বেরঙিন যে রঙ - লাবণী পোড়্যা

 


গাছপালার ফাঁক থেকে উঁকি মারা সূর্যটা এখন ধীরে ধীরে নদীর উপর প্রকাশিত হচ্ছে। তার নরম আভা এসে পড়ছে পিয়ালির মুখ ঢেকে দেওয়া চুলগুলোর ওপর। সদা চঞ্চল বুনো হাওয়ায় চুলগুলো সরে চলেছে এক একবার। নদীর ওপর ডিঙি নৌকাটার গতি অতি মন্থর, যেন সে এগিয়ে চলেছে কোনো আদিম অণুজীবের গতিতে। কিছু বুনো পাখির ঘরে ফেরার গান  বিরক্ত করে তোলে মেয়েটাকে। চোখ খুলে তাকায় সে। সূর্যালোকস্নাত চিক্চিক্ করা  নদীর জলটা পিয়ালির দৃষ্টি টেনে নেয়। নৌকোটার ওপর কি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল মেয়েটা!

আশেপাশের চারিদিকটা যেন ঝলমল করছে কোনো নতুন রঙ মেখে। তলায় কালি জমা চোখ দুটো ধাঁধিয়ে যাচ্ছে সেই রঙের খেলায়। সবুজ বনানী ঘেরা একটা সরু নদীর ওপর চালকহীন এক ডিঙিতে ভেসে যাচ্ছে সে। সূর্যের তিরচি আলোতে নদীর জল  নীলচে-কমলা লাগছে। বাতাসে চাঞ্চল্য থাকলেও, নদীর জল কোনো অদ্ভুত কারণেই স্থির। গন্তব্যে পৌঁছাবার যেন কোনো তাড়া নেই তার। হালকা হালকা রঙের ছটা ফুটে উঠছে পিয়ালির মাথার ওপরের আকাশটাতে

উঠে গিয়ে সে বসে ডিঙিটার একটা দিকে, জোড়া পা ডুবিয়ে দেয় নদীর নীলচে কমলা জলে। চোখের সামনের দৃশ্যগুলো যেন আজ না বহুবছরের চেনা তারপাশ দিয়ে বয়ে চলা সবকটা রঙের প্রলেপ  যেন, ওর সাদা-কালো জীবনেরই লুকানো রং। কয়েকটা পাখির কিচিরমিচির শব্দ  ওর দৃষ্টি টেনে নেয়, উচুঁ একটা গাছের  ডালে। যেখানে হালকা গোলাপি রঙের কিছু ফুল দুলে চলেছে কোনো এক পরিচিত সুরের তালে

পিয়ালির মনে হয় সারাজীবন এভাবেই ভেসে যেতে। এখানে কোনো দুঃখ নেই, কষ্ট নেই ,কোনো প্রশ্ন নেই, রূপ গুণের তুলনা নেই , অসফলতার অভিযোগ নেই আর  প্রতিযোগিতার খাতায় নামও নেই । এখানে কোনোদিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামে না। নিশ্চুপ আঁধার আকাশের বুকে কোনো ভয়ও লুকানো থাকে না। থাকে একটু আলো, একটু রং আর একটু আশা

 অজান্তেই সময়ের মাপকাঠি হারিয়ে ফেলতে থাকে পিয়ালি ,সব ভুলে যায় সে. সব

 

আনমনা মেয়েটার সম্বিৎ ফেরে নদীর পাড়ে ডিঙিটার মৃদু ধাক্কায়। সে এতক্ষনে এসে দাঁড়িয়েছে নদীর তীরে কোনো এক ভাঙা ঘাটের সামনে। ঘাটের জলে একটা দোলাচলতা আছে। যেন ইতিহাসের পাতার কোনো খয়েরি মেয়ে এখনি তার কলসিতে জল ভরে নিয়ে গেছে সেখান থেকে। কিছু না ভেবেই পিয়ালি পা ফেলে নদীর ভেজা পলিতে। এগিয়ে চলে গহীন সবুজাভ জঙ্গলটার দিকে। হঠাৎ কারো ডাক শুনে পিছন ফিরে তাকায় পিয়ালি

তার চোখে, কোনো ভয় নেই‌। ডিঙির অদৃশ্য চালকই যেন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে ওর চোখের সামনে।  পিয়ালির ক্লান্ত চোখের কোনে যেন একফোঁটা খুশির ঝলক ফুটে ওঠে

পিয়ালি:- "ঋক্."

ছেলেটা  পিছন থেকে এবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে

পিয়ালি:- "তুই  আমায় আবার এখানে নিয়ে এসেছিস?"

ঋক্ :- "কেন? ভালোলাগেনা তোর? এখানে আসতে? "

কি ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিয়ালি ..

 "লাগে"!

ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে  পিয়ালি হেঁটে চলে সামনের জংলী রাস্তা ধরে। শুকনো পাতার ওপর দু-জোড়া পা-এর শব্দ বেজে ওঠে বারবার

সূর্যটাকে গাছের ভিড়ে দেখা যাচ্ছে না আর এখন। দুজনের মুখেই কোনো কথা নেই

পিয়ালিকে কেমন একটা অস্থির দেখায়। যেন তার বহু জমানো গল্প, বলতে চায় সে ঋক্ কে। কিন্তু নিস্তব্ধতা আর কিছু শুকনো পাতার খসখসে আওয়াজ ছাড়া কিছুই পড়ে থাকে না ওদের কথোপকথনে

 

ঘাট পেরিয়ে বেশ কিছুটা রাস্তা এগিয়ে এসেছে ওরা। এখানে চারিদিকে সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে রয়েছে,মিষ্টি একটা গন্ধ রয়েছে বাতাসে

পিয়ালি:- "এই জায়গাটা খুব ভালো লাগে আমার। বারবার এসেও যেন, সব কেমন নতুন নতুন লাগে।"

 মাথার ওপর নীল আকাশ টার দিকে তাকিয়ে ছেলেটা বলে -" এই আকাশের রঙ তোকে সবকিছু ভুলিয়ে দেয় বল?"

পিয়ালি:- "তুই ভুলিয়ে কেন দিস? সব ? পুরোপুরি মিটিয়ে দিতে পারিস তো?"

ঋক্:- "সেটা কিভাবে?"

পিয়ালি(মৃদু হেসে):- "কেন তোর ওই রং ভর্তি কৌটো উল্টে?"

ঋক্ এর হাসি লাগে কথাটাতে

ঋক্:- "আচ্ছা একটা কথা বল! দুঃখ না ভুলিয়ে,পুরোপুরি মিটিয়ে দিলে ,তুই কি আর আসতে পারবি এখানে? হাঁটতে পারবি আমার সাথে?এই বুনো অন্তহীন, প্রশ্নহীন রাস্তা ধরে? ভাসতে পারবি অশেষ নদীপথ ধরে?দুঃখ ছাড়া কিছু নেই রে আমাদের

দুঃখ আছে বলেই তো সব.. "

আর ও কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় ঋক্

 

পিয়ালি ওর দিকে তাকিয়ে ছিল এতক্ষন । ওর মনে যে ঠিক কি চলছে ,তা বোঝা বড্ড মুশকিল। ওর ক্লান্ত মনের উত্তর যে ঠিক কোন্ প্রশ্নের কাছে ব্যার্থ হয়ে যায় তা বোঝবার উপায় হয়তো আর নেই

 ঋক্ কিছু একটা ভেবে বলতে গিয়েও থেমে যায় । ওরা হেঁটে চলে  লাল সবুজ  রাস্তা ধরে । সূর্য এখনো ডোবেনি আকাশে! এখানে সূর্য ডোবেনা!

 

ওদের মনে হয় যেন ওরা হাজার হাজার বছর ধরে হেঁটে চলেছে এভাবেই । যেখানে কোনো শেষ নেই,শুরু নেই, শুধু আছে অনন্ত রাস্তার শেষপ্রান্তে পালিয়ে যাওয়া

 

                               *-------*

 

তুলিটা হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল রক্তিম, ক্যানভাসের পাশের চেয়ারটাতে । মা এর ডাকে ঘুম ভেঙে যায় তার। 

কাঠের বারান্দাটার সারা দেওয়াল জুড়ে ঝুলছে সম্ভবত ওরই আঁকা বহু ছবি । হলদে আলো পড়ে মনে হচ্ছে তাদের মধ্যে কোনোটা জল রং তো, কোনোটা কাঠ পেনসিলে আঁকা। আবার কয়েকটা ছবি যেন ঠিক একইরকম দেখতে । রক্তিম উঠে গিয়ে রেলিং এর কাছে একটা সিগারেট জ্বালায় ঠোঁটে। সবরকমের রঙ মিশে গিয়ে ওর আঙ্গুলগুলোতে যেন অনাবিষ্কৃত কোনো রং ফুটে উঠেছে। ঠাণ্ডা হাওয়া ভেসে আসছে মিশকালো অন্ধকার থেকে । হাওয়াটাতে মনটা হালকা লাগে ওর। কি অদ্ভুত! দেওয়াল জুড়ে আঁকা প্রায় সমস্ত ছবিতেই একটা মেয়ে সাধারণ। সত্যিই কি নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মেয়েটার মুখের প্রতিটা অভিব্যাক্তি!

 

মা - "ঋক্ ! এই ঋক্ ! খেয়ে নিবি আয়। রাত হয়েছে!"

মা এর কথাটা যেন কানেই গেল না রক্তিমের। অন্ধকারে চেয়ে আছে সে একদৃষ্টে। অস্ফুট স্বরে  কিছু বলতে থাকে ও -"তুই তো সারাজীবন পালাতে ভালোবাসিস পিয়ালি? কিন্তু পালানোর সঠিক জায়গাটায় আর খুঁজে পেলিনা

তোকে বোঝাতে পারিনি আমি । তোকে বোঝাতে পারিনা।  এভাবে পালিয়ে যাওয়া যায় না রে! যায় না! পালিয়ে যেতে পারিসনি তুই আজও।"

 

অন্ধকার থেকে একটা প্রচন্ড হাওয়ার ধাক্কা, রক্তিমকে চমকে দিল মুহূর্তে। ওর হাতের জ্বলন্ত  সিগারেটটা খসে পড়ে নীচের অন্ধকারে।  এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে জিনিসপত্র। রক্তিমের স্তব্ধ চোখ এখন ওর সদ্য আকাঁ ছবিটার দিকে। হাওয়ার চোটে পাশের তাকে রাখা রঙের কৌটোউল্টে পড়েছে ছবিটার ওপর। গাঢ় নীল রঙ গড়িয়ে পড়ছে সারা ক্যানভাস জুড়ে



1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন