ভারত শিল্প সংস্কৃতির জগৎ; চলচ্চিত্রের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে অসংখ্য
খ্যাতি অর্জন করেছে। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল
সেন, তপন সিনহার মতো তাবড় তাবড়
পরিচালকের হাত ধরে ভারতীয় চলচ্চিত্র যে সম্মান অর্জন করেছে, সেই সমস্ত ছবিতে এধরণের উপাদান ছিল অনুপস্থিত।
তাই জাতীয় স্তরে এই সমস্ত সিনেমার চর্চা কম, ব্যবসা কম। কারণ দেশের বেশিরভাগ দর্শক এই ঘরানার ছবি সেভাবে বোঝেন না বা
উপভোগ করেন না। তাই এই রকম সিনেমার লাভজনক হয়ে ওঠা কঠিন। যার ফলে নারীর শরীর ও
যৌনতাকে হাতিয়ার বানিয়ে ‘বিনোদন’ হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়ে পড়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
এখনও ২০২৪-এ দাঁড়িয়েও তাই মনে করা হয় যে এটি একটি প্রথাসিদ্ধ আচরণ। দেশের সামাজিক
ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি হওয়ার পরেও চলচ্চিত্র জগৎ লিঙ্গ বৈষম্য, নারীবিদ্বেষকে অবিরাম স্থায়িত্ব দিয়ে চলেছে।
সিনেমাতে বস্তুবাদ; বিশেষ করে
যৌনতাকেন্দ্রিক বস্তুবাদ এতটাই প্রাধান্য পাচ্ছে, যে আজকাল ‘বিশেষ গান’ বা ‘আইটেম নম্বর’ ছাড়া বাণিজ্যিক ছবি ভাবাই যায়না।
সেই বিশেষ গানে স্বভাবতই নারীদের বেশ উত্তেজক পোশাক পড়িয়ে নাচানো হয়। কারণ নারীর
শরীর নিয়ে এমনিই শিক্ষিত–অশিক্ষিত নির্বিশেষে মানুষের মনে উত্তেজনা বেশিই থাকে।
তাই তা বিক্রিও হয় বেশি, লোকে দেখেও
বেশি এবং তা হয়ে ওঠে পুঁজিবাদের আঁতুড়ঘর। এর ফলে, অভিনেত্রী বা শিল্পীর কাজের পরিসরকেও সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয় তাঁদের যৌন
আবেদনের মধ্যে।
চলচ্চিত্র জগতে এমন একটি ধারণা খুবই প্রচলিত যে, নারীর প্রধান যোগ্যতা তাঁর যৌন আবেদনে। নারী
তখনই মূল্যবান যখন সে পুরুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে তুলতে পারে। একটি মর্মান্তিক
উদাহরণ হচ্ছে, একজন নারী একটি
‘বিশেষ গানে’ নাচ করেন খোলা মেলা পোশাকে ও যাকে ঘিরে থাকে অনেক পুরুষ। ছবির
নির্দেশক ও প্রযোজকের ইচ্ছানুযায়ী এই ‘বিশেষ গানটি’ প্রচুর দর্শকের দৃষ্টিগোচর হয়।
গানের কথাই বলে দেয় যে নারীকে কি চোখে দেখা হচ্ছে বা কি ভাবে ভাবা হচ্ছে। যেমন, “ম্যা তো তন্দুরী মুরগি হু ইয়ার, গটকালে সাইয়াঁ অ্যালকোহল সে”, “পল্লু কে নীচে ছুপাকে রাখা হ্যায়, উঠা দু তো হাঙ্গামা হো”, “গিরাকে আপনা পল্লু বারবার, কর দেতি হো হমকো বেকারাড়” ইত্যাদি। এইধরণের
গানের মাধ্যমে সমাজের কাছে এমন এক বার্তা পৌঁছায়, যাতে মনে হয় যে নারীশরীর পুরুষের কাছে ভোগ্যবস্তু।
বাংলা বা হিন্দি যে ভাষারই সিনেমা হোক না কেন, দেখা যায় রোম্যান্টিক ধরণের গান প্রাকৃতিক
সৌন্দর্যে ভরপুর অঞ্চলে শুটিং করা হয় ও তাতে দেখা যায় নায়ক বেশ আড়ম্বরপূর্ণ
জ্যাকেট পরে নাচছেন ও নায়িকাকে পাতলা শিফন শাড়ি ও হাত কাটা ব্লাউজ পরিয়ে নাচানো
হচ্ছে। কেন? নায়িকার কি ঠান্ডা লাগে
না নাকি? পুরোনো দিনের সিনেমাতেও যে
হতো না এসব তা বলা ভুল হবে, কারণ
সেযুগের বিখ্যাত ক্যাবারে কুইন ‘হেলেন’কে চেনেন না এমন লোক মনে হয় কমই আছেন। হেলেন
মূলত ক্যাবারে ডান্সের জন্যই জনপ্রিয় ছিলেন। হেলেনের নাচকে কখনো অশ্লীল বা
কুরুচিকর বলে মনে হয়নি, কারণ তিনি
নাচতেন। নাচের ভান করে, শুধুই স্তন
কিংবা নিতম্ব প্রদর্শন করতেন না। ক্যাবারে তখনও হত, এখনও হয়। কিন্তু, ফারাক
হচ্ছে নর্তকীর বিশেষ বিশেষ অঙ্গের বা বিশেষ ভঙ্গিমার দৃশ্যায়নে। কিছু গানের শুরুই
হয় নৃত্যশিল্পী বা নায়িকার স্তনবিভাজিকা দেখানো দিয়ে। তারপর সেটি অধোগামী হয় নাভির
দিকে। যেমন, ‘স্ত্রী’ ছবির ‘কমরিয়া’
গান। আসলে নারীর যৌনতা এখানে পণ্য বিশেষ; এই পণ্যই ক্রেতার(অর্থাৎ, দর্শকের)
কাছে বিক্রি করা হয়, ফলস্বরূপ
সিনেমটি লাভজনক হয়ে ওঠে।
যৌনতাকে বাজারজাতকরণের একটা অন্যতম
‘বাই-প্রোডাক্ট’ হল ইভটিসিং-এর মত একটা গর্হিত অপরাধকে রোম্যান্টিসাইজ করে দেখানো।
নায়ক বাইকে করে যেতে যেতে রাস্তায় নায়িকার পথ আটকায়, ফুল দেয়, গান গায়, ফোন নম্বর চায় আর প্রেম হয়ে যায়। দক্ষিণী
সিনেমাতে মেয়েদের নাভিতে চিমটি কাটা, স্নানের সময় মেয়েদের লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা এসবকেও খুবই সাধারণ ঘটনার মতো
করেই দেখানো হয়। এই সিনেমাগুলি দর্শকমনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। সাধারণ মানুষ
সিনেমাতে দেখানো দৃশ্য ও বাস্তবের মধ্যে তফাৎ করতে অক্ষম হন আর এবং সিনেমার
রীতিনীতিকেই বাস্তব হিসেবে ধরে নেন; এমনকি সময়াবকাশে তা ‘ব্যবহার’ও করেন। সিনেমা অন্যতম শক্তিশালী গণমাধ্যম; যার প্রভাব সমাজের ওপর খুব দৃঢ়ভাবে পড়ে। বিশেষ
করে যুবসমাজ, যাদের চোখে রঙিন চশমা
থাকে, জীবনকে যারা ধীরে ধীরে চিনতে
শেখে, যৌবন ও যৌনতাকে অন্বেষণ করতে
শেখে; তাঁরা খুব তাড়াতাড়ি সিনেমার
এই চটকের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়।
হরহামেশাই দেখা যায়, সিনেমাতে নারীর শরীরকে অপমানজনক ভাবে অঙ্কিত করে থাকে। যেমন, ভোজপুরী ও দক্ষিণী সিনেমায় ছিপছিপে চেহারার
অভিনেত্রীর চাহিদা কম। সেখানে ফর্সা, স্থুল নিতম্ব, বৃহৎ স্তন ও
ভঙ্গিল কোমর, পেটের কাছে হালকা
চর্বিযুক্ত নায়িকার চাহিদা বেশি। যাঁদের দেখে দর্শক সমাগম বেশী হয়। তাদের কাছে
শ্লাঘনীয় ও সুন্দর নারীর সংজ্ঞা এটাই বলে এই সমস্ত অঞ্চলের সিনেমার নায়িকারা এই
সমস্ত দৈহিক বৈশিষ্টের অধিকারিণী হন। নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে পুরুষ তার জীবন
সঙ্গিনী এমন না পেলে কিছু ক্ষেত্রে সিনেমা জগতের নারীর মধ্যে খুঁজতে যায় ও সব
নারীকেই সেই চোখে দেখতে শুরু করে। আবার হিন্দিভাষী ও বাংলাভাষী সিনেমায় নায়িকারা
হন ছিপছিপে রোগা, ফর্সা, চর্বিহীন। এমনকি সুন্দর নারীর শরীরের মাপকে
সংখ্যায় ফেলে নির্ধারণ করে দিয়েছে সমাজ সিনেমার মাধ্যমে এবং সেটি হল ৩৬-২৪-৩৬।
এটিই নাকি একজন নারীর শরীরের সৌন্দর্যের আদর্শ মাপকাঠি। এই মাপের কাছাকাছি না আসলে
নাকি নায়িকা হওয়া যায় না, কারণ, নারীকে বেশিরভাগ সময়ই সিনেমায় সেক্স আইকন ও আই
ক্যান্ডি রূপে দেখানো হয়, অভিনেত্রী
বা মানুষ হিসেবে নয়।
এই ত্রুটিহীন, শিল্পজাত, কৃত্রিম সৌন্দর্য
লাভ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেন বাস্তবের বহু সাধারণ নারী। সিনেমার নায়িকাদের মত
হতে চান সাধারণ নারীরাও। কেন? যাতে
নিজের বিশেষ পুরুষ বন্ধু বা স্বামীকে খুশি করতে পারেন। কারণ বেশিরভাগ পুরুষও নারীর
আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের পরিবর্তে বাহ্যিক সৌন্দর্যতে মোহিত হয়ে যান। কিছু নারীও সেই
সৌন্দর্য দেখে মোহিত হন এবং সিনেমার মাধ্যমে প্রচার হওয়া দৈহিক সৌন্দর্যকে লাভ
করতে চান ও না লাভ করতে পারলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন। নারীকে এভাবে দেখতে
দেখতে সমাজের কাছে যে বার্তা পৌঁছোয় তা সমাজের প্রত্যেকটা মানুষের জন্যই
ক্ষতিকারক। এর থেকেই ধীরে ধীরে হিংস্রতা, নিগ্রহ, যৌন লালসা, যৌন তথা মানসিক বিকৃতি জন্ম নেয়।
ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের উচিত নতুনভাবে এক বার্তা
দেওয়ার যাতে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়। নারী ভোগের সামগ্রী নয়, তাঁর অন্য পরিচয়ও বর্তমান। পুঁজিবাদের উৎস অনেক
আছে, নারীর শরীরের ব্যবহারই একমাত্র
মাধ্যম, এটা মানা কঠিন। নারীর
যৌনতাকে ভোগ্যবস্তু রূপে সিনেমাতে দেখানো একটি সামাজিক সমস্যা, যা থেকে সমাজে অরাজকতার সৃষ্টি হয়, নারীকে সহজলভ্য ভাবা হয়। এটিকে নির্মূল করা
প্রয়োজন নইলে সমাজে নারীদের দুর্বল ও ভোগের সামগ্রী ভাবার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে
তার থেকে মুক্তি নেই। বিশেষ করে ভারতীয় সমাজে এর প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি কারণ এই
সমাজে লিঙ্গ সংবেদনশীলতা সম্পর্কে আলাদা করে সচেতন করানো হয় না, যদি না সে সমাজবিজ্ঞান বা ফিজিওলজি নিয়ে পড়শোনা
করে। বর্তমানে সমস্যা হলো ফ্রি মিডিয়া, যা ছোট বড় প্রত্যকের কাছে খুবই সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। ঠিক-ভুল বোধ জন্মানোর
আগেই কিছু অন্যরকম জিনিস দেখে সেটাকে আদর্শ বা এটাই তো করা উচিত ভেবে নিয়ে বাস্তব
জীবনে তার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে ফেলে। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সিনেমা ব্যবসা ঠিকই করত, গোঁড়া ভক্তও ছিল হাজার হাজার, কিন্তু সেই সিনেমা চালানোর জন্য উৎকর্ষহীন
উপাদানের প্রয়োজন হতো না। কিন্তু, দেখতে
গেলে তা বাঙালি দর্শক পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল।
যুগ পাল্টেছে, পাল্টেছে টাকার মূল্যও। এসেছে ওটিটি, ওয়েব সিরিজ, ইউ টিউব যা
সেন্সর বোর্ডের হাতের বাইরে। যেমন ধরুন, অল্ট বালাজি, উল্লুর মতো
কিছু ওটিটিতে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক কারণ ও বিনোদনের জন্যে শ্বশুর ও বউমা, দেওর ও বউদি, জামাইবাবু ও শ্যালিকার মধ্যে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক দেখানো হয়। সমাজে কি
এগুলো বর্তমান নয়? নিশ্চই বর্তমান।
কিন্তু কোনটা চিত্রনাট্যের স্বার্থে আর কোনটা সস্তার বিনোদনের জন্য সেটা পরিষ্কার
বোঝা যায়। আর এইধরণের প্রত্যেকটা গল্পে নারীদের অকথ্য ভাষায় সম্বোধন করা হয়।
যৌনমিলনের পদ্ধতি হয় হিংস্র, উত্তেজনার
বসে সহযোগীর গায়েও হাত তোলা কোনো ব্যাপার নয় - এরম একটা চিত্র ফুটে ওঠে। এসব
ক্ষেত্রে নারীর প্রতিবাদ না থাকায় বেশিরভাগ দর্শক ভেবে নেয় যে নারীটি নিশ্চয়ই
উপভোগ করছে। যার ফলে বাড়ে ধর্ষণ, নিগ্রহ, উৎপীড়ন।
সাম্প্রতিককালের একটি সিনেমার কথা উল্লেখ না করে
পারছি না, নাম – ‘অ্যানিম্যাল’। কি
সংঘাতিক বার্তা যে এই সিনেমা দিয়েছে সমাজকে তা ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। বাবার প্রতি
ভালোবাসা থেকে জন্ম জেদ ও ক্রোধের সাহায্যে তাঁর শত্রুদের ধ্বংস করার ফন্দি। সেটা
কি? স্ত্রী থাকতেও অন্য নারীর সাথে
শারীরিক সম্পর্ক করা, তাঁকে জুতো
চাটতে বলা, নিজের স্ত্রীর ওপর অকথ্য
ভাষায় চিৎকার করা, তাঁকে থাপ্পড়
মারা আর একটা ফাঁপা পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী হয়ে ঘোরা। এই সিনেমাটি পুরুষতন্ত্রকে
সমর্থন ব্যাতীত আর কিছুই করে না। মস্তিষ্কের ওপর এর প্রভাব যে কতখানি তা বর্তমান
সমাজের হাল দেখলেই আন্দাজ করা যায়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন