লেখক – ডঃ বেকি স্মেথার্স্ট
প্রকাশকাল – সেপ্টেম্বর, ২০২২
প্রকাশক – প্যান ম্যাকমিলান
পৃষ্ঠা – ৩০৪
মূল্য - ₹৬৫০
বইটা উপহার পাই এই বছরের জন্মদিনে; অবশ্য প্রথমেই একটা স্বীকারোক্তি দিয়ে দেওয়া ভালো—আমি নিজেই আমার সহকর্মীদের বলে দিয়েছিলাম এই বইটিই আমাকে উপহার দিতে (বইপ্রেমীকে বই উপহার দেওয়ার মানসিক ধকল নেহাৎ কম নয়!)। কারণ বইটির নাম দেখামাত্রই সেটার প্রতি এমন আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করেছিলাম যে অন্য আর কোনো বই উপহার হিসেবে বিবেচনা করার কথা কল্পনাতেও আসেনি। তবে মজার ব্যাপার হল এই বইটার ব্যাপারে তো বটেই, আমি লেখিকার সম্পর্কেও একেবারে সম্প্রতি অবগত হয়েছি | ডঃ বেকি ওরফে রেবেকা স্মেথার্স্ট অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত একজন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী, কিন্তু মূলত খ্যাতি অর্জন করেছেন ইউটিউবে[1] বিজ্ঞানের বিষয়ে ভিডিও বানানোর জন্য। সেইসাথে লিখে ফেলেছেন দুটি জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বইও, যার মধ্যে এটা দ্বিতীয়। উল্লেখ্য, তাঁর প্রথম বই Space: 10 Things You Should Know বিবিসি স্কাই অ্যাট নাইট ম্যাগাজিন দ্বারা নির্বাচিত Books of the yearএর তালিকায় জায়গা করে নেয়।
যাই হোক, গৌরচন্দ্রিকা অনেক হল; বইয়ের কথায় আসি। শুনতে একটু অদ্ভুত লাগতে পারে কিন্তু বইটির শিরোনামের থেকেও আমাকে যেটা বেশি আকর্ষণ করেছিল তা হলো নিচের সাবটাইটেলটি; ভেবে দেখলে কথাটা খুবই সত্যি। ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে মানুষের কৌতূহলের যেমন অন্ত নেই তেমনই ভুল ধারণাও কিছু কম নয়। আর আমার নিজের গবেষণার বিষয় যেহেতু জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা ছিল না তাই এমনটাও খুবই সম্ভব যে আমি নিজেও কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে কিছু জিনিস হয়তো ভুল জানি। তাই একরকম ছাত্রমনোভাব নিয়েই বইটা পড়তে বসেছিলাম।
পদার্থবিদ্যার উপর জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই আমার খুব একটা পড়া হয়নি, কিন্তু যে গুটিকয় পড়েছি তার মধ্যে এই বইটাকে হকিংয়ের A Brief History of Time-এর পরেই আমি স্থান দিয়েছি। গল্পের ছলে লেখিকা জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার ইতিহাস থেকে শুরু করে কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে যেরকম সাবলীলভাবে লিখে গিয়েছেন তার মধ্যে দিয়ে বিষয়টি নিয়ে তাঁর নিজের অকৃত্ৰিম উৎসাহের যে প্রতিফলন ঘটেছে তা পাঠক অনুভব করতে বাধ্য। তবে বই পড়বার আগে এখানে পাঠকরা যাতে রিভিউয়ের মাধ্যমেও তাঁর লেখনী সম্পর্কে একটা ধারণা পান সেই প্রয়াসই আমি করব।
প্রথমেই আসি কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে কোন-কোন ভুল ধারণা সম্পর্কে বইটিতে আলোচনা হয়েছে সেই বিষয়ে। যারা হকিংয়ের বইটি পড়েছেন তাঁরা জানেন হকিং সেখানে বলেছিলেন কৃষ্ণগহ্বররা আদৌ "কৃষ্ণ" নয়; তবে তিনি কথাটি বলেন তাঁর নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত হকিং বিকিরণের প্রসঙ্গে। কিন্তু হকিং বিকিরণের মত সূক্ষ্ম প্রক্রিয়াকে যদি আমরা বাদও দিই তার পরেও কিন্তু বলতে হয় কৃষ্ণগহ্বররা আদতেই "কৃষ্ণ" নয়, কারণ এরা আমাদের মহাবিশ্বের উজ্জ্বলতম এক্স-রশ্মির উৎস। বলতে গেলে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আজ অবধি যে-সমস্ত কৃষ্ণগহ্বর সনাক্ত করেছেন তা এই এক্স-রশ্মির সৌজন্যেই (কথাটা অবশ্য পুরোপুরি সঠিক হল না; এক্স-রশ্মির পাশাপাশি রেডিও তরঙ্গও নির্গত হয় কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্ত থেকে। সম্প্রতি কৃষ্ণগহ্বরের যে ছবি আমরা প্রথমবারের মত তুলতে সক্ষম হয়েছি তা রেডিও তরঙ্গ সনাক্তকরণের মাধ্যমেই)। তাই কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোনো আলো নির্গত হয় না, এই ধারণাটা আসলে ভুল।
কৌতূহলী পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে— কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তে এই এক্স-রশ্মি ও রেডিও তরঙ্গ উৎপন্ন হচ্ছে কীভাবে? সে জবাব আমি এখানে দেব না। সেই গল্প ডঃ বেকির কাছ থেকেই শুনতে হবে।
কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে আরেকটি জনপ্রিয় ভুল ধারণা হল এটি তার আশেপাশের সবকিছুকে বুভুক্ষুর মতো গ্রাস করে নেয়। এই কারণে কৃষ্ণগহ্বরকে "মহাকাশের রাক্ষস" বলে উল্লিখিত হতে দেখেছি। কিন্তু সত্যিটা হল কৃষ্ণগহ্বর আদৌ এইভাবে কিছু গিলে খায় না। বরং সাধারণ পদার্থের পরমাণু এবং আলোর কণিকা তথা ফোটনরা কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে মনের সুখে ঘুরপাক খেয়ে যেতে পারে, যতক্ষণ না কোনোভাবে শক্তি হারিয়ে তারা ঘটনা দিগন্ত অতিক্রম করে ফেলছে। আদতে কৃষ্ণগহ্বরের নামে "গহ্বর" শব্দটির প্রয়োগও ভুল কারণ এটি কোনো গহ্বর বা শূন্যস্থান আদৌ নয়; বরং ঠিক উল্টোটাই। কৃষ্ণগহ্বর একটি নক্ষত্রের চরমতম পরিণতি, যেখানে তার ঘনত্ব অসীম হয়ে যায় |
বাস্তবে কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্ত আপনি নিজে যেচে পার না হতে চাইলে আপনাকে সে টেনে-হিঁচড়ে পার করাবে এমন ক্ষমতা তার নেই। আমাদের সূর্যের চারপাশে আমরা যেমন দিব্যি পাক খাচ্ছি, কাল সেই সূর্য একটা কৃষ্ণগহ্বর হয়ে গেলেও আমরা তার চারপাশে একইভাবে পাক খেয়ে যাব (আমাদের সূয্যিমামা কৃষ্ণগহ্বর হয়ে গেলে তাঁর ঘটনা দিগন্তের ব্যাসার্ধ হবে মাত্র ২.৯ কিলোমিটার মতো; তুলনায় সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব হল ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার মতো); কিছুই পাল্টাবে না। কৃষ্ণগহ্বর বেচারিকে তাই "রাক্ষস" অপবাদ দেওয়াটা ভারী অন্যায়!
শেষ করব লেখিকার কৃষ্ণগহ্বরের ছবি (নিচে দ্রষ্টব্য) দেখার পরবর্তী অনুভূতিকে তুলে ধরে—
"এটি একটি কৃষ্ণগহ্বরের সর্বপ্রথম তোলা ছবি; নির্দিষ্টভাবে বললে আমাদের নিকটবর্তী Messier 87 গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত কৃষ্ণগহ্বরের ছবি। ছবিতে যে কমলা আভা দেখা যাচ্ছে তা হল কৃষ্ণগহ্বরটির চারপাশে ঘূর্ণায়মান পদার্থসমূহ থেকে নির্গত রেডিও তরঙ্গ। এই কমলা আভার পরে বুঝিবা কোনো অশনি সংকেতের মতো ছায়া ফেলেছে কৃষ্ণগহ্বরটি, যার আকর্ষণ আলোও অতিক্রম করতে পারে না। এই ছায়ার সাথে-সাথে ছবিটির চারপাশের অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চলটিও দ্রষ্টব্য। একদিকে এই মহাবিশ্বের চরমতম ঘনত্বের একটি বস্তু, যাকে ঘিরে রয়েছে উত্তপ্ত, উন্মত্ত গতিবিধি। অন্যদিকে এই এলাকাকে ঘিরে-থাকা অন্ধকার ইঙ্গিত দেয় এটি মহাবিশ্বের নির্জনতম, শীতলতম, ও রিক্ততম জায়গার একটি। ছবিটা যতবার দেখি, গায়ে শিহরণ খেলে যায় |"
(অনুবাদ: নিজস্ব)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন