নদী কথা বলে, আমি বুঝি। কুলকুল ধ্বনির মধ্যে তার শব্দ থাকে লুকানো। নিজস্ব উপলব্ধির ঘরের ঝুল জঞ্জাল সাফ করে দিলে তবেই সেই শ্রবণযোগ্যতার মাপকাঠি চড়চড় করে বর্দ্ধিত হয়, উচ্চারিত কহন কর্তনকৃত করে কর্ণকুহরে। চৌদ্দোয় যেদিন নদীতে নাইতে গেলুম, ডুব দিলুম, উঠে আশ্চর্যান্বিত, নদী বয়ে চললো নিয়ে রক্তধারা। ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি জলসিক্ত হয়েই বাড়ির চৌকাঠে গিয়ে চিৎকারে কুটির মাথায় উঠালাম,
– জলজ দংশনে...
মা আর কাকী ছুটে এল। ঘরে নিয়ে গিয়ে বিবসনা করে পরীক্ষণের পর জানলো,"ভয় নেই, আজই তুমি রজঃস্বলা হলে ..."
তার মানে, কি করনীয়, কি বিধিনিষেধ আমার মগজে পই পই করে ঢোকানো হল। বিষয় বড় জটিল। সারারাত ঘুম গেল। এরপর থেকে কৌতুহলে, লুকিয়ে চুরিয়ে যত জানি তত চমক খাই। শিহরিত হই, শরীর বাড়ে। পুলকিত হই, উৎফুল্লতায় দিনরাত এক হয়ে ভাবি সত্য-মিথ্যা। শরীর নিয়ে যত শুনি তত জানি রোমাঞ্চিত হই। সে এক অনন্য অনুভূতি।
পাখিপ্রাণ আমি। ওরা গল্প বলে, গান বাজায় কিন্তু যন্ত্রবিৎ হয় না। কত কথায় মুগ্ধতা! ভালোবাসার কি আকুলতা! এত ভাল আত্মপ্রকাশ আত্মীয়তার আত্মসমর্পন আত্মসম্মানের তো বটেই! পাখি হয়ে ডানা মেলে দিই। গান গাই গল্প করি, যে গল্পে প্রেম থাকে, প্রেমিক শীষ দেয়, দোয়েল কোয়েল ডানা ওড়ায়, টিয়ে চড়ুই ঘুরপাক খায় মজায়, দৃশ্যমান হয়ে পড়ে ওদের গড়া চিত্রনাট্য প্রেমপর্বে প্রেমিকের আগমনী সঙ্গীতের মূর্ছনায়। আমি লোভী হই, প্রেমিকা হতেই থাকি, মন ভারী হয় শরীর হালকা হয়ে যায়, উড়ে যাই, উড়ে যাই ...
উড়তে উড়তে ডানা ভারী হয়, ইচ্ছে হয় বসি, ডানাকাটা পরী তখন। অহংকারী অহর্নিশ। কিন্তু মন যে দুর্বল তবে দুর্বার আবার দুর্বোধ্যও বটে। হৃদয়ের চুপিসারের ইঙ্গিতবহ অনুভূতি সারা শরীরে হোলদোল তোলে, পাশে কেউ, কাউকে .....খুঁজি, খোঁজ শুরু করি, চোখ মন আর শরীর দিয়ে। শরীর ততক্ষণে এক পাক্কা কর্মী হতে রাজী হয়ে ছটফটাচ্ছে সেই রোমাঞ্চকর আশ্চর্যজনক জীবন জন্মচক্রের কর্মকান্ডে খেলোয়াড়োচিত ভুমিকায় স্বমহিমায় অবতীর্ণের জন্য।
জানিনা এরকম কেন হয়। মেয়েরা তো সহনশীল হয়। তবে? শুনেছি মেয়েদের বুক ফাটে তবুও মুখ ফোটে না। তাহলে? তাহলেও আছে, আমারও ইচ্ছে হয় কিন্তু মুখে আনি না, তাতে কি? লোকলজ্জায় ভয়ে চুপ করে থাকি বটে কিন্তু তাতে নিজের ইচ্ছেগুলোর কবর খনন বৈ আর কি প্রাপ্তি ঘটে?
জীবন বড় জটিল তাও আবার অন্যের সাথে বেমানান। আমি সেইরকম যার গতিপথ ভিন্ন। আমার এ চাওয়া কিন্তু শুধু হৃদয় হতেই উৎসারিতই নয়, এই শরীরী চাহিদা কামড় বসায় আমার ষোড়শী যৌবনের মউবনে। কে যেন উঁকি দেয়। প্রথম ভালোবাসা,প্রথম প্রেমে লাজুকের লাজবন্তী। বলেইছি এই লাজহীনার আবার উল্টো ফরমাশ,বুক যত না ফোটে মুখ ছোটে লাগামহীন, যাকে বলে ঠোঁটকাটা।
সে তবুও আসে। রোজ রোজ, ক্রমশ বার বার,মউ খেতে, প্রেমের বীজ অঙ্কুরিতে ...আমি মাটি আলগা করে দিই আর ও প্রেমানন্দে বীজ বোনে। আমি বুঝি আর না বুঝি বারি ছিটাতে কার্পণ্য করি না। সুখও যে ভাগের, আমি যে তারও ভাগীদার!
গাছগাছালি অপার স্নেহের! কত বন্ধুপ্রতিম কত প্রাণেন্দ্রিয়। ওরাই তো আমার প্রাণ। শ্বাসে ও আবার নির্গত নিঃশ্বাস নিঃশেষিত করে ও। শীতলতা শান্ত শান্তির মূর্ত প্রতীকী। কোন কোনদিন গাছগাছালির পাশে গিয়ে দাঁড়াই, ফাঁকফোকর খুঁজে উঁকি মারি সেই জানার পানে ...যদি তাকে পাই....আমার প্রেমকে...
প্রেমিক আসে,তার শরীরের সুবাস আলাদা, সুবাসিত, রোমাঞ্চকর। আমি সেই গন্ধ ভালোবাসি, সেও কুন্ঠাহীন, আমার কামোদ গন্ধ তারও বড় প্রিয়। দুজনই যখন কামোত্তেজনায় ছটফটাই, সে সোহাগ সেতুতে চড়ে, আর আমি তার উত্তেজনা কমাতে নিজেকে মেলে ধরি তারই শরীরের নীচে ...সে বড় সুখানুভূতি বড় প্রাপ্তি।
স্বপ্ন অনেক দেখি। ঘুমিয়ে পড়ি আবার স্বপ্ন দেখি জাগি, বিশ্বাস করি না কিন্তু আবার ঘুমিয়ে পড়ি। স্বপ্ন ভুলে যাই। তখন কিন্তু সে জানায় আশ্বাস দেয়, মিলনেই ঘর গড়ে উঠবে শীঘ্রই ...আমি আশার ঘরে বীজবপনকে নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলি। দূরের পাহাড় যেন আমার পাহাড়াদার! ও সর্বক্ষেত্রে সর্বক্ষণ নিরপেক্ষ নিরিক্ষার। প্রহরীর অক্লান্ত পরিশ্রমে সে আমায় কিছু ইশারা করে, কিছু বলতে চায় আমি বুঝেও না বুঝি, এটাও আমার ভান। তখন আমি দিশাহারা। চারিদিক রোমান্টিক লাগে। বিপরীতমুখী বিপর্যয়কর পরিবর্তন আমার মগজ নিতে অক্ষম থাকে। অবুঝ তাই পাহাড়ের কোলে গিয়ে হাঁকি, এসো এসো এসো ....
ডাক ফিরে ফিরে আসে বারে বারে। সে আর আসে না। কিন্তু আমি তো ভাল জানি পাহাড়ে তার এলার্জি, আমাতে নয়। পাহাড়ে উত্তরণ নয়, আমায়, কারণ বাধাহীন আমার দেহ আর মন যে বড়ই নরম, পাহাড়ের দেহ বড় রুক্ষ, মনহীন। মাথার উপর আকাশ। নীল আদিগন্ত। আমার চাউনি, আমার গুরু, আমার রক্ষী, আমায় মাপে, আমার পরিবর্তন আমার শরীরের।
মা কাকীমার সন্দেহ আকাশসীমা ছাড়িয়ে, ব্যাপার সন্দেহজনক। কাজের মাসি আরো সজাগ, মায়ের কানভারি করে আমার তলপেট নাকি ভারী ...অকাট্য প্রমান, অকথা কুকথা, গালিগালাজ হাজারো প্রশ্ন এড়িয়ে আমি ছুটে চলি প্রকৃতির কাছে, বাঁচতে চাই কিন্তু বাঁচাতে নয়। মনপ্রাণ ভেঙে চৌচির। ভালোবাসা ব্যতিরেকে মনকে তৈরী করে নিই। মাথায় আকাশ দুরে পাহাড় পাশে গাছগাছালি কে সাক্ষী রেখে নদীতে নেমে পড়ি, কোমড় জলে, আর তখনই পাখি গান ধরে-
"সে আর আসিবে না ফিরে"
যখন নিজেকে নির্দিষ্ট করা, মন আর শরীর একনিষ্ঠ পদক্ষেপে তৈরী, যেখানে বড় কষ্টের সেই ভয়ংকর সিদ্ধান্তে অবিচল সেখানে তখন ধারালো ছুঁচালো ছুরিকাঘাতই ছিল যথেষ্ট ...নদীর প্রবাহে রক্তধারা বয়, বাধাহীনভাবে প্রকৃতির সবাই কথা কয়ে ওঠে,
"শাবাশ! শাবাশ! সাহসিনী ওরে
নারে, সে আর আসিবে না ফিরে ....."
এটা ঠিক গল্প লাগলো না আমার...মুক্তগদ্যের মতো...
উত্তরমুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন