বুলান আর কালু যখন খুঁজে পেতে যখন পৌঁছল তখন সকাল সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। এদিকটা ভরাট করে প্লট করে করে জমি বিক্রি করেছিল কন্ট্রাক্টর। এদিক ওদিক দূরে দূরে ছড়ানো ছেটানো ছোট একতলা নতুন বাড়ি। নীচু জমি ভরাট করে প্লট হিসেবে বিক্রি হয়েছে তাই বড় গাছপালাও তেমন নেই। কেমন যেন ন্যাড়া ন্যাড়া। সামনের রাস্তা ইঁট দিয়ে বাঁধানো। পিচ পড়েনি। লোকজনও কম চোখে পড়ে। বুলান ভাবছিল, এত দূরে লোকে বাড়ি করে মূল শহরে যাতায়াত করে কি করে?
ওরা হচ্ছে ভাড়া করা লোক। যখন যেমন লোকের দরকার
ওরা চলে আসবে। সব গুছিয়ে করে দেবে। অর্থাৎ জুতো সেলাই টু চণ্ডীপাঠ। বাড়ির বাইরে
নাম-ঠিকানা লেখা ফলক। একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ বাইরেই সিঁড়িতে বসে। কালো কোঁকড়ানো
চুলগুলো উস্কখুস্কো। একটা পায়জামা আর ফতুয়া গায়ে। চোখ মুখ শুকনো। চোখে
উদ্বিগ্নতা। বুলানরা দাঁড়াতেই সেও উঠে দাঁড়ালো। বলল, “আসুন ভিতরে। গৌরীপদবাবুর কাছ থেকে আসছেন তো?”
ঘাড় নেড়ে বুলান বলে,
“আপনি লোক চেয়েছেন। বলুন কি করতে পারি?” ডান হাতের আঙুল দিয়ে মাথার চুলগুলো বুলিয়ে
ইতস্তত করে বলে, “হ্যাঁ, খুব বিপদে পড়ে আপনাদের কাছে ম্যানপাওয়ার
চেয়েছি।”
বিপদ? সাত সকালে কি বিপদ? বুলান
এদিক ওদিক চায়। শুকনো মুখে কালু বলে, “কি হয়েছে?” বসার ঘরে
বুলানরা দাঁড়িয়ে ঘরের দু’দিকে দুটো ঘর। বসার ঘরের সঙ্গে রান্না ঘর আর বাথরুম।
ভদ্রলোক হাতজোড় করে বললেন, “আমার
নাম অচিন্ত রায়।” বুলান খেয়াল করল লোকটা বারবার মাথার চুলে হাত চালাচ্ছে আর হাত
কাঁপছে।
- “বলুন কি বলবেন।”
- “হ্যাঁ। আগে ধৈর্য
ধরে শুনতে হবে। একটু আগে থেকেই বলছি। আমি নাগপুরের ছেলে দুমাস হল কলকাতায় চাকরি
পেয়ে এসেছি। অনেক কষ্ট করে এই বাড়িটা পেয়েছি। মালিক এখানে থাকেন না। পুরো
বাড়িটাই আমার দখলে।”
“বাড়িতে কিছু অসুবিধা?” কালু বলল। “না,” আমতা আমতা করে বলে অচিন্ত্য, “পরশু দিন সাত সকালে আমার নাগপুরের বন্ধু তমাল ফোন করে। ওর পাড়ার এক
বন্ধুর বাবা কলকাতা আসছেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে। নাম দুলাল
ভৌমিক। দিন তিনেক থাকতে হবে এখানে। কলকাতার তেমন কিছু চেনে না। বলল, তোর ওখানে দু’দিন থাকলে অসুবিধা আছে? ডাক্তার দেখাবে, টেস্ট করাবে তারপর চলে যাবে। বললাম, ‘আমি তো ছুটি নিতে পারবো না। উনি যদি একা এসে ডাক্তার দেখাতে পারেন তাহলে
কোন অসুবিধা নেই।’ সে বলল, ‘যাক, বাঁচালি ভাই। তোর ভরসায় আমি আগেই হ্যাঁ বলে দিয়েছি।
আজই উনি তোর অফিসে যাবেন। তুই হেল্প করে দিস।’ ‘কিসের ডাক্তার দেখাবেন?’ বললে, ‘কি একটা হার্টের প্রবলেম। ওই হাসপাতালে নাকি খুব নামকরা ডাক্তার আছে তাই
কলকাতায় আসছেন।’”
কালু বলে, “এতে চিন্তার কি আছে?”
- “নেইতো। আমিও তাই
ভেবেছিলাম। উনি এলেন অফিসে। নিতান্ত গোবেচারা মানুষ। কাজ সেরে ওনাকে নিয়ে বাড়ি
ফিরলাম।”
বুলান কিছুটা বিরক্ত হয়, “এর সাথে আমাদের কি সম্পর্ক? যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন।”
- “হ্যাঁ বলছি।
সন্ধ্যেবেলা ঘরে বসে গল্পগুজব হল। অনেকবার করে নাগরপুর যেতে বললেন। পরদিন ডাক্তার
দেখিয়ে বাড়ি এলেন। আমিও বাড়ি এলাম। চাকর রামধন রাত্রের রান্না করছে। গল্প করতে
করতে উনি একটু উঠে ঘরে গিয়ে শুয়েছেন। আমি টিভি দেখছিলাম। রামধন এসে বলল, বাবু, ওনাকে ডাকছি এত করে, কিন্তু
সাড়া দিচ্ছেন না। বললাম, ঘুমিয়ে
পড়েছে। আমি ডাকছি। গিয়ে দেখি উনি দিব্যি শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। ডাকলাম, কোন সাড়া নেই।”
- “তারপর? উঠলেন শেষে?”
“না”, অচিন্ত্য বাবু বললেন। একটু থেমে বললেন, “উঠছেন না, উঠছেন না। শেষে হঠাৎ কি মনে হল নাকের কাছে হাত নিয়ে মনে হল নিশ্বাস পড়ছে
না।”
- “বলেন কি?”
- “আমিও ভীষন নার্ভাস
হয়ে পড়লাম। অফিসে এক বন্ধুর বাবা ডাক্তার। ওকে ফোন করলাম। কাছেই থাকে ওরা এল।
তখন সন্ধ্যে আটটা। দেখলেন। বললেন, ‘হার্ট
ব্লক হয়ে মারা গেছেন। তবে ডেথ সার্টিফিকেট চারঘণ্টা পরে দেব।’”
- “সেকি! তারপর কি করলেন?”
- “ওরা চলে গেল। উনি
বলে গেলেন, ‘কাল আমার কাছ থেকে ডেথ
সার্টিফিকেট নিয়ে নেবেন।’ ঘাম দিয়ে উদ্বেগ কমল। আমি নাগপুরের বন্ধুকে ফোন করলাম।
ও শুনে জানাল, কথা বলেছে। ছেলে
মেয়ে কাউকে পাঠাচ্ছে। বডিটা রাখতে হবে।”
“কি করলেন? এত সাংঘাতিক ব্যাপার। কেউ চেনা আছে এখানে? কোথায় রাখলেন?”, গলাটা কেঁপে গেল কালুর।
- “একটু পরে বন্ধু
জানালো ছেলে যাচ্ছে। কাল সকালে রওনা হবে পরশু পৌঁছাবে।”
- “তারপর? বডি কোথায়?”
- “তখন বাড়িতে দুলাল
বাবুর বডি, রামধন, আর আমি। রাত হয়ে আসছে। এরকম বডি রাখার জায়গা
কোথায় জানিনা। চারিদিকে বাড়িঘর তেমন নেই। আমি অনেক কষ্টে রামধনকে রেখে বরফের
স্ল্যাব জোগাড় করে আনলাম।”
- “বলেন কি?”
- “কি করব?”
- “রামধন আর আমি দুলাল
বাবুর বডি নামিয়ে ঘরে বরফের স্ল্যাবের ওপর রাখলাম। বার বার জল বেরোচ্ছে। রামধন
গামছা দিয়ে মুছে ফেলেছে। আমি ঘরে বেশ কয়েকটা ধুপ জ্বালিয়ে এই বাইরের ঘরে বসে
রইলাম। হাত পা কাঁপছে। কেমন যন্ত্রের মত চলছি। বুঝতে পারছি অনেকটা সময় কাটাতে
হবে।”
“তারপর কি করলেন?”, বুলান নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করে।
- “রামধন সঙ্গেই ছিল।
রাত্রের খাবার খাওয়ার মত অবস্থা নেই। রামধন একবার বলল, বাবু কিছু খেয়ে নিন নাহলে চলবে কি করে? কখন আসবে ছেলে কোন ঠিক আছে? বললাম, পাশের ঘরে
দুলালবাবুর মৃতদেহ আর এঘরে বসে খাবো কী করে। বসে আছি, বসে আছি। অনন্ত সময় আর কাটছে না । কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। তমালের ওপর
ভীষণ রাগ হতে লাগল। কলকাতায় রাস্তাঘাট তেমন চিনিনা। নর্থ কলকাতায় এক মামা থাকেন
তার সাথে এখনও দেখা করে উঠতে পারিনি। নিউ টাউনে এক কলেজের বন্ধু আছে। কিন্তু
যোগাযোগ হয় নি। মাঝে মাঝে উঠে ভিতরের ঘরে যাচ্ছি আর মাটিতে জল মুছে, ধুপ জ্বালিয়ে আসছি। রাত দশটা নাগাদ পাওয়ার
কাট হয়ে গেল। এবার রামধন বলে উঠল, বাবু
আমি থাকব না। আমায় ছেড়ে দিন। অনেক অনুরোধে আলো আসা অবধি রইল। তারপর শত অনুরোধ
উপেক্ষা করে চলে গেল। বলল, কাল
ফিরবে। এখানে থাকতে পারবে না রাত্রে।”
- “বলেন কি মশাই? এরপর?”
- “সে চলে গেল। এরপর
আমি এই ঘরে আর দুলাল বাবু শোবার ঘরে। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে
দাড়িয়ে থাকছি। বাইরে ভীষন মশা বেশিক্ষণ থাকা যায়না। একবার ভিতরে। সে এক স্তব্ধ
সময়। পার আর হয় না। এক সময় একটু একটু করে ভোর হল। আমার এক বন্ধুর সাথে কথা হল।
আপনাদের নাম্বার পেয়ে ফোন করলাম।”
“অ্যাঁ”, চমকে ওঠে কালু আর বুলান। “তাহলে...”
- “ঠিক ধরেছেন ওই ঘরে
দুলাল বাবু বরফের ওপর শুয়ে।”
কালু চিৎকার করে ওঠে, “ইয়ার্কি পেয়েছেন? আপনি
নিজে ফেঁসে গেছেন এখন আমাদের এরমধ্যে টানছেন? না,না, চল বুলান বেরিয়ে আয়।” বলে হাঁটা লাগায়
বাইরের দিকে।
অচিন্ত্যবাবু কালুর হাত চেপে ধরে, “ দাদা বিশ্বাস করুন। আমিও এমন বিপদে কোনদিন
পড়িনি। যা কিছু হবে সব দায় আমার। ওনার ছেলে এলেই আপনাদের মুক্তি। আর কিছুক্ষণের
মধ্যেই চলে আসবে। প্লীজ একটু থাকুন। এবার বরফ আনতে হবে। দেখে যান একবার।”
বুলানের একটু মায়া হয়। বলে, “আপনি গৌরীপদবাবুকে বলেছেন ব্যাপারটা? বুঝতেই পারছেন খুব গোলমেলে ব্যাপার। আমরা
সাধারণত এসব ঝামেলায় জড়াতে চাইনা। কতকিছু হতে পারে আপনি জানেন? এমন কি আপনার বা আমাদের জেলও হতে পারে।”, বলতে বলতে শোবার ঘরের পর্দা সরিয়ে ঢোকে ঘরে।
খাটের চাদর এলোমেলো। ঘরের মেঝে ভেজা। কড়া ধূপের গন্ধ ঘরময়। গাটা শিরশির করে উঠল।
দুলালবাবুর গায়ে একটা চাদর, সেটা
ভিজে গিয়েছে। কালকে থেকে লোকটা একা একটা ডেড বডি নিয়ে ঘর করছে তাও আবার সম্পূর্ন
অচেনা জায়গায়।
অচিন্ত্যবাবু বসার ঘরে ঠায় বসে। বিধ্বস্ত
অবস্থা। কাল রাত থেকে খাওয়া নেই। অফিসের কথা মনেই নেই। বুলান বলে, “দেখুন ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। কিছু না
খেলে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।”
কালু উঠে গ্যাস জ্বালিয়ে চা বানায় তিনজনের
জন্যে। নাগপুর থেকে ফোন এল। ছেলে রওনা হয়ে গেছে, বিকেলে পৌঁছাবে। ঠিকানা, মোবাইল
নম্বর দেওয়া আছে। চা খেয়ে অচিন্ত্যবাবু একবার বাইরে বেরোলেন। ফিরে এলেন ডেথ
সার্টিফিকেট আর বরফের স্ল্যাব নিয়ে। ভ্যানওয়ালা স্ল্যাব নামিয়ে বলল, “ফ্রীজ খারাপ হয়ে গেছে বুঝি?” অচিন্ত্যবাবু কোন উত্তর দিলেন না।
কালু একবার বেরিয়ে ধুপ,
সেন্ট কিনে নিয়ে এল। বুলান জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, ছেলে যদি আজ না আসে তাহলে?” অচিন্ত্যবাবু বললেন, “সার্টিফিকেট
রয়েছে। আজ সন্ধ্যে অবধি দেখে গাড়ি ডেকে পোড়াতে নিয়ে যাবো। রাত অবধি আর দেখব
না।”
বেশ কিছুক্ষন কেটে যাবার পর তিনজনই অনেক
স্বাভাবিক হয়ে এল। কথাবার্তায় পাশের ঘরে যে প্রায় একজন অচেনা কারুর মৃতদেহ
রয়েছে সেটা ভুলে যেতে লাগল। বুলান একবার বলেও ফেলল, “আপনার যা অভিজ্ঞতা হল এটা অন্য কারুর যেন না হয়। আপনার আয়ু বোধহয় পাঁচ
বছর কমে গেছে।”
অচিন্ত্যবাবুর স্নান হয় নি, রাতে ঘুম, খাওয়া কিছুই হয়নি। ফর্সা গালে একমুখ কাঁচা পাকা দাড়ি বেরিয়ে গেছে। এরা
আসাতে কিছুটা বল এসেছে। এখন ছেলে এলেই গাড়ি ডাকবে। একটুও সময় অপেক্ষা করবে না।
বডি বারো ঘণ্টার ওপর ঘরে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে গা গোলাচ্ছে। মাথা ভার।
সন্ধের মুখে ছেলে এল সঙ্গে বয়স্ক একজন। ঘরে এসে
দাঁড়াল। বাবাকে দেখে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর নিজেকে সামলে বলল, “কতক্ষন আর রাখবেন? এবার নিয়ে চলুন।” আশ্চর্য! একটুও কান্নাকাটি নেই।
শ্মশানে চিতা সাজানো হয়ে গেছে। চুল্লিতে
ঢোকানোর আগে মুখাগ্নি করতে হবে। এক পাশে ছেলে আর বয়স্ক ভদ্রলোক অন্য পাশে বুলান, কালু আর অচিন্ত্যবাবু। ঠাকুরমশাই পারলৌকিক
ক্রিয়া করবার জন্যে দাঁড়িয়ে। ছেলেকে বললেন, “চলে আসুন। এই মণ্ডটা মাখুন, আমি মন্ত্র বলছি। সে দাঁড়িয়ে রইল।
অচিন্ত্যবাবুর আর ধৈর্য্য কুলাচ্ছে না। বললেন, “চলে আসুন। বাবা তো আর চিরদিন থাকেন না।” ছেলে
দাঁড়িয়ে রইল। শেষে অচিন্ত্যবাবুর দিকে এগিয়ে বলল, “কাকু, আপনিই করুন। আপনি
অনেক করেছেন। ওনার সঙ্গে শেষ কথাও বলেছেন। ”
এবার বিরক্ত হয়ে বুলান রুক্ষ স্বরে বলল, “একেই তো এসেছেন একদিন পরে। কি হ্যাপা আমাদের গেছে সেটা তো জানেন না। এখন এখানে এসে ন্যাকামি হচ্ছে?” পুরুতমশাই কিছুটা অবাক। ভাবছেন শোকটা সামলে উঠতে পারেনি। ছেলে বলল,”আমি তো করতে পারবো না।”
বুলান বেশ জোরেই বলল, “কেন? কেন পারবেন না?”
সবাইকে বিস্মিত করে সে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তো ভাড়াটে সৈন্য। ওনার বাড়ি থেকে
পাঠিয়েছে। ছেলে তো কাজে বিদেশে গেছে।”
অচিন্ত্যবাবুর এতটা ভাবনায় ছিল না। কেমন করে
উঠল শরীরটা। বুলান ভাবল, আজই গিয়ে
গৌরীদাকে বলতে হবে এবার থেকে পারলৌকিক কাজটার দায়িত্বও নিতে হবে।
ওরা আর দাঁড়ালো না। বলল,
“আপনারা কাজ করুন। এসেছি যখন কলকাতাটা একটু ঘুরে যাব।” বলে
ছেলে আর বয়স্ক লোক দুজন বেরিয়ে গেল।
এতই যখন হল এটুকু আর বাকি থাকে কেন? অচিন্ত্য কি ভেবে এগিয়ে গেল মুখাগ্নি করতে।
অসাধারণ একটা গল্প। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। যথার্থ নামকরণ।
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন