থায় কেউ একজন রয়েছে! গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের ওপরে তার মাথাটা ঝুঁকে
রয়েছে। মাথার ভারে স্টিয়ারিংয়ে চাপ পড়ে গাড়ির হর্নটা বেজেই চলেছে। তারপরেই
পার্থদা ছুটে এসে গাড়ির দরজাটা খুলে দিল। ভেতরে বসে থাকা ব্যক্তিটির মাথাটা
স্টিয়ারিং থেকে তুলতেই দেখলাম, সেটা
আর কেউ না, সেটা হলাম স্বয়ং আমি!
আজ থেকে
ঠিক তিন বছর আগে একদিন অফিসে প্রজেক্টের কাজ সেরে বেরোতে রাত হয়ে যায়। তারপরে
নিউটাউন থেকে বাড়ি ফেরার জন্য বিশ্ব বাংলা গেট পেরিয়ে খালপাড়ের ওই শর্টকাট
রাস্তাটা ধরি। বাড়ি যাবার তাড়াহুড়োয় আমার কালো রঙের গাড়িটা নিয়ে, ওই রাস্তায় জোরে চালাতে গিয়ে একটা অন্ধকার
মতন জায়গায় গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখা সত্ত্বেও একটা রিক্সাকে ওভারটেক করতে
গিয়ে ওটার সাথে ধাক্কা লেগে যায়। আমি রিক্সাটাকে ওভারটেক করে পেরিয়ে গিয়ে
গাড়ির ডানদিকের আয়নায় দেখেছিলাম, রিক্সায় বসে থাকা একটি মেয়ে ছিটকে গিয়ে রাস্তার ধারে পড়ে গেল। আমি
চাইলেই গাড়ি থামিয়ে কাছে গিয়ে মেয়েটিকে বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু, ঝামেলার ভয়ে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি গাড়ি
চালিয়ে বাইপাসের রাস্তায় উঠে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যেতে থাকি।
কিন্তু, কিছুক্ষণ পরেই আমার
অনুশোচনা হয়। ভাবছিলাম ফিরে গিয়ে মেয়েটাকে গাড়িতে তুলে কোন হাসপাতালে নিয়ে
যাব কিনা! আর ওই এলাকার রিক্সাওয়ালাগুলোকে কোন ভরসা নেই,
ও নির্ঘাত মেয়েটিকে ফেলে পালিয়ে যাবে। মনের মধ্যে নানারকম
ভাবনার দোলাচলে গাড়ি চালাতে চালাতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। ঠিক তখনই রুবি
মোড়ের কাছে, পিছন থেকে একটি বাস
ডানদিক দিয়ে ওভারটেক করে যখন আমার গাড়ির আগে চলে যায়, সেই সময় আমি গাড়ির গতি কমানোর বদলে, অন্যমনস্কতায় গাড়ির এক্সেলেটার দিয়ে ফেলি। তারপরেই সেই বাসের পিছনেই
স্বজোরে...
রুবি মোড়ের কাছে সেদিন রাতে পার্থদা ডিউটিতে
ছিলেন। তিনি ছুটে এসে আমাকে গাড়ি থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় বের করে এক মিনিটও দেরী
না করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও আর শেষরক্ষা হল না।
সেই দিন
থেকে মৃত্যুর পরেও আমি গত তিন বছর ধরে প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় মেহেরিনকে
উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু, সময়ের মায়াজাল ভেদ করে, অতীত
কাল পরির্বতনের চেষ্টায় বারংবার বিফল হয়ে আজও মেহেরিনকে নিয়ে আমি ‘শেষ
গন্তব্যে’ পৌঁছাতে পারিনি।
অন্যরকম চমকের গল্প একটা। শেষটা দারুণ।
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন