জীবনে
ভালোবাসার কিছু জিনিস থাকা সত্যিই প্রয়োজন। তাইতো নিজের আর সন্তানদের পেট চালানোর
জন্য চার বাড়ি রান্নার কাজ করেও গানের রেওয়াজ ছাড়েনি সেই মেয়েটি, যে সংসার
করবে বলে দু'চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ঘর ছেড়েছিল নিজের চেয়ে ১৫
বছরের বড় প্রেমিকের হাত ধরে। কিন্তু মানুষের কতো দ্রুত পরিবর্তন ঘটে, মেয়েটি কি
নিজেও ভাবতে পেরেছিল! বিয়ের পর সেই প্রেমিক হয়ে গেলো অত্যাচারী ও মদ্যপ। একদিন
অত্যাচার সীমা অতিক্রম করলে স্বামীকে ছেড়ে দুই সন্তানকে নিয়ে মেয়েটি সংসার ছাড়ে।
তখন সে তৃতীয় বারের জন্য অন্তঃসত্ত্বা। তবু জীবনের কাছে হেরে যায়নি সে, দাঁতে
দাঁত চেপে লড়ে গেছে। লড়াকু সেই মেয়েই ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি গায়িকা আশা
ভোঁসলে।
তরুণী আশা
১৯৩৩
সালের ৮ই সেপ্টেম্বর মহারাষ্ট্রের সাংলিতে মঙ্গেশকর পরিবারে তাঁর জন্ম। মাত্র ৯
বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন কোলহাপুরে এবং পরবর্তী সময়ে
মুম্বইয়ে। বড় দিদি লতা মঙ্গেশকরের হাত ধরে প্লেব্যাক সঙ্গীতজীবনে প্রবেশ করেন আশা
ভোঁসলে, যার শুরুটা হয়েছিল ১৯৪৩ সালে, মারাঠি ছবিতে প্লে-ব্যাকের ভূমিকায়। ১৯৪৮
সালে ‘চুনারিয়া’ চলচ্চিত্রে প্রথম প্লেব্যাক গানের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেন
বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে, যে গানের শিরোনাম ছিলো ‘স্বপন আয়া।’ এই গান দিয়েই আশার
শক্তিশালী কন্ঠ সবার নজরে আসে।
ভাই বোন ও মায়ের সাথে আশা ভোঁসলে
রাহুল দেববর্মণের সাথে
সঙ্গীত
নিয়েই আশা ভোঁসলের জীবনে বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে বিভিন্ন ঘটনা। একবার কাঠমান্ডুতে
তিনি জগদ্বিখ্যাত দরবার স্কোয়ারে ঘুরছিলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন রঙচঙে জামাকাপড় ও
চোখে বিচিত্র রোদচশমা পরা এক ভদ্রলোক এক ক্যাফের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোককে
দূর থেকে চেনা চেনা মনে হতে কাছে গিয়ে দেখেন তিনি আর কেউ নন, রাহুল দেব বর্মন। আর
অমনি রাহুলজি তাঁকে একখানা সুর শোনাতে লেগে গেলেন। আশা শুনে বুঝলেন সুরটা একটু
বিচিত্র ধরনের।
মাসখানেক পর একদিন বোম্বেতে একটি গান গাওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আশার কাছে রাহুলজির ফোন এলো। স্টুডিওতে গান রেকর্ড করতে গিয়ে আশা বুঝতে পারলেন গানের সুরটা সেই কাঠমান্ডুতে শোনা সুরটা। যাই হোক, আশার কণ্ঠে গানটি রেকর্ড সম্পূর্ণ হলো। কিন্তু দিনদুয়েক পর রাহুলজি আশাকে জানালেন যে পরিচালক -অভিনেতা দেব আনন্দ ছবি থেকে গানটি বাদ দিয়ে দিয়েছেন। খবরটা শুনে হতাশ হয়ে আশা দেব আনন্দের বাড়িতে ছুটলেন এবং গানটি চলচ্চিত্রে রাখার জন্য তাঁকে অনুরোধ করলেন। খানিকক্ষণ ভেবেচিন্তে শেষমেশ দেব আনন্দ রাজি হলেন।
ওখানেই প্রতিবন্ধকতা শেষ হল না। অল ইন্ডিয়া রেডিও গানটি বাজানো খারিজ করে দিল। কিন্তু শ্রীলঙ্কার রেডিও সেই গানটি বাজালো এবং এশিয়ার সর্বপ্রথম রেডিও স্টেশনটির বিনাকা গীতমালা অনুষ্ঠানে গানটি দীর্ঘদিন এক নম্বর জায়গা ধরে রাখলো। প্রায় পাঁচ দশক পেরিয়ে গেছে। কিন্তু গানটি আজও আট থেকে আশিকে সুরের নেশায় দুলিয়ে চলেছে। সেই গান – দম মারো দম!
এরকম
আরেকটি ঘটনা রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কেন্দ্র করে। দমদম রেকর্ডিং স্টুডিও। তখনও সারেগামা
হয়নি, এইচ.এম.ভি. নামেই পরিচিত ছিলো। সেবার আশা ভোঁসলে
ঠিক করলেন, তাঁর বহুদিনের সাধ পূর্ণ করবেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করবেন। কিন্তু বললেই
কি আর করা যায়! বিশ্বভারতী যদি অনুমোদন না দেয়! তখন আশা ভোঁসলেকে ভরসা দিলেন সুচিত্রা
মিত্র। শেষ পর্যন্ত রেকর্ডিং হয়েছিল এবং সেই রেকর্ড হইহই করে বিক্রিও হয়েছিল। সমালোচনাও
কম হয়নি, যেমন উচ্চারণগত ত্রুটি ছিল কিছু। কিন্তু যে রেকর্ড শ্রোতারা মাথায় তুলে রাখে,
কোনকিছুই তাকে দমাতে পারে না। ক্যাসেট আসছে তখন, সেটাও চুড়ান্ত বিক্রি। আজও আশা ভোঁসলের
গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত সমানভাবে জনপ্রিয়, সমালোচিতও বটে।
সেদিনই
রেকর্ডিং এর পরে ফোটোগ্রাফার ডেকে ছবি তোলানো হয়েছিলো। গানগুলি আশা ভোঁসলে কলকাতায়
নিজে এসে রেকর্ড করেছিলেন, এতোটাই খুঁতখুঁতে হয়ে পড়েছিলেন। কলকাতার শ্রেষ্ঠ
যন্ত্রীরা সঙ্গতে ছিলেন। তিনিই চেয়েছিলেন কোলকাতার যন্ত্রী নিয়ে রেকর্ড করতে।
ছবিতে একদম বাঁদিকের জন হিমাংশু বিশ্বাস। বাঁশি ও সন্তুর দু'টোই বাজাতেন, সুরও
করতেন। তারপরেই রাধাকান্ত নন্দী (তবলা), শীতল গঙ্গোপাধ্যায় (পারকাশন), দুর্গা বড়াল
(বেহালা), আশা ভোঁসলে, দিলীপ রায় (বেহালা), শ্যাম মুখোপাধ্যায় (তবলা ও খোল),
বংশীধর রায় (বাঁশি)। রেকর্ডিস্ট ছিলেন সুশান্ত ব্যানার্জি। তিনি ছবিতে নেই।
সঙ্গীতজীবনে সম্মান, সুখ ও খ্যাতির কোনো ঘাটতি না থাকলেও আশা ভোঁসলের সংসার জীবন ও ব্যক্তিগত জীবন সুখের হয়নি। প্রথমে গণপত রাও ভোঁসলের সঙ্গে বিবাহ, যাঁর অত্যাচারের দরুন সন্তান নিয়ে ঘর ছাড়তে হয় তাঁকে। একদা সুরকার ও পি নায়ারের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এবং ভেঙেছে। দিদি লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে তিক্ত হয়েছে সম্পর্ক। পরবর্তীকালে খ্যাতিমান গায়ক এবং সুরকার শচীন দেব বর্মনের পুত্র ও বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার রাহুল দেব বর্মনের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল। কিন্তু শেষদিকে আগের মতো সম্পর্ক মধুর ছিল না। ২০১২ সালে আশা ভোঁসলের সাংবাদিক মেয়ে বর্ষা অবসাদ থেকে আত্মহত্যা করে। ২০১৫ সালে ছেলে হেমন্ত ক্যান্সারে মারা যায়।
সবাই
ছেড়ে চলে গেছে একে একে। ছাড়েনি শুধু গান। জীবনের প্রতিটা ধাপে, প্রতিটা পদক্ষেপে
গানকে পাশে রেখেছেন তিনি। শত পরিশ্রমের পরেও, শত ব্যস্ততার মাঝেও রেওয়াজ চালিয়ে
গিয়েছেন। গানের মাঝেই পেয়েছেন জীবনযুদ্ধে লড়াই করার অমোঘ শক্তিটুকু। তাঁর এই
লড়াকু মনোভাবই জিতিয়ে দিয়েছে তাঁকে। সর্বকালের সঙ্গীতের মহারাণী আশা ভোঁসলের
জন্য রইল সশ্রদ্ধ প্রণাম।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন