আবার আসিব ফিরে - দেবযানী বাড়ই

মিহিরপুর ডাকঘর থেকে ডানদিকের যেই কাঁচা রাস্তাটি বাঁশ বনের মধ্য দিয়ে অজগরের ন্যায় এগিয়ে গাঁয়ের সীমান্তে শেষ হয়েছে, সেখানে নন্দন তার মাঝ বয়সি বাবা ও মায়ের স্নেহপূর্ণ চালাঘরের বাটীতে বসে একান্ত চিত্তে ধামা তৈরীর শেষ পর্যায়ে মগ্ন। পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদ তার কাঁধে নিশ্চিন্তে নিদ্রায় আচ্ছন্ন, কয়েক মুহুর্ত পরেই তা মিলিয়ে যাবে লালচে আলোয়। রেবতী পাটের তৈরি দড়ির গোছা নন্দনের পাশে বাঁশের খুঁটির নিচে উদাসীনভাবে রেখে চলে গেল। মায়ের প্রতি উৎসুক চিত্তে নন্দন ক্ষুধার উপক্রম হাক দিয়ে ব্যক্ত করলে রেবতী মুড়কি মিশ্রণে মুড়ি বাটীতে নিয়ে এল। বেতের ধামাগুলি পাটের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে, হাত দুটো সুতির জামা তে ঘষে মুড়ি-মুড়কি গোগ্রাসে খেতে লাগল নন্দন। বাবা নীলরতন ক্ষেত থেকে ফিরলে গোধূলি কালে ধামা গুলি বাজারে নিয়ে যাবে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে। চাল, অড়হর ইত্যাদি কিনে আনবে ফেরার পথে। নন্দন বলেছিল, “বাবা একখান ইংরেজি বই কিনে দেবে?” ছেলের চাহিদার কথা তার দিব্যি মাথায় আছে, বিনয় বাবুর বইয়ের দোকান থেকে বই কিনেছে সে, নন্দন বেশ খুশি হবে।

বউঠাকুরণ আম তেলসহ মুড়ি মেখে দিয়ে গেল, অভয় চশমার কাঁচ কুর্তার কোন দিয়ে মুছতে মুছতে নন্দনের দিকে চেয়ে বলল, “কিরে খা!” নন্দন লাজুক ভাবে ছোট্ট মুষ্টিতে মুড়ি তুলে নিল। অভয় বলল, “কাল পড়তে হবে না বুঝলি পরশু আসবি কেমন?” নন্দন মুড়ি চিবোতে চিবোতে ঘাড় নাড়ল। রাত গভীর হতে অভয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো নন্দন। বাড়ির কাছাকাছি কাঁচা রাস্তার উপর কিছুটা এগোতেই অদ্ভুত কোলাহলএ ভীত অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়ল এগারো বছর বয়সী ছোট্ট ছেলেটি। আজ আবার মহাজন এসেছে বাড়িতে, সুদের পাওনা আদায় করা যায়নি, তাতেই ক্রোধ মহাজন শতপতির। নীলরতন স্ত্রীয়ের অসুখের কথা বোঝাতে ব্যাকুল হয়ে উঠল। মহাজন শতপতি নাছোড়বান্দা মানুষ, নীলরতনের এই করুণ পরিস্থিতি বুঝতে নারাজ তিনি। এহেন অবস্থায় দম বন্ধ হয়ে এল নন্দনের, পিঠের ব্যাগটি দাওয়ায় ফেলে এক ছুটে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে।

মিনা ছাতের ওপর দাঁড়িয়ে ঝিঁঝিঁপোকার গান মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিল। দূর থেকে নন্দনকে ছুটে আসতে দেখে ছাত থেকে নেমে দোতলার নিচে এসে দাঁড়ায় সে। মাতৃস্নেহময় মিনা নন্দনকে পরোক্ষভাবে আগলে নেয়। বন্ধুর মতো অনুভূতি ভাগ করে নেয়, কখনো বা প্রেমিকার মত শাসন করে চোখের চাহনিতে। বছর দশের বাচ্চা মেয়েটির মধ্যে এক ভীষণ স্নেহময় চরিত্র ফুটে ওঠে তার অজান্তেই।

কচুরিপানার পুকুরের পাশের বাবলা গাছটি তাদের একাধিক আলাপের সাক্ষী হয়ে চির বিরাজমান।

ছাতের কাঁচের বয়াম থেকে মিনার চুরি করে আনা আম তেতুলের আচারে অমৃত খুঁজে পায় নন্দন। অল্প বয়সী দুই তরুণ-তরুণী হাজারো স্বপ্ন বুনে চলে প্রতিক্ষণ, হ্যাঁ তরুণ-তরুণী বটে।

নীলরতন কিছু জমানো আয় বরাদ্দ করেছে। শতপতি বাবু জমি বন্ধক নিয়েছেন, বাকি টাকা শোধ করলেই তা ফেরত দেওয়া হবে। আমিন ডেকে টিপসহি দিয়েছে নীলরতন। শর্তে বলা আছে, আসল শোধ করার পূর্বে এই জমি শতপতির দখলে থাকবে, সুদের পরিমাণ বৃদ্ধি স্থগিত রাখা হয়েছে। নন্দন উদাসীনভাবে দলিল পড়ে দেখেছে, দৃঢ় সংকল্প করেছে নিজেই; সে বড় হবে, অনেক আয় করে শতপতির মুখে টাকা ছুড়ে দেবে সে। তার পৈতৃক সম্পত্তি রক্ষার দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।

পরদিন সকাল হতেই বাবলা গাছের কাছে ছুটে এল নন্দন। বেশ পরিপাটি হয়ে মনমরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে মিনা। মসলিনের কাপড়ে বেশ মানিয়েছে তাকে, চোখে কাজল, চুলে বিনুনি, গোলাকার মুখশ্রীতে অপরূপা দেবীর ন্যায় তার উপস্থিতিতে বাবলা গাছের দোয়েলটিও মুগ্ধতার গ্রাস গিলছে। নন্দন কাছে যেতেই ছল ছল চোখে মিনার গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো। শতপতিবাবু মেয়েকে শহরে পাঠাচ্ছেন আজ, সেখানেই পড়াশোনা যাবতীয় করা হবে, এই তাঁর আদেশ। নন্দন কিছুক্ষণ নির্বিকার চাহনিতে মিনার প্রতি একদৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মিনার চোখ থেকে উষ্ণ নোনা জল বেয়ে এলো চিবুকে। নন্দন অপ্রতিভ হেসে বলল, “আমিও যাবো শহরে তুই ভাবিসনে একদম, কাঁদবিনে বুঝলি, পোড়োকালীর দিব্যি রইল।” মিনা ইচ্ছার বিরুদ্ধে হাসার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। “কিরে মিনা শুনলাম শহরে চলে যাচ্ছিস”, অভয়ের গলার স্বরে সম্বিত ফিরল নন্দনের, ছিপছিপে চেহারার ছেলেটি নিজেকে লুকিয়ে বহুরূপী হতে চাইল, অভয়ের চোখ তা এড়িয়ে যেতে পারল না। মিনা অভয়ের কথায় সম্মতি জানালো। অভয় বলল, “চল নন্দন তোর সুপারিশ হয়েছে, বাজার হতে স্কুলের পোশাক আনতে যেতে হবে।” নন্দন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো, অভয় এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখলো।

মিনা নিজের ব্যাগ থেকে একটা আচারের কৌটো নন্দনের হাতে দিতেই নন্দনের চোখ আর বাঁধ ধরে রাখতে পারল না, ফুঁপিয়ে উঠলো সে। মিনার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই নিজেকে সামলে কনুই দিয়ে চোখ মুছে নন্দন বলল, “আমি আসবো রে শহরে; অনেক বড় হবো, মায়ের বাতের চিকিৎসা করাবো, একটা ঘর বানাবো, বাবা বিশ্রাম নেবে, তোকে নিয়ে আসবো সেইদিন এই গাঁয়ে।” মিনা নন্দনের ডান হাতটা নিজের দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরে বলল, “আমি জানি তুই পারবি। আমিও আবার ফিরে আসবো।” অভয় নিজের মুখ কিছুটা ঘুরিয়ে নিল, তার চোখের কোনে এক ফোঁটা জলের বিন্দু বর্তমান।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন