পরিবারে একটি শিশুর জন্ম আনন্দের সূচনা করে। প্রত্যেক বাবা মায়ের সাথে সাথে পরিবারের প্রতিটি সদস্যও সব সময় প্রার্থনা করেন একটি সুস্থ সবল শিশুর। কিন্তু জন্মের কিছু পরেই যদি জানা যায় যে শিশুটি রোগাক্রান্ত, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই পরিবারে নেমে আসে দুশ্চিন্তার ধূসর মেঘ। ইদানিংকালে সদ্যোজাত শিশুদের ক্ষেত্রে জন্ডিস খুবই দ্রুত হারে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত একটি রোগ। শিশু রোগাক্রান্ত শুনলেই বাবা মা ভীত হয়ে পড়েন। কিন্তু চিকিৎসকদের মতে সদ্যোজাতের জন্ডিস তুলনামূলকভাবে সাধারণ একটি রোগ। কিন্তু কেন একজন সদ্যোজাত এই রোগে আক্রান্ত হয়? এর থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার উপায়ই বা কি? আজ এই বিষয়েই আলোচনা করব।
জন্ডিস
কি ?
লোহিত
রক্তকণিকায় উপস্থিত
একপ্রকারের হলুদ বর্ণের রঞ্জক পদার্থ হল বিলিরুবিন। যকৃৎ বিলিরুবিন ভেঙ্গে ফেলতে সাহায্য করে যাতে শরীরের মধ্য থেকে এটি মলের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। কোনও কারণে বিলিরুবিন শরীর থেকে
নির্গত হওয়ায় বাধাপ্রাপ্ত হলে রক্তে
বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলে শারীরিক অসুস্থতা সৃষ্টি হয় যাকে জন্ডিস বলা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থাকে
হাইপারবিলিরুবিনেমিয়া (Hyperbilirubinemia) বলে।
গর্ভাবস্থায়
মায়ের যকৃৎ বা লিভার গর্ভস্থ শিশুর রক্তের বিলিরুবিন নির্গত
হওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু জন্মের পর শিশুর যকৃৎ নিজে থেকেই শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রন
করতে শুরু করে। যে সমস্ত শিশুর যকৃৎ জন্মের পরেও কোনো কারণবশত অপরিণত থাকে, তাদের ক্ষেত্রে বিলিরুবিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ
করা সম্ভব হয় না। ফলে রক্তে বিলিরুবিন বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং
শিশুটি জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়। রোগে আক্রান্ত
শিশুর ত্বকের রঙ এবং চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যায়। মলের বর্ণ সাদা
এবং মূত্র স্বাভাবিকের তুলনায়
অনেক বেশি পরিমাণে হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
সদ্যোজাতের
জন্ডিস খুব সাধারণ একটি রোগ। ইদানিংকালে অধিকাংশ সদ্যোজাত শিশু
এই জন্মলগ্নেই এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। পূর্ণমেয়াদে
জন্মানো নবজাতকদের প্রায় ৬০ শতাংশ এবং অপরিণত বাচ্চাদের ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রে প্রথম
সপ্তাহ বা দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে জণ্ডিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাধারণত জন্মের এক – দুই দিনের
মধ্যেই জন্ডিসের লক্ষণ পরিস্ফুট হয়। তবে এটি
চিন্তাজনক অসুখ নয় এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ৭-১০ দিনের মধ্যে শিশু নিজে থেকেই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে।
তবে বিশেষ ক্ষেত্রে জন্ডিস যদি জটিল আকার ধারণ করে তবে তা মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকারক হয়।
তাই সদ্যোজাতের জন্ডিস হলে শিশুকে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখা উচিত।
সদ্যোজাতের জন্ডিসের প্রকারভেদঃ
সদ্যোজাতের
জন্ডিসকে সাধারণত চারভাগে ভাগ করা যায়।
- শারীরবৃত্তীয় জন্ডিস
- স্তনপান জন্ডিস
- স্তন দুধ থেকে জন্ডিস
- রক্তের গ্রুপের অসামঞ্জস্যে জন্ডিস
গর্ভাবস্থায় শিশুর অন্যান্য যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় কাজের মত শিশুর শরীর থেকে বিলিরুবিন নির্গত করার কাজ মায়ের যকৃতের দ্বারা ঘটে। শিশুর জন্মের পরে শিশুর যকৃৎ শিশুর শরীর থেকে বিলিরুবিন নির্গত করার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে। কিন্তু যদি শিশুর যকৃৎ অপরিণত হয় তাহলে এই প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে এবং সদ্যোজাতের রক্তে বিলিরুবিন জমা হয়ে মাত্রা বৃদ্ধি করে। এই ধরনের জন্ডিসকে শারীরবৃত্তীয় জন্ডিস বলা হয়। সাধারণত, এটি জন্মের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে দেখা যায় এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে শিশু সুস্থ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে শরীর হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
অনেক সময় অপরিমিত স্তনদুগ্ধ পানের কারণে সদ্যোজাতের এক সপ্তাহের মধ্যে এই জন্ডিস
হয়। কিছু ক্ষেত্রে মায়ের স্তন দুগ্ধের ঘাটতি বা অসুস্থতার কারণে স্তনদান ব্যাহত হয়। ফলে শিশুর শরীরে জলের
চাহিদা অপূর্ণ থেকে যায়। জল বা তরল পদার্থের অভাবে রক্তে বিলিরুবিনের ঘনত্ব
বৃদ্ধি পায় এবং জন্ডিস হয়। এক্ষেত্রে শিশুকে স্তনদুগ্ধের বদলে বিকল্প দুধ নির্দিষ্ট
পরিমানে পান করালে ধীরে ধীরে জন্ডিস সেরে যায়।
স্তন দুধ থেকে জন্ডিসঃ
এই প্রকারের জন্ডিস স্তন দুগ্ধের কোনো উপাদানের জন্য ঘটে থাকে। মাতৃদুগ্ধে অবস্থিত কোনো উপাদানের ফলে শিশুর যকৃৎ অনেক সময় বিলিরুবিন শরীর থেকে নির্গত করার প্রক্রিয়া করতে অক্ষম হয়। ফলে রক্তে বিলিরুবিন বৃদ্ধি পায় এবং জন্ডিস হয়।সাধারণত সদ্যোজাতের জন্মের প্রথম সপ্তাহেই এই প্রকারের জন্ডিসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে মাতৃদুগ্ধ পান করানো কিছুদিনের জন্য বন্ধ করা হয়। একমাসের মধ্যে শিশু সুস্থ হয়ে ওঠে।
মা ও শিশুর রক্তের গ্রুপ ভিন্ন হলে রক্তের উপাদানের অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি হয়। ফলে রক্তের প্রতিস্থাপনের সময় উৎপন্ন বিলিরুবিন নির্গত হবার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শিশু সুস্থ হয়ে ওঠে।
কখনও কখনও জন্ডিস অন্যান্য কারণ থেকেও হতে পারে। যেমন-
- রক্তে সংক্রমণ বা সেপ্সিস (sepsis)
- সংক্রমণ অথবা শিশুর পাচনতন্ত্রের সমস্যার
- লোহিত রক্তকণিকার ঝিল্লির ত্রুটি
- আভ্যন্তরীণ রক্তপাত
- মায়ের ডায়াবেটিস
- লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা অতিরিক্ত বেশী
হওয়া ( polycythemia)
- জন্মগ্রহণের সময় কোনোপ্রকার আঘাতপ্রাপ্ত হলে
- গ্যালাকটোস শর্করার পাচন সঠিকভাবে সম্পন্ন না হওয়া ( galactosemia)
- বিলিরুবিন নির্গত হওয়ার জন্য অপরিহার্য উৎসেচকের অপর্যাপ্ত পরিমানে উপস্থিত থাকা
- থাইরয়েড গ্রন্থির নিঃসরণে অস্বাভাবিকতা (hypothyroidism)
- সিস্টিক ফাইব্রোসিস
- যকৃতের প্রদাহ
- রক্তের ক্যান্সার যার ফলে হিমোগ্লোবিনের ভারসাম্য নষ্ট হয় ( thalassemia)
- লিভারের এক বা একাধিক নল বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকা (biliary atresia)
- জিনগত ব্যাধি যা বিলিরুবিনের বিপাককে প্রভাবিত করে (crigler najjar syndrome)
সদ্যোজাতের
জন্ডিসের লক্ষন ও উপসর্গঃ
- গাত্রবর্ণ বা শরীরের ত্বক হলুদ বর্ণের হয়ে যাওয়া জন্ডিসের অন্যতম দৃশ্যমান লক্ষণ। সদ্যোজাতের জন্ডিসের ক্ষেত্রে উপসর্গ প্রথমে মুখে দেখা যায় এবং তারপর শরীরের অন্যান্য অংশে ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে ওঠে।
- ঝিমুনিভাব – তীব্র জন্ডিসের ক্ষেত্রে শিশু সারাক্ষন ঘুমে আছন্ন হয়ে থাকে।
- স্নায়বিক লক্ষণ যেমন খিছুনি, তীব্র কান্না, পেশীর ধরনের পরিবর্তন ঘটতে পারে। জটিলতা এড়াতে এই লক্ষণ দেখলে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক।
- শিশু গাঢ় এবং হলুদ প্রস্রাব ত্যাগ করে।
- শিশুর সঠিকভাবে স্তনপান করা থেকে বিরত থাকে। চুষে খেতে অসুবিধা হয়।
- হেপাটাইটিস এবং বিলিয়ারি এটরেসিয়ার ক্ষেত্রে বিলিরুবিনের মাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়। ফলে ফ্যাকাশে বর্ণহীন মল এবং গাঢ় হলুদ বর্ণের প্রস্রাব হয়।
- চোখের সাদা অংশ হলুদ বর্ণ ধারণ করা এর আরেকটি প্রধান চিহ্ন। চরম ক্ষেত্রে, হাত পা এবং পেটও হলুদ রঙের দেখায়।
- বিলিরুবনের মাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে বমির বর্ণও হলুদ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক - সদ্যোজাতের জন্ডিস - পর্ব ২
কলমে - শ্বেতা মিত্র
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন