দুর্গাপুজোর রেশ এখনো কাটেনি। কানে এখনো বেজে চলেছে ঢাকের শব্দ। বর্তমানের সম্পর্কের বিভিন্ন জটিল সমীকরণ আর একা একা বাঁচতে চাওয়ার এই সময়ে দাঁড়িয়েও বিজয়ার নাড়ু আর মিষ্টি মুখ মনে হয় সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। বরং সহজ ভাবে বলতে গেলে বিজয়াতে বন্ধুদের কোলাকুলি আর বড়দের প্রণাম ভার্চুয়াল হতে হতে হারিয়ে গেলেও আইসক্রিম, মিষ্টি, অথবা কোল্ডড্রিংকস খাওয়ার প্রবণতা আগের থেকে এখন অনেক বেশি।
পুরোনো
সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বাঁচিয়ে না রেখে আমরা এখন অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক। কিন্তু মজার
কথা এই যে, এই আত্মকেন্দ্রিকতার যুগেও আমরা আমাদের চেহারা নিয়ে যত বেশি সচেতন ততটাই
নিস্পৃহ আমাদের স্বাস্থ্য নিয়ে। তার ফলস্বরূপ বর্তমানে ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার অথবা
স্থূলতা যে কী মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
চিনি,
আরও স্পষ্ট ভাবে বলতে গেলে, গ্লুকোজ আমাদের শরীরের জন্য অপরিহার্য। প্রাণীদেহের যাবতীয়
এনার্জির প্রধান উৎসই হলো গ্লুকোজ। তাই গ্লুকোজ বর্জন করার কথা আমরা ভাবতেও পারি না
এবং তা কখনোই অভিপ্রেত নয়।
বিবর্তনের
পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে দেখা যায়, যেহেতু মিষ্টি জাতীয় খাবার অনান্য খাবারের তুলনায়
অনেক বেশি শক্তি যোগান দেয় তাই জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষার্থে আমাদের ব্রেইন আমাদের প্রাচীন
পূর্বপুরুষদের সময় থেকে এমনভাবেই বিবর্তিত হয়েছে যাতে যা কিছু মিষ্টি তাই আনন্দের উদ্রেক
ঘটায়। আর অন্যদিকে তেতো, বিস্বাদ খাবারের সাথে সাধারণত বিষাক্ত বা নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবারকে
আমরা রিলেট করি। (অবশ্যই সব ক্ষেত্রে তা নয়, উচ্ছে চচ্চড়ি বা নিম বেগুন ব্যতিক্রম,
কারণ এই খাবারগুলো প্রাচীন গুহামানবের আমলে ছিলোনা। তা বর্তমান সভ্যতার ফসল।)
তাই,
প্রাথমিক ভাবে আমরা যখন চিনি বা মিষ্টি জাতীয় কোনো খাদ্য গ্রহণ করি, ব্রেইনের মেসোলিম্বিক
ডোপামিন সিস্টেম উদীপ্ত হয়ে ওঠে। সহজ কথায়, ডোপামিন নামক রাসায়নিকের নিঃসরণ ঘটে
যা ব্রেইনের রিওয়ার্ড সেন্টারকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, একটা পজিটিভ বা ফিল গুড একটা
অনুভূতি কিন্তু চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবারের সাথে জড়িত থাকে অবশ্যই।
কিন্তু,
too much of anything is bad। চিনির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। এবার দেখে নিই চিনি আমাদের
ব্রেইনে কি ক্ষতি করে।
- আমাদের ব্রেইন
অসংখ্য তারের মতো নিউরোন বা নার্ভ সেলের সমন্বয় গঠিত। নিউরোপ্লাস্টিসিটি নামক
একটি ঘটনার মাধ্যমে আমাদের ব্রেইন ক্রমাগতভাবে রিমডেলিং হতে থাকে, অর্থাৎ এই নিউরোনগুলির
একপ্রকার পুনর্বিন্যাস ঘটতে পারে। আর ওই যে বললাম রিওয়ার্ড সেন্টার, ওখানেই এই
ঘটনাটি ঘটে চলেছে। বিভিন্ন ড্রাগ অথবা অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি এই রিওয়ার্ড সেন্টারের
নিউরোপ্লাস্টিসিটিকে স্টিমুলেট করতে থাকে। আস্তে আস্তে তা এডিকশন সৃষ্টি করে।
খুব আশ্চর্য শোনালেও, বিভিন্ন গবেষণায় আপাতত এটাই প্রমাণিত যে চিনি বা মিষ্টি
জাতীয় খাবার এডিকশনের জন্ম দেয়।
এই
প্রসঙ্গে আরো একটা মজার কথা বলি? আমাদের ব্রেইনে প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সে ইনহিবিটারী
নিউরোন থাকে। ব্রেইনের এই অঞ্চলটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। চিনি
জাতীয় খাবার এই ইনহিবিটারী নিউরোনকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করে। ফলে, লক্ষ্য করে দেখবেন
অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়া এবং তার থেকে যে ওবেসিটি তৈরি হয় তা কমানোর জন্য ডায়েটিং বা
নিয়মিত যোগব্যায়াম করা, এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই খুব কঠিন হয়ে যায়। তাই ডায়েটিং তো হয়েই
না, উল্টে এডিকশন থেকে আরো বেশি মিষ্টি খাওয়া এবং ডায়াবেটিস, ওবেসিটির মতো লাইফস্টাইল
ডিসঅর্ডার - লুপ হিসাবে চলতেই থাকে।
- এছাড়াও, অতিরিক্ত
চিনি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে ব্রেইন আয়তনে সংকুচিত হয়ে যায় এবং স্মৃতিশক্তিকে
প্রভাবিত করে। এই কারণে ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের পার্কিনসন, আলঝেইমার
বা ডিমেনশিয়ার মতো রোগ হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।
- অতিরিক্ত চিনি,
ব্রেইনের হিপ্পোক্যাম্পাস এবং অন্যান্য অংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে, আমাদের
সামগ্রিক মুডকে নিয়ন্ত্রণ করে। ডিপ্রেশন বা anxiety তে আক্রান্ত মানুষেরা
যেমন মিষ্টির প্রতি বেশি আসক্ত হয়, তেমনি মিষ্টি জাতীয় খাবার এই রোগগুলিকে বহুমাত্রায়
বাড়িয়ে দিতে পারে।
তাই
মিষ্টি, টক, ঝাল যে খাবারই আপনার রসনা তৃপ্ত করুক না কেন, সবই কিন্তু আসলে ব্রেইনের
খেলা। আর এই হেড অফিস এর কাজকর্ম ঠিকঠাক চালানোর জন্য অতিরিক্ত চিনি, নৈব নৈব চ।
উৎসব
চলতে থাকুক। বিজয়ার প্রণাম জানানোর পা গুলো অথবা কোলাকুলি করার কাঁধের যেন অভাব না
হয় কোনোদিন। আরও হাতে হাত রেখে বেঁচে থাকার অঙ্গীকার থাকুক, আশীর্বাদ থাকুক, ভালবাসা
আর আনন্দে ভরে উঠুক এই পৃথিবী। কিন্তু এই কঠিন সময়ে নিজেদের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর
রেখে মিষ্টি খাওয়া বর্জন করে আমরা বরং মিষ্টি ব্যবহারের ওপর বেশি দৃষ্টিপাত করি।
তথ্য
সূত্র:
Understanding
What Sugar Really Does to Your Brain
Here's
What Sugar Does to Your Brain
Sugar
rush shrinks brain cell powerhouse
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন