প্রাচীনকালে ক্রীতদাস ব্যবসার চল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত ছিল। প্রধানত ধনীরাই এর পৃষ্ঠপোষক ছিল। নিজেদের সুখ-সুবিধা ও ক্ষমতা দেখানোর জন্য তারা এই ক্রীতদাস ব্যবসার সাথে নিজেদের যুক্ত করেছিল, এছাড়াও এর মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতিসাধনও করতেন তারা। এই প্রথা প্রধানত ইউরোপীয় উপনিবেশকারীদের দ্বারা প্রচলিত হয়েছিল। পর্তুগীজ, ইংরেজ, ডাচ, ফরাসি প্রায় সকলেই এই ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। উপনিবেশিক অঞ্চলে পর্তুগীজরাই সম্ভবত সর্বপ্রথম এই ব্যবসার সূত্রপাত করেছিল। প্রধানত ইংরেজদের হাত ধরেই ভারতবর্ষে ক্রীতদাস ব্যবসার সূত্রপাত হয়। এই ব্যবসা থেকে ব্রিটিশ কোম্পানী যেমন অর্থনৈতিক মুনাফা লাভ করত তেমনই নিজেদের কায়িক শ্রমও লাঘব করত। আর এর সাথে সাথেই ভারতীয় উপমহাদেশে রচিত হয় চাবুকের শব্দ, ভারি শেকলের আওয়াজ ও অশ্রুজলের করুণ ইতিহাস। এভাবেই ধীরে ধীরে ফরাসিরাও এই ব্যবসার সাথে জড়িত হয়ে পরে। আর তখনই খুব স্বাভাবিকভাবেই এই অমানবিক প্রথার সাথে জড়িত হয়ে যায় চন্দননগরের নাম।
চন্দননগরে এই ব্যবসা বা প্রথা অনেক আগে চালু
হলেও ডুপ্লের আমলে (১৭৩১ -১৭৪২) তা সর্বাধিক বৃদ্ধি পায়। ডুপ্লের ব্যক্তিগত কিছু
দাস ছিল বলেও জানা যায়। এই শহরে তৎকালীন সময়ে দাস বাজার বসত প্রধানত গঙ্গারধারে, বর্তমানের ঊর্দ্দিবাজারের নিকট এবং বিবিরহাটে।
সেখানে বেশকয়েকটি দাসগুদামও ছিল বলে জানা যায়, যেখানে ভিন্ন স্থান বা দেশ থেকে আমদানি করে আনা দাসদের মজুত করে রাখা হত।
এছাড়াও বর্তমান চন্দননগর সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী শহর বর্তমানের চূঁচড়া, হুগলির বিভিন্ন অঞ্চলেও এরূপ বাজার বসত বলে
ইতিহাসবিদরা মনে করেন। তৎকালীন সময়ে পুরুষ ক্রীতদাসের পাশাপাশি মহিলারাও ক্রীতদাসী
হিসাবে বিক্রিত হত। মহিলা ক্রীতদাসীদের মূল্য ছিল পুরুষ ক্রীতদাসের থেকে
তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ছিল।
ক্রীতদাসবাহী জাহাজে...
তৎকালীন সময়ে দেশে প্রায়ই বন্যা-খরা বা নানা
প্রকার দুর্ভিক্ষ হত, এর ফলে অসহায়
মানুষ জমিদারকে প্রদত্ত খাজনা দিতে না পেরে জমিদারি পেয়াদাদের অত্যাচারের ভয়ে
এলাকা ছেড়ে পালাত, আত্মহত্যা করত
আবার অনেকে দুবেলা দুমুঠো অন্নের জন্য স্ত্রী, সন্তান এমনকি নিজেকেও বিক্রি করতে বাধ্য হত কোনো সাহেব বা উচ্চবিত্তের
কাছে। এসম্পর্কে বেশকিছু দলিল এর সাক্ষ্য বহন করে। এভাবেই জন্ম হয় ক্রীতদাস
প্রথার। ছলছুতোর মাধ্যমে এবং ছেলে-মেয়ে চুরি করেও ক্রীতদাস বানানোর রীতি প্রচলিত
ছিল বলে জানা যায়। এছাড়াও যুদ্ধবন্দীদেরও ক্রীতদাসে পরিণত করা হত।
তৎকালীন বেশকিছু দলিল, চিঠি এবং পরবর্তীকালে বেশকিছু পত্র-পত্রিকায় কিছু প্রশিদ্ধ মানুষের
লেখায় চন্দননগর শহরে ক্রীতদাস বিক্রি ও আমদানি-রপ্তানি সম্পর্কে জানা যায়। ১২ই
মার্চ, ১৭৩১ সালের পণ্ডিচেরির এক
ফরাসি সাহেবের এক চিঠিতে চন্দননগর থেকে ক্রীতদাস পাঠানোর আর্জির কথা জানা যায় [১]।
প্রবর্তক পত্রিকার সপ্তম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত চারুচন্দ্র রায় এর লেখা
“চন্দননগর ইতিহাসের এক পৃষ্ঠা” নামক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ২৮শে মে, ১৭৩৫ তারিখের সেরকমই একটি দলিলের [২] কথা
যেখানে উল্লিখিত আছে শ্যামা বাগদি নামক ৮বছরের ছেলেকে তার বাবা আত্মারাম বাগদি
অভাবের তাড়নায় মাত্র ৭টাকায় গ্যাসপার কার্ণেট নামক এক ফরাসি সাহেবের কাছে বিক্রি
করেছিল। শুধু তাই নয় প্রবর্তক পত্রিকার এই প্রতিবেদন থেকে ক্রীতদাস হস্তান্তরের
তথ্যও জানা যায়। এই বছরেরই অক্টোবর মাসে শ্যামা বাগদি অন্য এক ফরাসি সাহেব মসিয়ে
থেরেসার কাছে ২৫ টাকা মূল্যে বিক্রিত হয় আবার ঠিক এক মাস পরে অর্থাৎ নভেম্বর
মাসের ২৫ তারিখে শ্যামা বাগদী পুনরায় ৫০ টাকার পরিবর্তে হস্তান্তরিত হয় ফরাসি
সাহেব মসিয়ে থেরোর কাছে। আবার এও জানা যায় যে, ১৭৫১ সালে বুঁরবো দ্বীপের ফরাসি শাষকসংঘ পণ্ডিচেরির কাছে ৬০ জন ১৫-৩০
বছরের ক্রীতদাস চেয়ে পাঠায়। পণ্ডিচেরি সরকার এই দায়ভার পত্রের মাধ্যমে চন্দননগরের
উপর নস্ত করে। এভাবেই তৎকালীন চন্দননগর দাস ব্যবসার ঘাঁটি ও দাস যোগানের কেন্দ্র
হয়ে ওঠে। তৎকালীন সময় ফরাসি সাহেবরা বৃদ্ধ-যুবক নির্বিশেষে চাকর বা ক্রীতদাসদের Boy বা Garcon বলে ডাকত। Boy বা Garcon কথার অর্থ “বালক” নয় বরং এর অর্থ হল
“ছোকরা”। এই “ছোকরা” শব্দটি বান্দা বা ক্রীতদাস শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে গণ্য করা
হত।
ফরাসি ক্রীতদাসবাহী জাহাজ 'মারি সেরাফিক'-এর ছবি এবং নকশা। এভাবেই জন্তু জানোয়ারদের
মতো গাদাগাদি করে দূরদেশে চালান করা হত ক্রীতদাসদের।
সেই সময়ে প্রায় সকল ক্রীতদাসকেই ব্যাপতিসম বা
খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত [৩] করা
হত। এমনকি তার নামও পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখা হত। এই ক্ষেত্রে তৎকালীন
উপনিবেশকারীরা ক্রীতদাসদের প্রাপ্তিস্থানের ভিত্তিতে তাদের পদবী রাখতেন নিজেদের
সুবিধার্থে। যার নজির বা উদাহরণ আজও ফ্রান্সে পাওয়া যায় বংশানুক্রমিকভাবে। তেমনই
একজন হলেন ফ্রান্সের প্রয়াত বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আন্দ্রে চন্দননগরের কন্যা তথা
বিশিষ্ট লেখিকা ফঁসোয়াজ চন্দননগর। কিন্তু হটাৎ চন্দননগরের ক্রীতদাস সম্পর্কে লিখতে
বসে এনাদের নাম বললাম কেন? এই
সম্পর্ক বোঝাতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রায় ২৫০-২৭০ বছর আগে। এবিষয়ে ইতিহাস
ঘাটলে জানা যায় যে, ১৭৫৮ সাল নাগাদ
ফ্রান্সের রাস্তায় ভবঘুরে হিসাবে ঘুরতে দেখে নাবালক “বাঙ্গাল [৪]” নামক
এক ক্রীতদাসকে তাদের অধিনস্ত করেন ডুমারসন ও ম্যাডলিন বুসি দম্পতি। শুধু তাই নয়
তার ব্যাপতিসম বা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিতকরণের নথি থেকে জানা যায় ম্যাডিলিন
বুসি তার “গডমাদার” হিসাবে সাক্ষর করেন। এই ম্যাডলিন বুসি ছিলেন একদা চন্দননগরের
ফরাসী গভর্নর দ্যুপ্লের লেফটেন্যান্ট চার্লস জোসেফ প্যাটিসিয়ার ডি বুসির ছোট বোন।
আর ডুমারসন ছিলেন ভারতে বুসির সহযোগী। ১৭৫৪ সালে প্যারিসে বুসির ব্যবসায়িক এজেন্ট
হওয়ার জন্য ফ্রান্সে ফিরে আসেন ডুমারসন। ব্যাপতিসম বা খ্রিস্টধর্মে
ধর্মান্তরিতকরণের পর বাঙ্গালের নতুন নাম রাখা হয়েছিল “শার্ল ফঁসোয়া
শন্ধ্যেরনগ(র)” (Charles Francois Chandernagor)। ফরাসি উচ্চারণে চন্দননগরের উচ্চারণ হত “শন্ধ্যেরনগ(র)”। কিন্তু এখান
প্রশ্ন হল “বাঙ্গাল” এখানে এলো কি করে? সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে “বাঙ্গাল”কে রপ্তানী [৫] করে
বা লুকিয়ে ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আবার অন্যমতে, তার খ্রীষ্টধর্মের নাম দেখে অনুমান করা যেতেই
পারে যে, সে তৎকালীন চন্দননগর শহর
থেকে অন্য কোনো মালিকের দ্বারা রপ্তানীকৃত হয়েছিল বা তাকে লুকিয়ে এখান থেকে
নিয়ে গিয়ে হস্তান্তর করা হয়েছিল। এরপরে কেটে যায় বহু বছর, বহু অত্যাচারের নিশ্চুপ সাক্ষী হয়ে কাটতে থাকে
তার জীবন। প্রায় কুড়ি বছর পর ১৭৭৮ খ্রীস্টাব্দে ফ্রান্সে আইন করে নতুন করে কোনো
ক্রীতদাস আনা ও রাখা নিষিদ্ধ করা হয়। “বাঙ্গালের” মতো যেসকল ক্রীতদাস এখানে থেকে
গেছে তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় যে, তারা কখনই শেতাঙ্গ বা ফরাসী মহিলাকে বিবাহ করতে পারবে না। কিন্তু ফরাসী
আইনের ফাঁক দিয়েই পরবর্তী সময়ে বাঙ্গাল স্বাধীনভাবে ছোটখাটো কিছু কাজ করে
জীবিকানির্বাহ করার সাথে সাথে এক শেতাঙ্গ মহিলাকে বিবাহ করে বৈবাহিক জীবনে আবদ্ধ
হয়। তাদের ছয় সন্তান হয়। তারা ফ্রান্সেই পাকাপাকিভাবে থেকে যায়। এভাবেই
বাঙ্গালের বংশতালিকা ক্রমান্নয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। “আন্দ্রে চন্দননগর” এবং তার
কন্যা “ফঁসোয়াজ চন্দননগর” হলেন যথাক্রমে এই বাঙ্গাল বা শার্ল ফঁসোয়া শন্ধ্যেরনগরের
পরিবারের ষষ্ঠ ও সপ্তম বংশধর।
ফঁসোয়াজ চন্দননগর
এই শহর থেকে বিক্রিত হওয়া দাস-দাসীদের জীবন ছিল
খুবই কষ্ট ও যন্ত্রনায় ভরা। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদের মাথার চুল ও গায়ের লোম
সম্পূর্ণভাবে চেঁচে তুলে দেওয়া হত, কালো
পোশাক পরানো হত, আর হাড়ভাঙা খাটুনির
সাথে চলত অকথ্য, অমানবিক ও নিষ্ঠুর
ব্যবহার ও অত্যাচার। এখান থেকে বিক্রিত ক্রীতদাসদের দূর দেশে রপ্তানিও করা হত অনেক
সময়ে। ‘THE CHANDANNAGORE - দি
চন্দননগর’ পেজে সুলগ্না চক্রবর্তী মহাশয়ার করা একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, এই শহরেরই ছেলে ও এই শহরেরই বিবিরহাট অঞ্চল
থেকে বিক্রিত হওয়া জামর ছিল ষোড়শ লুই-এর আমলে ইউরোপে রপ্তানি হওয়া প্রথম ভারতীয়
ক্রীতদাস। এই প্রথার শৃঙ্খলবদ্ধ অমানবিক ও করুণ কাহিনী এবং বেতের ক্রুদ্ধ ধ্বনির
পাশাপাশি কিছু সুখের বা বিপরীতধর্মী কাহিনীও আছে। সুলগ্না চক্রবর্তী মহাশয়ার করা
ওই একই প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, বর্ধমানের ভট্টচার্য পরিবারের তৎকালীন বড় বউ ছিলেন এই চন্দননগরের বিবিরহাট
থেকে বিক্রিত হওয়া এক মহিলা ক্রীতদাসী। Newzpole.com ওয়েভসাইটে নীলভনা চক্রবর্তী মহাশয়ার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অষ্টাদশ শতকের কলকাতার রাজাবাজার অঞ্চলের
জমিদার ছিলেন শ্রী হরিনাথ মুখোপাধ্যায়। হরিনাথের পূর্বপুরুষরা ছিলেন হুগলির
চন্দননগরের গোন্দলপাড়ার জমিদার। সেই বংশের এক পুরুষ, হরিনাথের ঠাকুরদা জমিদার হয়েও নিজে জমি চাষ করতেন। শোনা যায়, একদিন জমি কর্ষণের সময় তাঁর চোখে পড়ে মাটিতে
পোঁতা একটি পিতলের ঘট। তিনি সেটিকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। কয়েক দিনের মধ্যেই
স্বপ্নাদেশ পান তিনি। স্বপ্নে দেবী মঙ্গলচণ্ডী তাঁর কাছে পুজো চান। সেই থেকে
মুখোপাধ্যায় পরিবারে শুরু হয় মঙ্গলচণ্ডীর আরাধনা। এর দীর্ঘ কয়েক বছর পর নিজের মাকে
সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় আসেন হরিনাথ মুখোপাধ্যায়। ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর ছেড়ে
পাকাপাকিভাবে ইংরেজদের রাজধানী কলকাতায় বাস শুরু করেন। সময়টা ১৭২০–২১ সাল। বংশ
গরিমার সঙ্গে তখন হরিনাথ নিয়ে আসেন সেই ঘট। ক্রমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে
পাটের ব্যবসায় দারুণ লাভ করতে থাকেন। ফুলেফেঁপে ওঠে মুখোপাধ্যায় বংশ। ক্রমেই
কলকাতার বিত্তশালী মহলে ওঠাবসা শুরু হয় হরিনাথের। কলকাতার রজক বাজারের (বর্তমানের
রাজাবাজার) কাছে তৈরি করলেন নিজের বাড়ি। যাকে অট্টালিকা বললেও অত্যুক্তি হয় না।
সেই অট্টালিকাতেই প্রতিষ্ঠা করলেন মঙ্গল চণ্ডীর ঘট। ঠাকুরদার মতো স্বপ্নাদেশ পান
হরিনাথও। এবার তাঁর কাছে পুজো চাইলেন দেবী দুর্গা। দেবীর আদেশ পালন করতে ১৭২২ সালে
দুর্গোৎসব আয়োজিত হল মুখোপাধ্যায় পরিবারের ঠাকুরদালানে। এই হরিনাথ তার
ঠাকুরদালানকে একটু অন্য রকমভাবে তৈরি করিয়েছিলেন। দালানের প্রবেশদ্বারে অতিথিদের
আপ্যায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় দুটি মূর্তি। সেগুলি কোনও পরী বা স্বল্পবসনা নারী
নন বা কোনো রূপসী রাজকন্যা নয়। সেই মূর্তি দুটি হল হাবসি নারী এবং পুরুষের। তাদের
পায়ে শৃঙ্খল। তারা আসলে ক্রীতদাস সম্প্রদায়ের প্রতীক।
বাঙালি ক্রীতদাস লুই-রেনোয়াঁ জামোঁ, ১৮শ শতকের বিখ্যাত ফরাসি বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ
ভুমিকা পালন করেন, ছিলেন বাস্তিল দুর্গ অভিযানের শরীকও।
এই ব্যবসার সাথে মূলত পর্তুগীজ, ব্রিটিশ ও ফরাসিরা জড়িত থাকলেও একদল ভারতীয়
ব্যবসায়ী ও দালাল শ্রেণীও অর্থ ও ক্ষমতার লোভে এই ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। এরকমই
উল্লেখযোগ্য একজন ভারতীয় নরপিশাচ দাসব্যবসায়ীর নাম খুঁজে পাওয়া যায় এই অঞ্চলে -যার
নাম ছিল পরমানন্দ। মূলত হুগলি ও সপ্তগ্রাম বন্দরের সময়কাল শেষ হবার প্রায় সাথে
সাথেই চন্দননগর শহরের গঙ্গার ঘাটগুলির গুরুত্ব বাড়তে থাকে ও সাথে সাথে এই ব্যবসাও
প্রভূত উন্নতিলাভ করতে শুরু করে। তৎকালীন বাংলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও আঞ্চলিক
জমিদারদের প্রবল অত্যাচারের ফলে চন্দননগর শহরের এই দাস ব্যবসা বিশেষভাবে প্রভাবিত
হতে শুরু করে। মূলত পণ্ডিচেরি, ফিলিপাইন, মরিশাস, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও দেশেরই অন্যান্য প্রদেশের সাথে চলত চন্দননগরের
ক্রীতদাস ব্যবসা। এখান থেকে যেমন বিক্রিত হওয়া দাসদের বজরা বা জাহাজে করে রপ্তানি
করা হত তেমনই ভিন্ন স্থান থেকে এখানকার বাজারে অধিক মূল্য পাবার আশায় দাসদের
আমদানিও করা হত। এই ব্যবসায় মূলত ইউরোপীয় উপনিবেশকারীরা(ফরাসিরা) বেশি মূলধন ঢালত
তবে ভারতীয় দাস-ব্যবসায়ীরাও খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। ইতিহাসের পাতা ঘাটলে এই কালো
প্রথার সাথে জড়িয়ে পড়ে তৎকালীন চন্দননগর শহরের জমিদার তথা ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়ার
কোম্পানির নায়েব ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর নাম। ১৭২৩ সালের এক নথি থেকে জানা যায়
তৎকালীন ফরাসি দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী কয়েকজন দাস ভাড়া নিয়েছিলেন। শুধু তাই
নয়, তিনিও নাকি এই দাসপ্রথা বা
ব্যবসা থেকে শুল্ক বাবদ অর্থ আদায় করতেন। তবে এ ব্যাপারে যথাযথ তথ্য প্রমাণ না
পাওয়া যাওয়ায় এই তথ্যটির সত্যতা আজও অন্ধকারে। ইউরোপীয়দের পাশাপাশি হিন্দু ও
মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত স্থানীয় বনেদি উচ্চবিত্ত জমিদার ও প্রভাব প্রতিপত্তিধারী
ব্যক্তিবর্গের বাড়িতে দাস-দাসী থাকত বলে বিভিন্ন ইতিহাসবিদদের থেকে জানা যায়। তবে
হিন্দুদের তুলনায় মুসলিমদের মধ্যে এই প্রথা বেশি জনপ্রিয় ছিল বলেও জানা যায়। তবে
সাথে সাথে এটাও জানা যায় যে, মুসলিমরা
বিশেষ পুণ্যলাভের আশায় দাস-দাসীদের ক্রীতদাসের জীবন থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্তি দিত।
এভাবে প্রভুদের থেকে মুক্তি পেয়ে অনেক ক্রীতদাসই এই শৃঙ্খলবদ্ধ, নিষ্ঠুর ও অন্ধকার জীবন থেকে জীবনের মূল স্রোতে
ফিরে এসেছে।
ব্রিটিশ ও ফরাসি দুই কোম্পানিই এই দাস ব্যবসা
থেকে কমিশন আয় করত, যা তৎকালীন যুগে
কোম্পানি দুটির অন্যতম মূল আয় ছিল বলে মনে করা হয়। ফরাসিরা মূলত বিক্রিত মূল্যের
উপর ৫% কমিশন আদায় করত। ব্রিটিশরা এবিষয়ে প্রায় অনেকটাই পিছিয়ে ছিল বলে
ইতিহাসবিদদের থেকে যায়। অনেক সময়ই দেশীয় এমনকি ইউরোপীয় দালালরা নিজেদের সম্পর্ক বা
প্রভাব-প্রতিপত্তির ক্ষমতায় বা অন্য কোনো কারণ দেখিয়ে দাসদের বিক্রিত মূল্যের উপর
৫% এর কম কমিশন কোম্পানিকে দিয়ে বাকি অর্থ দিয়ে নিজেদের পকেট ভর্তি করত। ফলে এই
শহরের ফরাসি কোম্পানিকে অনেক সময়ই আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ফলে ১৭৮৯
সালে তৎকালীন ফরাসি গভর্নর মতিঞ্চি এখান থেকে বিক্রিত হওয়া দাস-দাসীদের জাহাজে
তোলার উপর বিভিন্ন নিয়ম-কানুন ও বিধি-নিষেধ আরোপ করেন। এবং সেই সম্পর্কে তৎকালীন
বহুল প্রচলিত সংবাদপত্র “কলকাতা গেজেটে” বিজ্ঞাপন দেন। আইন সঙ্গতভাবে ক্রীতদাস
প্রথা নিষিদ্ধ হলেও এরপরেও দীর্ঘ বছর এই প্রথা ভারত তথা বাংলা তথা চন্দননগরের বুকে
অব্যাহত ছিল। প্রথমে ফরাসি বিপ্লব ও পরে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সাথে সাথে
বিশ্ববাজারে ক্রীতদাসের চাহিদা ক্রমশ কমাতে থাকে, ইউরোপীয়রা এই ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগে বিমুখ হয়ে পরে, এছাড়াও কলকাতা বন্দরের গুরুত্ব বাড়তে থাকার ফলে
চন্দননগর থেকে দাস আমদানি-রপ্তানিতেও বেশ অসুবিধা দেখা দেয় যার প্রত্যক্ষ প্রভাব
শহরের দাস ব্যবসার উপরে পড়েছিল। এরফলে শেষ পর্যন্ত ১৮৪৮ সালে এখানকার ফরাসি
সরকারের আদেশে শহরের বুকে এই দাসব্যবসা বা ক্রীতদাস প্রথা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে
দেওয়া হয়।
চন্দননগর শহরে আজ আর সেই দিন বা সেসব মানুষ
কোনটাই নেই। কালের অমোঘ নিয়মে সময়ের হাত ধরে এই শহরে এসেছে নতুন দিগন্ত, নতুন ভোর এসেছে নতুন চিন্তা। কিন্তু শহরের
ঐতিহাসিক গুরুত্ব, অর্থ-সামাজিক
গুরুত্ব ও ঐতিহ্যের পাশাপাশি কলঙ্কজনক অমানবিক এই দাসপ্রথা বা দাসব্যবসার সাক্ষী
হয়ে আজও বেঁচে আছে পশ্চিম ভারতের গঙ্গাপাড়ের অর্দ্ধচন্দ্রাকৃতি শহর - চন্দননগর।
হুগলি নদী বক্ষ থেকে চন্দননগর, ১৮০০ সাল। শিল্পী- জেমস মোফাট।
তথ্যসুত্রঃ-
১. চন্দননগরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস - অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
২. হুগলী চুঁচূড়া ঃ ইতিহাস ও সংস্কৃতি - সংগ্রাম মল্লিক।
৩. চন্দননগর (১৪৯৯-২০০০)
- মনোরঞ্জন মুখার্জী।
৪ “প্রবর্তক” পত্রিকা, ৭ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা।
৫. অভিজিৎ সিংহ রায়
মহাশয়ের লেখা “শন্ধ্যেরনগরের বাঙ্গালী ক্রীতদাস” শীর্ষক প্রবন্ধ।
৬. Newzpole.com ওয়েভসাইটে নীলভনা
চক্রবর্তী মহাশয়ার ২৭শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ তারিখের প্রতিবেদন।
৭. ফেসবুকের ‘THE CHANDANNAGORE - ডি চন্দননগর’ পেজে সুলগ্না
চক্রবর্তী মহাশয়ার করা একটি প্রতিবেদন।
[১] এই ব্যাপারে প্রবর্তক পত্রিকায় চারুচন্দ্র রায়ের লেখা একটি প্রতিবেদনের থেকে জানা যায় যে দু’বছর আগে ১৭২৯ সালের মধ্যভাগে পন্ডিচেরি থেকে চিঠির মাধ্যমে চন্দননগর থেকে ক্রীতদাস কিনে পাঠানো আপাতত স্থগিত রাখার কথা বলা হয়। কারণ মাদ্রাজের উপকূলবর্তী দুর্ভিক্ষ দেখা গেছে এবং সেখানে অপেক্ষাকৃত কম দামে ক্রীতদাস সংগ্রহ করা সম্ভব।
[২] বর্তমানে দলিল বলতে আক্ষরিক অর্থে আমরা যা বুঝি তৎকালীন সময়ে ঠিক তাই ছিলনা। সেকালে ক্রীতদাস কেনাবেচা বা হস্তান্তরের সময় একটি দাসখতের মাধ্যমে করা হতো। এই দাসখতটিকে বলা হতো “ছোকরা বিক্রয় পত্রনিদং”।
[৩ বিদেশী প্রভুদের বিরুদ্ধে ক্রীতদাসদের কথা বলার অধিকার না থাকায় প্রায় সবক্ষেত্রেই এই ধর্মান্তরিতকরণ হত তাদের মতের বিরুদ্ধে বা জোর করে।
[৪] তৎকালীন সময়ে মূলত রপ্তানি হওয়া ক্রীতদাসদের প্রকৃত নাম ও বাসস্থান সম্পর্কে কিছু জানা সম্ভব হয় না।
[৫] তখন ফ্রান্সে আইন ছিল যে একমাত্র উপনিবেশের রোপণকারীরাই ফ্রান্সে ক্রীতদাস নিয়ে যেতে পারবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন