উপলব্ধি - অর্পিতা সাহা


বাইকটা এক একবার স্টার্ট নিচ্ছে না। মাঝে মাঝেই ঘড়ঘড় শব্দ তুলে ইঞ্জিনটা যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করছে। অরিন্দম এই মাসখানেক হল ফুড ডেলিভারী বয় হিসেবে একটা নামী সংস্থাতে কাজ নিয়েছে। আসলে বাবার হঠাৎ একটা স্ট্রোক হয়ে যাওয়ায় পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে সংসারের হালধরা তার কর্তব্য। এটা সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। তবে যোগ্যতা বলতে যেহেতু সে উচ্চমাধ্যমিক পাশ, তাই এ বাজারে কাজ খুঁজতে গিয়ে এটা ছাড়া অন্যধরণের কাজ করতে নিজের মন থেকে ঠিক সায় দেয়নি তার।

একটু আগেই প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়ে গেছে। বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধে এ সময়টা বৃষ্টি হলে হোটেল রেস্তোরাঁতে ডাইন আউট কমে যায়, স্বভাবতই কাজের চাপও বাড়ে অনলাইন ডেলিভারী দেবার। এখন প্রায় সন্ধে সাতটা ওর হাতে চারখানা ফুড-ডেলিভারী এদিকে মাঝে মাঝেই তুমুল বৃষ্টি নামছে আবার বাইকটাও ভোগাচ্ছে।

পুজোর আর বেশি বাকি নেই। এই মাসে কিছু বেশি রোজগার হলে ভালো হয় আসলে মাকে সংসার খরচের টাকাটা দেবার পর নিজের খরচ চালানোর সামান্য টাকায় টেনেটুনে বাকি মাসটা চালাতে হয় ওকে কিন্তু পুজোর আর মাত্র একমাস বাকি এখন থেকে কিছু টাকা জমাতে না পারলে বাবা মা আর ছোটো বোনের জন্যে নতুন জামা কাপড় কেনাটা বড্ড চাপের হয়ে যাবে ওর কাছে...

এছাড়া বাবার চিকিৎসা খরচের জন্যে সব সময়ে হাতে ক্যাশ রাখতে হয়। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই অরিন্দম এস.পি. মুখার্জি রোড ক্রসিং পেরিয়ে সাদার্ন অ্যাভিনিউতে ঢুকে পড়লো। এটা দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত একটি এলাকা। মোবাইলের লোকেশন আর ঠিকানা দেখে যে অ্যাপার্টমেন্টটার সামনে এসে দাঁড়াল সেটা প্রায় ছ’তলা হলেও তার ডেলিভারী অ্যাড্রেস একতলা দেখাচ্ছে দেখতে পেয়ে কিছুটা স্বস্তি পেল অরিন্দম। সিকিউরিটিকে পেরিয়ে ডোর-বেল বাজাতেই একজন আধুনিক পোশাকে মধ্যবয়সী মহিলা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

- “কখন টাইম দেওয়া ছিল দেখুন তো অর্ডার ডেলিভারীর আর এখন ক’টা বাজে বলুন?”

- “আসলে ম্যাডাম খুব বৃষ্টি পড়ছিল তাই রাস্তায় একটু জ্যামে আটকে পড়েছিলাম...”

- “একদম এক্সকিউজ দেখাবেন না।”

- “সরি ম্যাডাম, আপনি জিনিসগুলো নিন কাইন্ডলী, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।”

- “চুপ করুন! আমি ফাস্ট ডেলিভারী অপশন দিয়ে এক্সট্রা অ্যামাউন্ট পে করেছিলাম। এগুলো আমি নেবো না ফেরত নিয়ে যান।”

- “না ম্যাডাম ফেরত তো নেওয়া হয় না আপনি তো অলরেডি পে করে দিয়েছেন।”

হাত থেকে প্যাকেটগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে, ‘গেট লস্ট’ বলে মুখের সামনে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন মহিলাটি।

ভারী রাগ হচ্ছিল অরিন্দমের। এদের কি সহবত বা শিক্ষা বলে কিছুই নেই? ভদ্র-সভ্য চেহারা, পোশাক অথচ ব্যবহার এত অভদ্র। মানুষকে এত হীন চোখে দেখে। কিন্তু সে একজন সেলস পার্সন তাই নিজের কোম্পানির গুডউইল রাখতে সবটা হজম করে নিল। নইলে উপযুক্ত ব্যবহার ফিরিয়ে দিতে পারত।

মেজাজটা বেশ বিগড়ে গেল ওর। আরো তিনটে অর্ডার এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে, তার ফাঁকে বাবার একটা মেডিসিন কিনতে হবে। মা এই মাত্র ফোন করে জানাল। যদিও এবারের লোকেশনগুলো প্রায় বেশ কাছেই ওর এখনকার অবস্থান থেকে।

মোবাইলে পরের অ্যাড্রেস দেখে একটা বেশ বড়ো পুরোনো বিল্ডিং এর সামনে এসে বাইক থামালো। যেটুকু দেখল তাতে মনে হল একটা কমার্শিয়াল কম্পাউন্ডের মধ্যে গুটিকতক ফ্ল্যাটও আছে।

সেকেন্ড ফ্লোরের একদম কর্নারের ফ্ল্যাটে বেল বাজাতেই কানে হেডফোন গোঁজা এক মাঝবয়সী মহিলা দরজা খুলে একগাল হেসে বললেন, “বাঁচালেন ভাই আমার বাড়িতে এক গাদা গেস্ট অপেক্ষা করছে। আচ্ছা আপনি কী জল খাবেন? আমি ঠান্ডা জল এনে দেবো?”

হঠাৎ অরিন্দমের মনে হল, সত্যিই তো ভীষণ জল তেষ্টা পেয়েছে। অনেকক্ষণ তার জল খাওয়ার কথা খেয়ালই হয়নি। দরজার দিকে তাকাতেই দেখল, মহিলা হাতে জলের বোতল আর প্লেটে দুটো মিষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে।

আপনি আমার ভাইয়ের বয়সী হবেন। আজ আমার মেয়ের জন্মদিন তো, তাই এই জল-মিষ্টিটুকু যদি খেয়ে নেন ভালো লাগবে।”

অরিন্দম এক গাল হেসে,  আচ্ছা দিদি” বলে পরম তৃপ্তির সাথে জল মিষ্টি খেলো। যার জন্মদিন সেই ছোট্ট মেয়েটি মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কখন। কি নিষ্পাপ তার মুখখানি। অরিন্দম ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ বলে উইশ করতেই সে লজ্জা পেয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। মেয়েটির মাও খাবারের প্যাকেটগুলো নিয়ে বিদায় নিলেন। হঠাৎ করে অরিন্দমের মনটা বেশ প্রফুল্ল লাগতে শুরু করল।

আসলে মানুষের ব্যবহারটাই তো সব। ভালো ব্যবহার মানুষকে যেমন আনন্দ দেয়, সম্মান দেয়,  তেমনি খারাপ ব্যবহার মানুষকে দুঃখ দেয়। মানুষের মনের কষ্টকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। সামান্য ফুড ডেলিভারী বয় হিসেবে যেটা সে উপলব্ধি করতে পারল, শিক্ষিত গুণী মানুষজন কিভাবে সেটা বুঝতে পারে না তা ভেবে ওর বিস্ময় জাগে! কবির সেই বিখ্যাত উক্তির কথা মনে পড়ে গেল ওর “বিদ্যা আবরণে, শিক্ষা আচরণে।











Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন