আমাকে যুদ্ধ দাও – রথীন্দ্রনাথ রায়


"নুগ্রহ করে শুনুন যাত্রীবিক্ষোভের দরুণ ডাউন এবং আপের কোনো ট্রেনই আসতে পারছে না।"

"আজো লেট!" নাসির বিরক্তি প্রকাশ করে। এভাবে আর চলবে না। দেশটা যেন যথেচ্ছাচারের পীঠস্থান হয়ে পড়েছে। অ্যাণ্ড অর্ডার বলতে কিছু নেই।

অতনু ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে বলে, "বিক্ষোভকারীদেরও কিছু বক্তব্য থাকতে পারে।"

– "কিন্তু এভাবে? একটা ডিসঅর্ডার মানে মানে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি করে?"

– "সাইলেন্স প্লীজ। দেখ, প্লাটফর্মের বসার জন্য নির্দিষ্ট বেঞ্চে পা তুলে দুজন ভদ্রলোক স্মোক করছেন। আর নিচে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করছে একটা ছোট্ট মেয়ে। ওর শরীরের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে একটা ছোট্ট শিশু। যে শিশুটা বেঁচে রয়েছে এটাই আশ্চর্য।"

অতনু চুপ করে থাকে। কিছু বলতে চেয়েও পারেনা। কিছুক্ষণ পরে বলে, "আচ্ছা এই ছবিটা কি একটা মাষ্টারপিস হতে পারে না?"

– "তোমার রুচিটাই অমনি!"

– "আমার কমদামি পেন্সিলে কোনো দামি চেহারার মেয়ের ছবি আঁকা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে ওই নোংরা মেয়েটাই যথেষ্ট।"

ছবিটা বেশ কয়েকদিন ধরে ভুলতে পারিনি। রাজ্যের বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে এমন ছবিতো আমরা হামেশাই দেখে থাকি। ছবিগুলো আমাদের মানবিক মূল্যবোধে সুরসুড়ি দিয়ে হারিয়ে যায়। আমরা ভুলে যাই। নিজের নিজের ঘরে যা পেয়েছি তা দিয়েই সুখী হওয়ার চেষ্টা করি। বেশ কেটে যায় দিনগুলো। কখনো কখনো এমনতরো কিছু ছবি সামনে চলে আসে। ভাবতে থাকি আমরা মানুষ অথচ এতো তফাৎ কেন? ধনী দরিদ্রের বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য কতরকমের প্রকল্প গৃহীত হয় সংসদে। কিন্তু লালফিতের ফাঁসে যাদের জন্য প্রকল্প তাদের কাছে আর পৌঁছায় না। মাঝপথে খেয়ে ফেলে রাজনীতির দাদারা। আমরা বেশ আছি।

হয়তো ভুলেই গেছিলাম। হঠাৎ সেদিন দেখলাম সেই মেয়েটাকেই। পিঠে একটা প্লাস্টিকের বস্তা। জঞ্জালের মধ্যে থেকে প্লাস্টিকের টুকরো, লোহার টুকরো খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রতিবারে কিছু একটাখুঁজে পাওয়ার সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ওর মুখটা। কত হয় মেয়েটার? খাওয়া জোটে কি? বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মেয়েটাকে ডাকলাম।

– "আমাকে বলচেন?"

– "হ্যাঁ হ্যাঁ, তোকেই। আচ্ছা তোকে একদিন দুর্গাপুর স্টেশনে দেখেছিলাম না?"

– " কাজ ছেড়ে দিইচি।"

– "তোর কোলে একটা ছোট্ট ছেলে ছিল?"

– "ওটা আমার ভাই ছিল।"

– "সে এখন কোথায়?"

– "সে তো মরে গেইচে।"

মরে গেছে! কি অবলীলায় বলল মেয়েটি! আবার কিছু খুঁজতে শুরু করে সে। আমি অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকি। মৃত ভাইটার কথা মনে করতে গিয়ে ওর দুচোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসল না। বাঁচার ভাবনা ওকে এমনই নিষ্ঠুর করে তুলেছে?

– "তোর বাবা কোথায়?"

– "মরে গেইচে। হাঁপানির অসুক ছিল যে।"

— "তোর মা?"

– "পালাইঁ গেইচে। সোন্দরলালের সাথে পেরেম ছিল তো।"

এবারে একটা লোহার টুকরো খুঁজে পায় ও। চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সময় ওকে ক্ষমা করেনা। বাঁচতে হবে ওকে।

অনেকদিন কেটে গেছে। আমি কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছেছি। অনেক জ্ঞান মুখস্থ করছি। দুচোখে অনেক আকাঙ্খা। মেপে মেপে পথ চলতেও অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। পরীক্ষা পাশের পরে আমাকে একটা চাকরি পেতেই হবে। এমন সব ভাবছিলাম। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। ওভারব্রিজের ঠিক নিচেই দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেকদিন আগের দেখা সেই প্লাস্টিক কুড়ানো মেয়েটার মতো। তবে অনেকখানি বড় হয়ে গেছে। রঙচটা একটা শাড়ি গুছিয়ে পড়েছে। কপালে একটা ঢাউস টিপ। ঠোঁটে লিপস্টিক। চুলগুলো বেণী করে পিঠের ওপর ঝোলানো। আমি কিছুতেই মেলাতে পারছি না। বাঁচার ভাবনা যে মেয়েটার মানবিক অনুভূতিগুলোকে নষ্ট করে দিয়েছিল, সেই মেয়েটাই এমন সাজে?

– "ওদিকে যাবেন বাবু? একটা খালি ওয়াগন শান্টিং করা আছে। চারদিকে কেউ থাকেনা। একেবারে নিরিবিলি।"

আমার মনে হলো পায়ের তলার মাটিটা অনেক অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। আর দুকান ছাপিয়ে উপচে পড়ছে রাজধানী এক্সপ্রেসের শব্দ। ছিঃ! কি নোংরা প্রস্তাব দিল মেয়েটা? ওর কি আর কোথাও যাওয়ার ছিলনা? কেন এপথে এল? ওর হয়তো খুব অভাব।

পকেটে একশোটা টাকাই পড়ে আছে। টিউশানির পেমেন্ট পেতেও তো কদিন দেরি আছে। এটা দিলে আমারই বা চলবে কি করে? তাহোক আমি না হয় 'দিন বন্ধুর বাড়িতে গিয়েই উঠব।

কিন্তু কোথায় সে?


2 মন্তব্যসমূহ

  1. রোজদিন এমন বহু মানুষের সাথে দেখা হয়...কতটুকুই বা করতে পারি...খুব সামান্যই কিছুই করতে পারি। সকলকেই লড়াই করে বেঁচে থাকতে হবে। অন্য কোনও উপায় নেই। যে ঐ পথ বেছে নিচ্ছে নিরুপায় হয় সেটাও তো পেশা...নয় কি!!!
    সমাজে যেদিন প্রয়োজন ফুরাবে ঐ পেশায় আর কাউকে দেখা যাবে না...
    তবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যে কোনও পেশা চালিয়ে যাওয়া বিশেষ করে এই পেশা, তীব্র যন্ত্রণার...

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমাদের পত্রিকা নিয়মিত পড়েন এবং যথাযোগ্য মতামত দেন, আমরা কৃতজ্ঞ।

      মুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন