মন্থর পায়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে হেঁটে চলেছেন মৃণ্ময়ী। অন্যদিন এরকম সময় তাঁর খুব তাড়া থাকে, সাড়ে চারটের বাসটা ধরার জন্য প্রায় ছুটতে থাকেন তিনি। কিন্তু, আজ যেন আর হাঁটার শক্তিই পাচ্ছেন না। টুকরো টুকরো কালো মেঘ জমেছে শেষ বিকেলের আকাশটাতে, সেইসঙ্গে একটা আর্দ্রতাজনিত গরম, আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন মৃণ্ময়ী। ভাদ্র শেষ হয়ে এসেছে তবু মাঝে-মধ্যেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমে আসে, গ্রামের কাঁচা রাস্তাটাকে আরও খানিকটা ভেঙেচুরে দিয়ে যায়। পুজোর আগে আগে এই গ্রামের লোক পসরা সাজিয়ে শহরে যায় কেনাবেচা করতে, অনেকে বেশকিছু বাজার করেও আনে। বিকেলের দিকটায় এইসব লোকদের আনাগোনা কিছু বেড়ে যায় রাস্তায়, আর তাদের যাতায়াতের দৃশ্যগুলি বেশ মন দিয়ে দেখতে থাকেন মৃণ্ময়ী। কিন্তু, আজ কোনও কিছুতেই তাঁর আর মন নেই। বুকের ভেতর জমে থাকা একটা কষ্ট যেন ঠেলে গলার কাছে উঠে আসতে চাইছে, চোখ জলে ভরে আসতে চাইছে, আরও একবার আকাশের দিকে তাকান মৃণ্ময়ী, আর তক্ষুনি একফোঁটা বৃষ্টির জল এসে ভিজিয়ে দেয় চোখের পাতা। তাঁর দুঃখে প্রকৃতিও বোধহয় আজ কাঁদবে।
কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের সন্তান মৃণ্ময়ী। আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে তাঁর বিয়ে হয় নীরেন দাশগুপ্তের সঙ্গে। স্বামী বড় ব্যবসায়ী, শ্বশুরবাড়িও বেশ ধনী। তবে, মৃণ্ময়ীর বরাবরই ইচ্ছে ছিল শিক্ষিকা হওয়ার। শ্বশুরবাড়ি এমনিতে সম্ভ্রান্ত হলে কী হবে, তারা অত্যন্ত রক্ষণশীল। বাড়ির বউয়ের হাজারটা গুন থাকবে, পাড়ার লোকের কাছে সে প্রশংসার পাত্রী হয়ে উঠবে তাতে কারো কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু বাড়ির বউ চাকরি করতে বাইরে যাবে, এ তাদের মোটেই পছন্দ নয়। মৃন্ময়ীও হাল ছাড়েননি, অনেক সংগ্রামের পর অবশেষে বিয়ের পাঁচ বছর পরে স্বামীর সহায়তায় একটা স্কুলে চাকরি জুটে যায় তাঁর। আর সেই চাকরির সূত্রেই মৃণ্ময়ীর কণ্ঠীতলা গ্রামে আসা। কণ্ঠীতলা প্রাইমারি স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন মৃণ্ময়ী। কিন্তু, কণ্ঠীতলা সেইসময় ছিল গণ্ডগ্রাম। এখনও যে তার খুব উন্নতি হয়েছে তেমনটা বলা যায় না, তবে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, এই যা।
গ্রামের স্কুলে পড়াতে এসে প্রথমে বেশকিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় মৃন্ময়ীকে। তাঁর জন্ম, বড় হয়ে ওঠা সবই শহরে, গ্রামের পরিবেশ তাঁর কাছে অসহনীয় ঠেকে। দ্বিতীয়ত, থাকবার কোনও ভাল জায়গা পাওয়া যায় না কণ্ঠীতলায়। বাকি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বাড়ি আশেপাশের গ্রামে বা মফঃস্বলে, তাই তাঁরা নিয়মিত যাতায়াত করতে পারেন, কিন্তু কলকাতা থেকে নিয়মিত যাতায়াত করা মৃণ্ময়ীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। অগত্যা তাঁকে গ্রামে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিতে হয়। তবে, কণ্ঠীতলায় কোনও থাকবার ব্যবস্থা করা তখন সম্ভব হয়নি, বাধ্য হয়েই মৃন্ময়ীকে বাড়ি ভাড়া নিতে হয় পাশের গ্রাম তুলসীপুকুরে। সেখানে একখানা টিনের চাল দেওয়া পাকা বাড়ির সন্ধানও মেলে। বাড়ির মালিকের ছোট্ট পরিবারের সঙ্গেই থাকতেন মৃণ্ময়ী, রান্না হত এক হেঁশেলেই। দিন চলছিল এভাবেই, মৃণ্ময়ী ঠিক করেছিলেন বছর পাঁচেক কোনওভাবে কাটিয়ে দিয়ে বদলির আবেদন করবেন। কিন্তু, পাঁচ বছর পর বদলে যায় পরিস্থিতি, যে বাড়িতে মৃণ্ময়ী ভাড়া থাকতেন, সেই বাড়ির মালিকেরা বাড়ি বিক্রি করে শহরে চলে যেতে চান। কিন্তু, খদ্দের না মেলায় মৃন্ময়ীর কাছেই কিছু কম দামে তাঁরা বিক্রি করে দেন বাড়িটা। ততদিনে মৃন্ময়ীও ভালবেসে ফেলেছেন গ্রামটাকে, গ্রামের মানুষগুলোকে, কণ্ঠীতলা স্কুলের ছোট্ট ছোট্ট পড়ুয়াগুলোকে। ফলে, কলকাতায় আর ফেরা হয়নি তাঁর, সেই থেকে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবেই রয়ে গিয়েছেন তুলসীপুকুর গ্রামে।
তুলসীপুকুর থেকে কণ্ঠীতলা আধঘণ্টার পথ, বাসেই যাতায়াত করতেন মৃণ্ময়ী, তবে সাইকেল ভ্যানের ব্যবস্থাও আছে। নীরেন এখন আর আসতে পারেন না গ্রামে, গত তিন-চার বছর ধরে তিনি পক্ষাঘাতে পঙ্গু। মৃণ্ময়ীই কলকাতায় যান ছুটিতে ছুটিতে, দেখাশোনা করে আসেন। নীরেনের কাছে থাকে এক বিশ্বস্ত পরিচারিকা আর এক ভাগ্নী। মৃণ্ময়ী থাকতে না পারলেও, স্বামীর শুশ্রূষার কোনও ত্রুটি তিনি একদিনও হতে দেননি। মৃণ্ময়ীর মনে পড়ে যায় অনেক পুরনো কথা। যখন নীরেন সুস্থ ছিলেন, প্রায়ই আসতেন তুলসীপুকুরে। প্রতিদিন স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে সকালে ও সন্ধ্যায় নিয়ম করে গ্রামের বাচ্চাদের হাত ধরে হাঁটতে বেরোতেন, ছোটদের কিনে দিতেন বাদাম, ঝালমুড়ি, মেলা বসলে মেলা থেকে কিনে দিতেন ঘুড়ি, বেলুন, কাঁচের চুড়ি। তারপর হাঁটতে হাঁটতে দুজনে গিয়ে বসতেন গ্রামের শেষপ্রান্তে অবস্থিত পুকুরটার ধারে। পুকুরের গা ঘেঁষে ঘন তুলসীর জঙ্গল, নানা জাতের তুলসীর গাছ রয়েছে সেখানে। আর সেইকারনেই বোধহয় গ্রামটার নাম তুলসীপুকুর। সেসব অনেকদিন আগের কথা, গ্রামের পরিবেশটা বড় ভাল লাগত তাঁদের। বড় ভালবাসতেন তাঁরা কাক ডাকা ভোর, ঝিঁঝিঁ ডাকা দুপুর আর শেয়াল ডাকা সন্ধ্যেগুলোকে। ছোট্ট শিশু থেকে চারাগাছ, তরুলতা, পশু-পাখি যখন যা কিছু হাতের কাছে পেয়েছেন, তা-ই দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছেন এই নিঃসন্তান দম্পতি। বিনিময়ে পেয়েছেন মানুষ থেকে প্রকৃতি, সকলের ভালবাসা। স্মৃতিগুলো বড় মধুর, কিন্তু সবই এখন ইতিহাসের পাতায় স্থান নিয়েছে।
আজ মৃণ্ময়ীর শিক্ষিকা জীবনের তিরিশ বছর পূর্ণ হল। তাঁর নাম এখন অবসরের খাতায়। তিরিশ বছর আগে এরকমই একটি দিনে তিনি ইতিহাসের শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন কণ্ঠীতলা প্রাইমারি স্কুলে। কিছুদিনের মধ্যেই ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন তাদের প্রিয় মৃণ্ময়ী দিদি। তবে, এর বাইরেও আর একটা পরিচয় ছিল তাঁর। ছাত্র-ছাত্রীরা ভালবেসে তাঁকে বলতেন গল্পদিদি। অবশ্য এর একটা কারণও ছিল, অবসর সময়ে মৃণ্ময়ী বাচ্চাদের বিভিন্ন গল্প বলতেন, রূপকথা থেকে আরম্ভ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, সমস্তই ছিল তাঁর গল্পের ঝুলিতে। খুব ভালবাসত ছোটরা তাঁর কাছে গল্প শুনতে। আর সেই থেকেই মৃণ্ময়ীদির অপর নাম হয়ে যায় গল্পদিদি। টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে এক একবার ভেসে উঠেই মিলিয়ে যায়। মৃণ্ময়ী বাসে উঠে সিটে বসে পড়েন, কিছুক্ষণ পর বাস ছেড়ে দেয়। পিছু হটতে থাকে কণ্ঠীতলা গ্রাম। এই পথের নিত্যযাত্রী মৃণ্ময়ী আগামীকাল থেকে আর এই পথে আসবেন না, স্কুলের পাওনা-গণ্ডা পুরোপুরি না মেটা পর্যন্ত তাঁকে অবশ্য আসতে হবে মাঝেমাঝে, কিন্তু নিয়মিত স্কুলে আসা, ক্লাস নেওয়া, বাচ্চাদের গল্প শোনানো কোনওটাই আর হয়ে উঠবে না। বুকের ভেতরটা টনটন করে ওঠে মৃণ্ময়ীর, বিষণ্ণতায় চোখ বুজে ফেলেন তিনি।
দীর্ঘ একটা রাত পেরিয়ে আসে মনোরম সকাল। আধো রোদ গায়ে মেখে হাঁটতে বেরোন মৃণ্ময়ী। প্রতিটা ছুটির দিনেই প্রাতঃভ্রমণে বের হন তিনি, তবে আজ তাঁর অনন্ত অবসর, কোনও তাড়া নেই বাড়ি ফেরার। লতির আসতেও এখন ঢের দেরি আছে। লতি, মৃণ্ময়ীর বাড়ির কাজের মেয়ে, এই গ্রামেই শ্বশুরবাড়ি। আগে সব কাজ মৃণ্ময়ী নিজে হাতেই করতেন, বছর দুয়েক হল শরীরে আর তেমন বল পান না, সেইকারণেই লতিকে রাখা। মৃণ্ময়ীর অবসরের খবরটা শুনে লতি আবদার করে বসেছিল লেখাপড়া শেখার। মৃন্ময়ীও ভেবেছিলেন লতিকে শেখালে বেশ হয়, সময়টা ভাল কাটে। কিন্তু, এখন তিনি ঠিক করেছেন আর তুলসীপুকুরে থাকবেন না। বাড়ি বিক্রি করে বাকি জীবনটা কলকাতাতেই কাটিয়ে দেবেন। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই বাড়ির দিকে ফিরছিলেন মৃণ্ময়ী। হঠাৎ কতকগুলি শিশুকণ্ঠের কথোপকথন শুনে থমকে দাঁড়ালেন। তারা কথা বলছিল স্মার্টফোন নিয়ে –
১ম – ‘জানিস আমার সোনাদা অ্যাপেলের সেট কিনেছে। কিনবে না? কলকাতায় থাকে, হেব্বি পয়সা। খুব দামি।’
২য় – ‘তাতে কী হয়েছে? আমার জামাইবাবুও তো কিনেছে রিয়েল মি।’
১ম – ‘হুহ! অ্যাপেলের দাম সবচেয়ে বেশি, রিয়েল মি কিছুই না।’
৩য় – ‘আমার বাবা বলেছে এবার ভাল রেজাল্ট করলে আইফোন কিনে দেবে।’
১ম – ‘হুহ! আইফোন? কত দাম জানিস?’ ...
বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে মৃণ্ময়ীর, ছোট ছোট শিশুদের শৈশবও গ্রাস করেছে যান্ত্রিকতা। প্রযুক্তির সঙ্গে তাঁর কোনও বিরোধ নেই, কিন্তু সবকিছু ব্যবহারের একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। আজকের বাচ্চারা মাঠে গিয়ে খেলে না, দিদিমা-ঠাকুমার কাছে গল্প শোনে না, গল্পের বই পড়ে না, পুজোর আগে নতুন জামাকাপড় নিয়ে কথা বলে না। তাদের গল্পের বিষয় যন্ত্র, তারা খেলতে পছন্দ করে ভিডিও গেম, তারা গুরুজনকে প্রণাম করে না, বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানায় না, তারা কেবল অন্তর্জালে মেসেজ পাঠাতে জানে। তুলসীপুকুর গ্রামে এত দামি ফোন অবশ্য খুব একটা কেউ ব্যবহার করে না, তবে এই সরল মানুষগুলোর জীবনগুলোকেও ধীরে ধীরে গ্রাস করছে যন্ত্রসভ্যতা। বিশেষ করে করোনা অতিমারির পর থেকেই এর প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছুটা হতাশা সঙ্গে নিয়েই বাড়ি ফিরে আসেন মৃণ্ময়ী। দুপুরে দুদণ্ডের জন্য বিশ্রাম নিয়েছিলেন তিনি, বিকেলে আবারও হাঁটতে বেরিয়ে যান।
কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে, মেঠো রাস্তাটা রীতিমতো কর্দমাক্ত। বছর পনেরো হল সন্ধ্যের দিকে রাস্তায় ইলেকট্রিকের আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, আলো এসেছে গৃহস্থের ঘরেও, তার আগে অবধি তো সন্ধ্যে হলেই ভূতের রাজ্য হয়ে থাকত। তবু তুলসীপুকুরকে গণ্ডগ্রামই বলতে হয়, রাতদুপুরে এখনও শেয়ালের উৎপাত, ব্যাঙের ডাক, সাপের হিস হিস শব্দ, আর গা ছমছমে রাত যেমন ছিল, তেমনই আছে। কলকাতা থেকে মাত্র দেড়শ কিলোমিটার দূরে যে এখনও এমন পাড়াগাঁ থাকতে পারে তা বোধহয় চোখে না দেখলে কেউ অনুমান করতে পারবে না। সেই রাতে একটু তাড়াতাড়িই খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়েছিলেন মৃণ্ময়ী, কিন্তু শুয়ে পড়ার তাড়া নেই। তাই, একখানা বই হাতে নিয়ে গিয়ে বসলেন পড়ার টেবিলে। পড়তে পড়তে কখন যে নিদ্রাদেবীর আগমন ঘটেছিল তা বোধহয় বুঝতে পারেননি মৃণ্ময়ী। ঘুম ভাঙল ডোরবেলের শব্দে। চমকে উঠলেন মৃণ্ময়ী, এত রাতে আবার কে? চোখ খুলে দেখলেন রাত তো নয়, এ যে সকাল। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তারপর যেন কখন সকাল হয়ে গিয়েছে। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখলেন সাড়ে ছটা বাজে। এত সকালেই বা কে এল? লম্বা একখানা হাই তুলে মৃণ্ময়ী এগিয়ে গেলেন সদর দরজার দিকে। দরজা খুলেই আরও একবার অবাক হওয়ার পালা, সামনে দাঁড়িয়ে দুটি সুপরিচিত শিশু, তাঁরই স্কুলের দুই সেরা ছাত্র। ‘তোরা এখানে?’, প্রশ্ন করেন মৃণ্ময়ী।
১ম ছাত্র – ‘হ্যাঁ দিদি। আপনার ক্লাস না করলে কিছু ভাল লাগছে না। আমরা আপনার কাছে পড়ব।’
মৃণ্ময়ী – ‘ওমা সেকি! তোরা এখানে এলি কীভাবে? বাড়ির লোক তোদের একা একা আসতে দিলে?’
২য় ছাত্র – ‘বাড়িতে কেউ জানেনা দিদি। আমরা পালিয়ে এসেছি।’
মৃণ্ময়ী – ‘কাজটা মোটেই ভাল করিসনি। যা শিগগিরি বাড়ি ফিরে যা।’
১ম ছাত্র – ‘আমাদের একটু পড়া দেখিয়ে দিন না দিদি। আপনার কাছে একটু পড়েই ফিরে যাব।’
মৃণ্ময়ী – ‘এখন পড়বি? স্কুল যাবি না?’
২য় ছাত্র – ‘স্কুলের তো অনেক দেরি। সেই সাড়ে দশটায়। ততক্ষণে হয়ে যাবে।’
মৃণ্ময়ী – ‘না না তোরা আজ বাড়ি ফিরে যা। বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে। আর এখন তো তোদের নতুন ইতিহাসের দিদিও এসে গেছেন স্কুলে। তিনিই শিখিয়ে পড়িয়ে দেবেন ঠিক। অমন করে কাউকে কিছু না জানিয়ে আমার কাছে আসিস না বাবা, ফিরে যা।’
১ম ছাত্র – ‘তাহলে আপনি আমাদের গল্প শোনাবেন দিদি? ছুটির দিনে বাড়ির লোককে সঙ্গে নিয়েই আসব।’
২য় – ‘হ্যাঁ দিদি। আপনি আমাদের গল্প শোনান না দিদি। মিথু, ছবি ওরাও শুনবে বলছিল। আমরা আসব ছুটির দিন করে।’
১ম ছাত্র – ‘হ্যাঁ দিদি। এবার আর না করবেন না।’
মৃণ্ময়ী কিছুক্ষণ ভাবলেন। বাচ্চাদের গল্প শোনালে মন্দ হয় না, মাঝেমধ্যেই সময়টা ভাল কাটে। আবার পরক্ষণেই তাঁর মনে হল এমন হলে তিনি নতুন করে জড়িয়ে পড়বেন এইসব শিশুদের সঙ্গে। তাহলে তো তাঁর আর কলকাতায় ফেরা হবে না। এতকিছু ভাবলেন বটে, কিন্তু মুখে তেমন কিছুই বললেন না, কেবল বললেন – ‘আচ্ছা সে না হয় দেখা যাবে। এখন তোরা বাড়ি যা দেখি।’ ছেলেদুটি ভারাক্রান্ত মুখ নিয়ে ফিরে গেল, মৃণ্ময়ীর চোখের কোণেও একফোঁটা নোনা জল দেখা দিল সেইসময়।
রবিবারের সকাল। মৃণ্ময়ীর ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছে। ভোররাতে বৃষ্টি হয়ে বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিল, আর তাতেই বোধহয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন মৃণ্ময়ী। সকালে উঠেই চটপট একটা ফোন সেরে নিলেন, কলকাতার বাড়িতে সবাই ঠিকঠাকই আছেন, তবু কিছুটা হলেও শান্তি। গতকাল রাতে নীরেনের শরীরটা একটু খারাপ হয়েছিল, সেই থেকে ভারী চিন্তায় ছিলেন, তবে এখন আর ভাবনার তেমন কিছু নেই। চা বানাতে রান্নাঘরের দিকে এগোচ্ছিলেন মৃণ্ময়ী, এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠল। কেমন জানি সন্দেহ হল মৃণ্ময়ীর, সদর খুলে দেখেন যা ভেবেছেন তাই। দরজার বাইরে অন্তত পনেরো-কুড়িটা খুদে, কারোর কারোর সঙ্গে আবার তাদের মা-বাবা-দিদিও আছে। গল্পদিদির কাছে গল্প শোনার আবদার নিয়ে তারা সবাই উপস্থিত। এদের ফেরাতে পারলেন না মৃণ্ময়ী, মুচকি হেসে ঘরের ভেতরে আসতে বললেন। নিজে হাতে চা জলখাবার বানিয়ে খেতেও দিলেন সবাইকে। তারপর বসল গল্পের আসর। কিন্তু, চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী থেকে আসর ঠিক জমছিল না। তাই, মৃণ্ময়ী সকলকে নিয়ে গিয়ে বসলেন গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে। কতদিন আগে কার চণ্ডীমণ্ডপ ছিল এটা কে জানে, তবে প্রতিবছর এখানে দুর্গাপুজো হয়। সেইদিন থেকেই আরম্ভ হল মৃণ্ময়ীদির গল্পের আসর। তারপর থেকে প্রতিটা ছুটির দিনেই গল্প শোনার জন্য সেখানে ভিড় করে কণ্ঠীতলা স্কুলের কচিকাচাদের দল। তবে, কিছুদিন যেতে না যেতেই আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করলেন মৃণ্ময়ী। কণ্ঠীতলা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা ছাড়াও গ্রামের অন্যান্য ছেলেমেয়েরা, যারা অন্য স্কুলে পড়ে বা যারা আপাতত স্কুলছুট তারাও এসে ভিড় জমাচ্ছে গল্পের আসরে, মন দিয়ে শুনছে পদ্মাবতীর আখ্যান, টম চাচার গল্প, সাগরদ্বীপের যকের ধন।
যত দিন যায় ভিড় বাড়তে থাকে গল্পের আসরে, বাচ্চাদের পাশাপাশি গ্রামের ছেলে-বুড়োরাও আজকাল আসরে আসতে আরম্ভ করেছে। পাড়ায় পাড়ায় তাসের আড্ডা কিংবা মেয়েলি আড্ডার থেকে এখন বেশি ভিড় হয় গল্পদিদির আসরেই। মনে মনে তৃপ্তি অনুভব করেন মৃণ্ময়ী, যন্ত্রসভ্যতা এখনও তাহলে মানুষের সুকোমল অনুভূতিগুলিকে পুরোপুরি নষ্ট করতে পারেনি, এটা ভেবে তাঁর খুব ভাল লাগে। দেখতে দেখতে দুর্গাপুজো এসে যায়। মৃণ্ময়ী ভেবেছিলেন পুজোর কয়েকটা দিন কলকাতায় কাটিয়ে আসবেন, কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না। ষষ্ঠীর সকাল থেকেই তাঁকে ঘিরে ধরল খুদেরা, তাদের ইচ্ছে আজ গল্পদিদি তাঁদের দুর্গাঠাকুরের গল্প শোনাক, বাধ্য হয়েই গ্রামে থেকে গেলেন মৃণ্ময়ী। পুজোর পাঁচটা দিনই ভারী আনন্দে কাটল সবার। দিনে পুজোর আয়োজন আর বিকেলের পর থেকে গল্পের আসর। গল্পের অভাব নেই মৃণ্ময়ীর ঝুলিতে, দেশ-বিদেশের ভূতের গল্প, পুরাণের গল্প, ঠাকুমার ঝুলি থেকে আরম্ভ করে কম্পিউটারের ইতিহাস, মুঘল আমল থেকে আরম্ভ করে দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুর খুঁটিনাটি বর্ণনাসহ গল্প পরিবেশন করতেন তিনি। পুজো যেমন এসেছিল তেমনভাবেই চলে গেল, তবু তার রেশ থেকে গেল পল্লীবাসীদের জীবনে। ঢাকের আওয়াজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল ঠাণ্ডা উত্তুরে বাতাসে। প্রকৃতি থেকে মানুষের জীবন, সর্বত্রই দেখা দিল বদল। শুধু বদলে গেল না গল্পদিদির আসর।
এখনও ছুটির দিনে চণ্ডীমণ্ডপ আলো করে বসে থাকে গ্রামের শিশুরা, জমে উঠতে থাকে গল্পের আসর। ভিডিও গেম বা যান্ত্রিক কোনও খেলাধুলার নেশা নয়, গল্প শোনার নেশায় তারা আসে গল্পদিদির কাছে, আর তাদের কাছে এসে পৌঁছোয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিচিত্র স্বাদের গল্প। কনকনে শীতের সকালই হোক, কিংবা গ্রীষ্মের দুপুর, গল্প শোনার বিরাম নেই। ছুটির দিন হলেই ছুটে আসে ছোটরা তুলসীপুকুর গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে, আর মৃদু মৃদু হাসিমাখা মুখ নিয়ে, মিষ্টি সুরে গল্প বলে চলেন তাদের সবার প্রিয় গল্পদিদি, মৃণ্ময়ী।
ভীষণ প্রাসঙ্গিক একটা লেখা। বেশ ভালো লাগলো পড়তে...
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।
মুছুনএকটি মন্তব্য পোস্ট করুন