“তু যাবি লয় কি? চল লিখাপড়া শিইখ্যে তুও চাকরি করবি? বীরু মুন্ডার বেটি কথাট মন্দ বলেনি। শালো বাপের একলা বেটি বলে পইড়বেক। উঅ যত্ত বেশি লিখাপড়া কইরবেক, তত্ত কম মাইনবেক। মরদের কথায় চলবি না বুঝি! বাপ খুড়া কি পাঠশালে যায়? শিয়াল কুকুরে খাবে যেখন তেখন বুইঝতে পারবি হ।”
“কথাট মন্দ বলনি বটে।
পিয়াল গাছে কি পলাশ ধইরবেক? শালো
আবাগীর বেটার বুদ্ধি আছে।”
মন্টু সোরেন জগেন মুন্ডার কথা শুনে বলল। জগেনের
বয়স বিশ বছর। পাড়াতুতো কাকার সঙ্গে সে জন খাটতে যায়। আজ তিন দিন হলো ভাকুও যায়
ওদের সঙ্গে। ভাকু কথাটা শুনে জগেনকে বলল, “পরের বেটি কি মিষ্টি কুমড়া? তুলে তরকারি করে খাবি? বেল
পাকলে কাকের কি?” মন্টু হ্যাজর
প্যাজর করে।
“তু শালো চুপ কর! কথাট
আমি কাকাকে বলছি।” ভাকু বুঝতে পারে বীরু মুন্ডার বেটিকে জগেন কাত করবে। তার আগে
বঁড়শির আধারে যদি ধরা যায়, মন্দ
হয় না। যে কারণে গায়ে পড়ে কথা বলছে। বেশ কয়েকদিন এই নিয়ে কাজের মাঝে
তর্কাতর্কি হয়। দু’জনের চোখ সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা গৌরবর্ণা মেয়েটির দিকে। নাম
তার টুকু মুন্ডা।
টুকু এখন দশ ক্লাসে পড়ে। সামনে মাধ্যমিক
পরীক্ষা। বেশ ডাগরডোগর। গড়ন আচরণ প্রকৃতি ভালোই। দু’পাশে বেণী দুলিয়ে সাইকেলে
চড়ে দূরের স্কুলে যায়। ক্ষেতের কাজ করতে করতে ওরা দু’জনেই আড়চোখে সিমেন্টের
ঢালাই রাস্তার দিকে লক্ষ্য রাখে। জগেনকে টুকু দাদা বলে ডাকে। জগেনকে দেখেই তো টুকু
সবসময় বলে চাকরি করার কথা। তাহলে টুকু কি শহরের কলেজে পড়ে বিদ্বান হয়ে চাকরি
করবে! জগেনের লেখাপড়া দশ ক্লাস। সে বছর মায়ের মরণ হতেই আর স্কুলে যাওয়া হয়নি।
বাবা বলল, “ঘরে থাইকলে চইলবেক লয়।
আমি খাদানে কাজ করি তুও চল।” সেই বছরই দুর্ভাগ্যবশতঃ বাপটা খাদানে কয়লার ধ্বসের
মধ্যে পড়ে মরে যেতেই একাকী মেধাবী জগেন বেকায়দায় পড়ে যায়। খালি ঘরে একা থাকে।
সারা দিনে একবারই রান্না করে। দু’বেলা খায়। আফসোস লেখাপড়াটা আর হলো না। আর
নিরক্ষর ভাকুর স্বভাব চরিত্র ভাল নয়। বারবার চেষ্টা করে টুকুর সঙ্গে কথা বলতে। সেদিন
ভাকু কাজে যায়নি। টুকু স্কুল থেকে ফেরার পথে দাঁড় করিয়ে ভাকু কি যেন বলছে তা
জগেন দেখেছে। ভাগ্যিস পরের দিনই জগেন টুকুকে বাজারে দেখল। হাতে সাইকেল ধরা।
- “কিরে তুই একলা কেনে, কুথায় যাবি?”
- “সামনে পরীক্ষা টেস্ট
পেপারস বই কিনবার লেগে বাজারে আইছি।”
- “কালক, কালক তুকে দেখলম ভাকুর সঙ্গে কথা কইতে?”
- “হ। উও বইলছে খারাপ
কথা। বইলছে আমকে বিহা করবেক।”
- “বটে। শালোর সাহস তো
কম লয়! তা তুই কি বললি?”
- “আমি পড়বক। অখন বিহা
করবক লয়। তা...তাছাড়া উকে?”
- “উও শালো পরাণ
সোরেনের বউ লিয়ে মুখে চুনকালি মেইখছে; পরাণ উকে পুলিশের হাতে দিয়ে হাজত খাটাইছে। তু জানিস লয় কি?”
- “আমি জানবক কেমনে? মরুক ছাই ঢ্যামনা।”
সে চলে গেল সাইকেলে চেপে। জগেন চেয়ে রইল
স্বপ্নের পসারিণীর দিকে। কারণ টুকুর স্বপ্নের কথা লক্ষ্যের কথা অতীব প্রসারময়।
জগেন ভেবে নিয়ে মনে মনে বিশাল স্থপতি স্থাপন করে।
সেদিন সন্ধ্যাবেলায় জগেন বাড়িতে ফিরছে। পরাণের
বউ ভেড়া ছাগল ক্ষেতে ঘাস খাইয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে। পরাণ ছিল তার
সঙ্গে। পরাণ বলল, “ভাকু তুয়ার
সঙ্গে কাজ করে শুনলম? উকে পাড়া
ছাইড়বার নিদান আছে।”
- “কি করবক বলহ? স্বাধীন দেশটয় অমন দোষী নির্দোষী বাঁচার অধিকার
সকলের আছে। তুমার কি শুনলম বটে?”
- “তেমন কিছু লয় রে
ভাই। আমার বউ শুকনা পাতা কুড়াইনতে যায়। উঅ সেদিন একাই ছিল। উঅ শালো বলে কি, তু রাজী থাইকলে চলো পলাইন যাই। এমন কি হাতট
ধইরে টানাটানি কইরছে। বউকে সঙ্গে লিয়ে সদরে পুলিশকে জানাই। তারপর হাজতে ছিল। এখুনও
চেতনা ফেরায়নি।”
- “শালোর খুব আলুর দোষ, তাই না?”
টুকু ইস্কুলে যায়। করনদের পুকুর পাড়ে পাড়ার
ছেলেরা মার্বেল গুলি খেলে। বট গাছটার নিচে বাবা মহাদেবের মত যেন ধ্যান করে। জগেনের
চক্ষুশূল। সেদিন টুকুর যাবার সময় শালুক ফুলের মালা নিয়ে ছুঁড়ে দিল। ভাগ্যিস
বিপদ হয়নি বা গলায় পড়েনি। সাইকেলের সামনে হ্যান্ডেলের উপরে পড়ল। টুকু সাপ মনে
করে ভয়ে আঁতকে উঠল। তারপর এদিক ওদিক চেয়ে দেখল। ভাকুর কাজ ছাড়া আর কারো কাজ নয়
অনুমান করে স্কুলের সময় অনুধাবন করে কিছু বলল না। সযত্নে মালাটি নিয়ে সাইকেলের
সামনে ক্যারিয়ারে নিল। স্কুলে এসে হেডস্যারের কাছে ওটা দিয়ে বলল, “স্যার, পাশের পাড়ার ভাকু এই মালাটি আমায় আসতে দেখে ছুঁড়ে দিয়েছে।”
- “তাতে কি হয়েছে? সে তো আমার স্কুলে পড়ে না। আইনতঃ তাকে তো কোনো
শাস্তি দিতে পারি না। তোমাকে সাবধানে রাস্তায় চলাফেরা করতে হবে। আমাদের কারোর
চলার পথ মসৃণ নয়। এটা জেনে রেখো।”
- “স্যার থানায় আপনি
বলে দেন।”
- “এই সামান্য বিষয়ে
থানায় জানাব?”
- “অসামান্য হলে কি
জানাবেন? তখন যদি অন্য কিছু হয়ে
বসে?”
- “চাকরি করি মাত্র। এত
কিছুর ভার মাথায় নিতে পারব না। তোমার বাবাকে বলে ব্যবস্থা নাও। যাও।”
টুকুসহ দলবল অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। আজই বিকালে
বিষয়টা জগেনের কানে পৌঁছাতে মনে মনে ফাঁদ পাতল। সে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল টুকু এই
রাস্তায় কখন আসবে। তার সঙ্গে দেখা হতেই বলল, “টুকু দাঁড়া। ভাকু তুকে অপমান কইরেছে শুনলম।”
- “হ জগেনদা। আমি মনে
মনে তকে ভালবাসি। ওই ঢেমনার বাচ্চা গায়ে পইড়ে হেনস্তা করে।”
জগেন যেন হাতে পয়মন্ত দলিল পেল। ভবিষ্যতে টুকুর
সঠিক জিম্মাদার কে হবে তার উদার আহ্বান পেয়ে জগেন একাই একশো হয়ে উঠল।
জগেন মনে মনে ভাবল ভাকু যখন একা একা থাকবে
ধারেপাশে কেউ থাকবে না ঠিক তখনই ওকে ডেকে নেবে। তারপর? বেশ তো কয়েকদিন অপেক্ষায় ছিল। সেই সুযোগ নেবার জন্য একদিন একা আসতে দেখে
বলার সুযোগ পেল।
- “ওই শালো, মাল খাবি?”
- “মাল? মাল কুথায় পাবো?”
- “আছে। আজ সন্ধ্যায়
মাইতি বাঁধের পাশে যে কালভার্ট আছে, উখানে চইলে যাবি সন্ধ্যা সাতটায়।”
- “বেশ তো। ট্যাকা
কিন্তুক আমর লাই। তু যাবি কিনা বল?”
- “আমি ত যাবক। তবে হ
বেশি দেরি করবক লাই ঠিক সন্ধ্যা সাতটায়।”
- “চাট কি নিবি?”
- “শালো চাট তো আছে।
টুকু! টিউশন থেইকে ফেরার পথে...”
- “টুকু! উঅ আইসবেক? দুজনে মিলে...”
সে আনন্দে গদগদ হয়ে উঠল, “আহ! মিছা কথা লয় তো?
কেঅরে বলবি না যাঃ।”
বেলা গড়িয়ে আঁধার নামছে। ক্ষেত খামারের জন
মজুর গৃহপালিত পশু শাবকের সঙ্গে গাঁয়ের বৌ-ঝিরা ঘরমুখী। পাখিরা নীড়ে ফিরছে।
আকাশে সন্ধ্যাতারা ফুটেছে। দু’চারটে দলাপাকা মেঘ ছন্নছাড়া হয়ে উড়ছে। বাবলা গাছে
ফিঙ্গে বসে আছে।
জগেন কাঁধের গামছায় দেশী-বিদেশী মিলিয়ে আটটা
বোতল নিয়ে রওনা দিল নির্দিষ্ট স্থলে। ভাকু তো আগেই গিয়ে বসেই আছে সেখানে।
- “ওহো শালো তো এসে
গেছিস? বাহ! এসব বিষয়ে এক্সপার্ট
তু তাই নারে?”
- “আবার কি? টুকু আইসবেক ত, ঠিক বলছিস?”
- “আগে বল হারজিত কর? এই ক’টা মালের বোতল তু যদি একা খাস তাহলে টুকু
তোর।”
- “আর যদি পারি, সত্যি টুকুকে বিহা করিন লুব! এই তো? তাহলে তুই উকে ছুঁতে পারবিক লয় কিন্তুক।”
- “হ রে শালো হ। আর যদি
না পারিস তাইলে টুকু আমর।”
- “হ বেশ। দে ঢাইলতে
লাইগবক লয়; বতল দে; সব একাই ফুরাইন দুব।”
একটার পর একটা মালের বোতল পান করে যাচ্ছে। টুকুর
ওই পথে টর্চ জ্বালিয়ে সাইকেলে আসতেও দেরি আছে।
- “ওই টুকু আসছে। জগেন
স্রেফ মিথ্যে বলল।”
“আই-স-ছে!” সে টলমল
করছে মাথা তুলতে পারছে না। অবশেষে সে কাত হয়ে পড়ে গেল। হাতে মদের বোতল। শুয়ে
পড়েও মুখে ঢালছে।
হঠাৎ জগেন মরিয়া হয়ে পায়ের তলায় খালি বোতল চেপে
ধরেছে ভাকুর গলায়। শ্বাস রোধ করতেই মরে গেল। তখনও টুকু পৌঁছায়নি। তার আসার পথে
এগিয়ে গেল। রাস্তায় দেখা।
- “টুকু পথের কাঁটা
সরাই ফেলছি।”
- “মানে!”
- “সামনে একটু এগিয়ে
চল দেখতে পাবি।”
সামান্য পথ হেঁটে আসার পর দেখিয়ে দিল। নিথর
সংজ্ঞাহীন ভাকুর মৃতদেহ। টুকু দেখে ভয়ে আঁতকে গেল।
- “সে কি! তুমি খুন
কইরেছ? ও খারাপ ঠিকই কিন্তুক বাঁচার
অধিকার তো আছে?”
- “নাহ টুকু! এর মতন
খারাপের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার লাই। যে মেয়েদের সম্মান করতে পারেক না, তার বাঁচার অধিকারও লারেক।”
- “যদি ধরা পইড়ে যাও? কেউ যদি বল্যে দেয়?”
- “নাহ। যদি কেউ জানে
সে তো তুই একা জানবেক। তর পড়াশুনার ল্যাগে আমি কালক রাইস মিলের কাজে যাচ্ছি।
অনেকদিন পরে ফিরবক।”
- “ঠিক আছে জগেনদা। আমি
তুমার জন্য অপেক্ষায় থাকবেক। একট একট কইরে সার্টিফিকেট জোগাড় করি। তারপর...”
- “তর বাপে যদি নাই
পড়ায় আমকে চিঠি লিখবি। আমি টাকা পাঠাইঞ দুবো।”
- “ঠিক আছে। পথ চেয়ে
রইলম জগেনদা।”
জগেন বাড়ি ফিরে শিয়ালদহে ট্রেন ধরার জন্য
প্লাটফর্মে গেল সে যাবে বর্ধমানের কোনও রাইস মিলে শ্রমিকের কাজে। সেই রাতে টুকুর
চোখে একেবারেই ঘুম আসেনি। সারা রাত সে খুবই বিচলিত ছিল।
বেশ লাগল।
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন