বসন্তকালের বিদায় নেবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। গ্রীষ্ম আর অপেক্ষা করতে না পেরে প্রখর জ্বলন্ত রোদ, আর মাঝেমাঝে শান্তিপ্রদেয়া কালবৈশাখীকে সঙ্গী করে চলে এসেছে। বিকেল পাঁচটা অব্দি গরম ভাবটা বেঁচে থাকে। শহরের রাজপথ, গলি,কানাগলি, উঁচু নীচু বড়ো ,ছোটো সব কিছু গরম ,আগুন-পোড়া গরম। স্টেশনের চত্বরে ভ্যাপসা গরম যেমন, ঠিক তেমন ভীড়। ট্রেনের ঘোষণা শোনা মাত্রই লোকের ভীড় জমে।
স্টেশনের
বাইরে পলাশ,কৃষ্ণচূড়ার রঙ রোশনাই চোখে পড়ে
না কানুদের। বেলা যত বাড়ে ততই সূর্যদেবের প্রখর উত্তাপ বাড়ে। ওদের মেজাজও আবহাওয়ার মত গরম হয় । সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি
স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ,আর প্যাডেল করে প্যাসেঞ্জার তুলতেই ওর কত গুলো বছর কেটে গেল। ঘাম
মোছার রুমাল কেনার পর কমলা ওটাকে ন্যাতা করে এঁটো পাড়ত। ব্যাস, নাও এবার
ঘাম কিভাবে মুছবে, হাত দিয়ে ঘামের জল টেনে ফেলে ফের আবার প্যাডেল করে। চ্যাটচ্যাটে
ঘামে ভেজা সবুজ গেঞ্জিটা কেচে পরে রোজ ঠিক
সময় মত চলে আসে স্টেশনের স্ট্যান্ডে । ভাগ্যি
ভালো এই গরমে জামা শুকিয়ে যায়।আসছে বর্ষার জন্য আরো দু –তিনটে জামা কিনে রাখতে হবে।
কানুর মাথা রোদে,গরমে ভার হয়ে আছে। হাজার না, আরো বেশি-কোটি কোটি চিন্তায় ওর মাথা ঘুরছে।
স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রীদের প্রতি উৎসাহ
ভরা আহবান কতবারের পর সদর্থক ফল পাবে বলা খুব মুশকিল। কমলা আজ লংকা, পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা
খাইয়ে পাঠিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা যত এগোচ্ছে , শরীরে ঘুমের আকাঙ্খা বাড়ছে। ঘড়িতে এখন পাক্কা
এগারোটা বাজে। এখনো অব্দি মোট চারজন প্যাসেঞ্জারকে তুলতে পেরেছে কানু।
ভাড়ার টাকা বাবদ চুরাশি টাকায় পকেট ভারী হল। কয়েন এই এতগুলো। কানু ছোটোবেলায় সিক্স অব্দি পড়েছে,অংকের
নামতা ধরলে বলতে পারত,মনে করে করে। সেই মনে করাটা কাজে লাগিয়ে ওর খেয়াল হল সবার শেষে
সুটকো মেয়েটা, আর দু নম্বর প্যাসেঞ্জার সদ্যবিবাহিতা
এই দুজন বাইশটাকা পুরোটাই দিয়েছে কয়েনে। এই কয়েন গুলো কে বদলাতে হবে। আসলে ওর রিকশায় মেয়ে
তুললেই যতীন,বিকাশরা এমন হাসাহাসি করে ,লজ্জায় আর একটা অতিরিক্ত কথা বলতে পারে না কানু।
ওদের বয়স অল্প,তবে কানু কি আর বুড়ো হয়নি... নাহ এবার থেকে প্যাসেঞ্জারের থেকে ভাড়া
নেওয়ার সময় স্পষ্ট করে ও বলে দেবে, যে খুচরো নেবে না।
এসব ভাবতে ভাবতে সময় এগোয়। এই গরমে মাত্র কটা ভাড়া
মেরে কি হবে সে ঠাওরাতে পারেনা। নাহ তবু আর
কিছুক্ষণ দেখা যাক। তারপর খুচরো কয়েন গুলো
দিয়েই বড় রাস্তা পেরিয়ে মিনতির হোটেলে ডিম
ভাত খেয়ে আসবে। মিনতি আজ খুব ঝাড়বে।
খাওয়ার পর বাকি কটা টাকাই বা হাতে থাকবে কানুর
। সে বুঝেও কুলকিনারা করতে পারে না। কমলার
ঠিকে কাজে তবু ভরসা। তা না হলে পুরোপুরি না খেতে পেয়ে মরতে হত।
হরিজন লেনে ওদের এক বাই চব্বিশ নং এককামরা ছোট্ট ঘরে সংসার ওদের । ভ্যাপসা গরমে হাঁড়ির
ভাত টকে যায়। কমলার বাপের ঘর থেকে পাঠানো মিডসেফের ভেতর লাল বাতাসা গলে যায়, ইঁদুর ,টিকটিকির উৎপাতে বিশেষ কিছ রাখা যায়
না।আর থাকেই বা কি ঐ কটা মুড়ি ,বিস্কুট আর
পোকা খাওয়া চাল। বড়লোকদের মত কাজু,কিশমিশ কাঁচের
বয়ামে সাজিয়ে রাখার ইচ্ছেটা ইচ্ছেই রয়ে গেল কানুর। প্যাসেঞ্জারদের ও নিজে কতবার দেখেছে
কাজু কিশমিশের কৌটো কিনে ওর রিকশায় উঠতে। লোভ হয় তবু কানু নিজেকে বোঝায় ওগুলো ওদের
জন্য নয়। দারিদ্র্য ওদের চিরকালীন। আজ থেকে এগারো বছর আগে একটা ছোট আলমারি, মিডসেফ, আর একটা হার যৌতুকে দিয়ে
কমলার বাপ বিয়ে দিয়েছিল। কমলা মা মরা মেয়ে,
বাপের সবজি বিক্রির টাকায় দিব্যি চলে
যেত ওদের। কমলার রঙ কালো বলে পাত্র জুটছিল না। এই সম্বন্ধটা কানুর পাড়ার সুবলকাকা পেরেছিল কানুর বাবার কাছে। সিক্স পাশ কানু সাবানের
কারখানায় কাজ করত তখন। বিয়ের সময় কানুর বাবার চালু রাজমিস্ত্রীর কাজটা পড়তে থাকল। কানু
বলেছিল, ‘বাবার ভরসায় বিয়ে করলাম, এখন বয়স বাড়ছে,রাজমিস্ত্রীর খাটনি বাবা আর পারে না, ঘরে বসে গেল
বাবা।’
তারপর বাবা মরল,ওদের বেশি জ্বালায়নি অব্দি। ব্যাস
সংসার চালানো হল দায়। সে এক বিপর্যয় নেমে এলো। কমলা মুখ বুজে সইল, এখনো সইছে।
এগারোটা ষোলো বাজল ঝাউদহ স্টেশনের ঘড়িতে। যাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমে
কানুদের দিকে সহজে তাকায় না। টোটোওয়ালা গুলো এমন ছেঁকে ধরে, তাই সোজা উঠে বসে টোটোর
মধ্যে। ভাড়া নাকি সস্তায় হয় আর বসেও আরাম। প্রথম প্রথম বাজারে টোটো নামার সময় কানুর
স্বস্তিবোধ হয়েছিল ,রিকশায় চাপ পড়বে কম এই ভেবে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই কোথা থেকে
কি হয়ে গেল!
কানুর দুঃখ হয় , ভেতরটা পুড়ে যায়। এই পয়সায় আর
সংসার টানা যাচ্ছে না। কমলা কি ভাবে কি করছে সে বেশি গভীরে যায় না, তার কাজ টাকা রোজগার
করে সংসারে দেওয়া,সে তাই করে। ঠিকে কাজের চারহাজার আর কানুর ভাড়ার টাকা মিলিয়েমিশিয়ে
কমলা চালিয়ে নিচ্ছে। মেয়েমানুষ তো ,সংসার টিকিয়ে রাখার দায় ও ভুলে যেতে পারে না।
ভাগ্যিস পিকলুটা আজ বেঁচে নেই। জন্মের দিনটা স্মৃতি
এখনো কানুর টাটকা মনে আছে। এপ্রিলের চব্বিশ তারিখ ছিল দিনটা। গরমে হাঁসফাঁস করছিল ওদের
পাড়ার সবাই। দুপুরে ভাত খেয়ে কমলার বেদনা উঠল। সুবল কাকা, আর কানু ভর্তি করতে গেল হাসপাতালে। চারটে দশে ফুটফুটে
শ্যামলা গায়ের পিকলু জন্মালো। তারপর ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করল, কানু বিশ্বাস করত,সেই গরমের দিন
কালবৈশাখী ঝড়টা যেমন সব কিছু ঠাণ্ডা করেছিল,পিকলুও ওদের সংসারে তাই করেছিল।
কমলা,পিকলু কে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে সুবল কাকার
বউ বাড়িতে এনে দিল মা, সদ্যোজাত পিকলুকে। দারিদ্র্যের সংসারে এলো খুশির সংবাদ। কিন্তু
কিছু মাস যেতে না যেতেই পিকলুটার জন্ডিস হল। প্রথমটায় সারল। তারকিছুদিন পর নমাস বয়েসে
আবার খুব পাকাপাকি হল রোগটা। দিনের পর দিন কিরম বিছানায় বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। ওর মায়া
ভরা বড়ো বড়ো চোখ গুলো কানুকে তাড়া করে বেড়ায় আজও। পিকলুকে বাঁচাতে পারেনি কানু,কমলা। অনেকে বলেছিল আবার দ্বিতীয় সন্তান নিতে। কিন্তু
দারিদ্র্য নামক শত্রুকে খুব ভয় করে কানু। থাক । আর বাচ্চাকাচ্চা বাড়িয়ে লাভ নেই।
আর পিকলু আজ বেঁচে থাকলে অর্ধাহারে,অনাহারে কাটাতে
হত। হয়ত ও বড়ো হয়ে, মা ,বাপকে দুষত,এই গরীবের দুনিয়ায় কেন ওর জন্ম দিয়েছে ওরা। ছেলেটা
মুক্তি পেল ন মাস বয়সে।
কমলা শোকে পাথর হয়ে গেছিল। খেত না, ঘুমোতে পারত
না। চোখের জলে দিন থেকে রাত কেটে যেত। পাড়ায় অন্তুদা, সুবলকাকার ছেলেরা বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওর মন ঘোরানোর জন্য লোকের বাড়ি ঠিকে
কাজে ব্যবস্থা করে দিল। অন্তুদার গ্যারাজে অনেক বড়লোক কাস্টমার ছিল।সেই তাদেরই একজনের
বাড়িতে কমলা কাজ পেল। শুরুতে আড়াই হাজার দিত
ওরা।
ততদিনে একটা রিকশা কেনা হল কানুর।দুজনের রোজগারে চলে যেত। কিন্তু ক বছর যাবত কে জানত তিনচাকার এই যানটা এসে একেবারে আধমরা করে দেবে রিকশাওয়ালাদের সংসারকে।
কমলার কাজের বাড়ী থেকে বহুবার প্রস্তাব এসেছে
,ঝা বাড়ির দাদাবাবু কানুকে লোন পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দেবে, যাতে সেই টাকায় কানু
টোটো কিনতে পারে। কিন্তু কানু রাজি হয়নি।পিকলুর নাম ওর ‘গাড়ি’-তে লেখা। মরা ছেলেটার
স্মৃতি কেন বেচবে ও!...
কানু মনে মনে ভাবত, ‘যদিও বা টোটো কিনি,রিকশাটা
রেখে দেব আজন্ম।’
টোটো চালানো শেখা বড় ঝক্কি বলছিল চিকুদা। চিকুদা
রিকশা বেচবে বেচবে বলে প্রায়ই কিন্তু বেচতে পারে কই। মায়া হয় বোধ হয়।
কিন্তু কানু রিকশা বেচবে না।
কমলার অভিমান হয়, ছেলেটাকেই রাখতে পারল না আবার
ছেলের স্মৃতি রাখবে। রিকশাটা রাখলে পিকলু ফিরে আসবে কোনোদিন !
পিকলুর চলে যাওয়ার পর থেকে বাড়িতে ঝগড়া-অশান্তিটা
বাড়ল। দুদিনের মায়ার কাঠি বুলিয়ে কেন যে ছেলেটা ফাঁকি দিল কানু আর কমলাকে। কমলার অভিমানের
কথা সইতে পারে না কানু তাই একেকদিন বাড়ি ফিরতে
চায় না। তারচেয়ে রিকশায় প্যাডেল করে ভারী প্যাসেঞ্জার তুলতে কষ্ট হয় কম।
...
কমলা আজ তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বাড়ি ফিরেছে। চা করে
গা ধুয়ে মেঝেতে বসে। দ্যু চারটে ভালো কথা বলছিল কানুর সাথে। কানুর মনে আশ্চর্য লাগে।
কিছু একটার গন্ধ পাচ্ছে কানু। হ্যাঁ ,ঠিক কানু
জানত, আবার ঐ তিনচাকা কেনার প্রসঙ্গ। লোন নিতে হবে শুনে পিছিয়ে গেল কানু।
মানুষের মন বড় অদ্ভুত। এই টোটো দেখে মনে হয় কত
সহজে ভাড়া পাওয়া যেত, এই আবার মনে হয় নাহ আবার রিকশা বিক্রি করে দিলে পিকলুর স্মৃতিটা
শেষ হয়ে যাবে। পিকলুকে কবর দেওয়ার সময় ঠিক এমন দোলাচল হয়েছিল কানুর। একদিকে ছেলেটাকে
শ্মশানকালীর কাছে নিয়ে গেলে প্রাণোদ্ধ্বারের ইচ্ছে আরেকদিকে মৃত ছেলেকে কবরস্থ করা।
কানুর মন সায় দিল না। তার চেয়ে রিকশাটাই থাকুক।
এভাবে দিন ঠিক চলে যাবে।
মাণিকদার জামাইকে বলে রিকশাটা নীল, হলুদ রঙ করাল
কানু। খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল রিকশাটা। পিকলু চলে গেল তবু মনের সাধ পূরণ করেছিল পিকলুর
নামটা রিকশার পিঠে লিখে। ‘পিকলু’। খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল রিকশাটা। বাড়িতে আনার পর কমলাকে
ডেকে দেখাল রিকশাটা। রিকশাটা দেখে কমলার মুখটা অদ্ভুত ফ্যাকাশে হয়ে গেল। যেন দুঃখের
সাগরে জল বাড়ল।
কানু কিছু বুঝতে পারল না। কি ব্যাপার! এগিয়ে পিছিয়ে
বিভিন্ন দিক থেকে রিকশাটা দেখল। ব্যাস চোখে
পড়ল, পিকলুর নামটার ওপর দিয়ে এমন উজ্জ্বল নীল
রঙ মেরেছে কালু যে পিকলু নামটাই আর দেখা যাচ্ছে না।
কানু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল ঘরের উঠোনে।কিরকম
একটা অস্বস্তি হচ্ছে ওর সারা শরীরে। কাকে দায়ী
করবে! ভগবান কি একটু বুদ্ধি দেয়নি কালুকে। কেন হল..., কিভাবে... এবার তাহলে কি হবে! কানুর মাথায় সব কিছু বনবন করে ঘুরতে লাগল। চোখ বুজে
সে দুটো জিনিস দেখছে, পিকলু লেখা আগের রিকশাটা আর রাজুর কেনা নতুন টোটো। ভাত আর কলমীশাক
দেওয়া সদ্য বাড়া পাত আঢাকাই পড়ে রইল।
কমলাকে দেখা গেল না।
দৈনতায় স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখা বড়ই কঠিন কাজ। বেশ লাগল।
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন