যুদ্ধ নাকি শান্তি? – আকাশদীপ গড়গড়ী


 

 রুমির মনটা ভালো নেই। আজ তার ছোট্ট মেয়েটার খুব শরীর খারাপ। কয়েকদিন ধরে যা গরম পড়েছে চারদিকটা যেন আগুনের লেলিহান শিখায় তপ্ত হয়ে উঠেছে। আজ সকাল থেকেই বুঁচকি কিচ্ছুটি মুখে তোলেনি। রুমির এই একরত্তি বুঁচকি ছাড়া আর কেউ নেই। সকাল থেকে চারিদিক ঢিনচ্যাক গানে কান যেন ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। বাতাসে কেমন একটা পুজো পুজো গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। রুমির মনটা খারাপ হয়ে গেল। বুঁচকি মার পেটে মুখ গুঁজে শুয়েছিল। চোখ পিটপিট করে বলল, "মা, ভীষণ খিদে পেয়েছে।"

রুমি ছলছল চোখে বুঁচকির মাথায় লম্বা ঠোঁট ছুঁইয়ে চুমু খেয়ে বলল, "বাসায় তো কিছু নেই মা, তোর শরীরটা ভালো নেই বলে কাল আর খাবার জোগাড় করতে যাইনি। আজ তিন দিন পর ঠোঁট খুলল তোর। বল মা কী খাবি তুই? আমি এখুনই এনে দেবো।"

ঘোর লাগা গলায় বুঁচকি বলল,"মা, বোসেদের পুকুর এর কেঁচো এনে দেবে? খেতে বড় ইচ্ছে করছে।" রুমি পালক দিয়ে চোখ আড়াল করে বলল, "তুই একটু বিশ্রাম নে আমি এখুনই এনে দেবো।" বুঁচকি আবার বাসায় নেতিয়ে পড়ল।

—"আজ আমার দিন। আজ শালা পাপাইকে ভোঁক্কাটা করবই! মালটা সেদিন ছেলে নিয়ে এসে হুমকি দিয়ে গেছে! বলে নাকি পরশু ক্রিকেট ম্যাচটা ইচ্ছে করে হেরেছে। শালা কতগুলো গাধা নিয়ে কি ম্যাচ জেতা যায়? আমাকে চ্যালেঞ্জ? দেখাচ্ছি মজা! প্লুটোকে হারানো অত সোজা নয় বস্। নে নে জলদি ঘুড়িটা তুলে দিয়ে লাটাইটা ধর! আমি বাড়ছি!"

বড় বড় চোখে প্লুটোর কথা শুনছিল নুপুর। তার দাদা পাড়ার সেরা খেলোয়াড়। ক্রিকেট, ফুটবল, ঘুড়ি সবেতেই পারদর্শী প্লুটো। পাপাইরাও অনেক ভালো খেলোয়াড়, কিন্তু প্লুটোকে হারানো তাদের সাধ্যের বাইরে। নিজেদের মান রাখতে তাই ওরা কাল হুমকি দিয়ে গেছে, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন দম থাকে তো ওদের একটা ঘুড়ি কেটে দেখাক, নাহলে প্লুটোর কপালে দুঃখ আছে!

মনে মনে একটু ঘাবড়ে গেলেও প্লুটো তেতে উঠল। ছোটো বোনের সামনে তাকে চ্যালেঞ্জ করে শাসানো? আজ এই ইজ্জত তাকে রাখতেই হবে।

—"কীরে কোথায় হারিয়ে গেলি? ঘুড়িটা তুলে দে নুপুর!" প্লুটোর ডাকে সম্বিৎ ফিরল নুপুরের। দূরে গিয়ে ঘুড়িটা এক লাফে ছুঁড়ে দিল আকাশে। প্লুটোর কয়েকটা নিপুণ হাতের টানে জোকারের মুখ আঁকা ভুয়াদর ঘুড়িটা আকাশে রঙিন কাগজি মেলায় সাম্রাজ্য জয়ে গা ভাসিয়ে দিল।

বুঁচকির জন্য গোটা দশেক কেঁচো একটা গাছের পাতায় মুড়ে ঠোঁটে করে নিয়ে আকাশপথ ধরল রুমি। সে নিজেও দুদিন ধরে অভুক্ত। পরশু বুঁচকিকে একা রেখে খাবার খুঁজতে গেছিল সে। আর সেটাই তার জীবনের সবথেকে বড় ভুল। এই ফাঁকে সুযোগ বুঝে কোথা থেকে একটা লিকলিকে সাপ এসে কামড়ে ধরেছিল বুঁচকির পা। বেচারা যন্ত্রণায় ছটফট করছিল! ভাগ্য ভালো, ঠিক ওইসময় বাসায় উড়ে আসে রুমি। বেগতিক দেখে আর কালবিলম্ব না করে সজোরে তীক্ষ্ণ ঠোঁটের এক মারণ কামড়ে মাটিতে আছড়ে ফেলল সাপটাকে! তারপর উড়ে উড়ে বারবার ঠোক্কর মেরে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে থাকে লিকলিকে সরীসৃপের দেহটা! ততক্ষণাৎ মারা যায় সাপটা! বুঁচকি প্রাণে বেঁচে গেলেও ধীরে ধীরে খুব নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে। আজ প্রায় তিন দিন পর সে ঠোঁট খুলেছে। মনটা আবার শিউরে উঠল রুমির! সর্বনাশ! বুঁচকির খাবারের আকুতিতে ভুলে সে আজও অসুস্থ ছোট্ট মেয়েটাকে বাসায় একা ছেড়ে এসেছে! আজও যদি কোনো শয়তান তার বুঁচকির কোনো ক্ষতি করতে আসে?...

আর ভাবতে পারল না রুমি। চোখদুটো ধক্ করে জ্বলে উঠল ওর! তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতেই হবে।

গোটা আকাশটা বিশ্বকর্মা পুজোর আতর মেখে রঙিন কাগজে ছেয়ে গেছে। ঠোঁটে খাবার নিয়ে ঘুড়ির ফোয়ারায় পাশ কাটাতে কাটাতে যত দ্রুত সম্ভব বাসামুখি হল রুমি।

হঠাৎ পথরোধ হল! আরে কী...ডানায় আবার এসব কী জড়িয়ে গেল!

একবার জ্বলন্ত চোখে পাপাইদের পেটকাটা ঘুড়িটাকে মেপে নিল প্লুটো। সমস্ত আকাশে আজ ওর ঘুড়িটাই যেন একা সম্রাট আলেকজান্ডারের মতো অপ্রতিরোধ্য। ক্রমাগত যুদ্ধজয়ের মতো একে একে পনেরোটা ঘুড়িসৈন্যকে সে আজ মারণফাঁদে আটকে নিয়েছে। শুধু বাগে আনতে পারছে না পাপাইদের ঘুড়িটাকে। ব্যাটাচ্ছেলে যেন রাজা পুরু। সমানে যুঝে চলেছে ওর জোকারমুখো আলেকজান্ডার-মানে বিজয়ী ভুয়াদর ঘুড়িটার সাথে। ধীরে ধীরে প্লুটোর মাথায় আগুন তেতে উঠছে। প্রাণপণ চেষ্টায় দাঁত কিড়মিড় করে নুপুরকে বলে উঠল, "ওরে আরও সুতো ছাড়। তল্লাটের সেরা মাঞ্জা লাগিয়েছি। দেখি কেমন করে ওরা আমার ঘুড়ি কাটে! আরও সুতো ওওও..." নুপুরও দাদার কান্ড দেখে উত্তেজিত! লাটাইতে সুতোর বন্যা বইয়ে দিল ও। দুটো ঘুড়ি তখন মধ্যগগনে। লড়াই তুঙ্গে! পাশের ছাদ থেকে পাপাইদের উল্লাস প্লুটোর মাথা খারাপ করে দিল। সেও দাঁতে দাঁত চেপে প্যাঁচ লাগিয়ে দিল।

তখনই অঘটনটা ঘটল! প্লুটো একবার মাত্র মুখ ফিরিয়েছিল পাপাইদের টিটকিরি কাটতে। হঠাৎ কী একটা উড়ে এসে ওর ভুয়াদর ঘুড়িতে সজোরে ধাক্কা খেল! কিছু বুঝে ওঠার আগেই শক্তিশালী মাঞ্জা তার পরাজয় স্বীকার করল। ঘুড়িটা মাঝখান দিয়ে ছিঁড়ে গিয়ে আকাশে বোকার মতো কয়েকবার ফড়ফড় করে উড়ে নীচে পড়ে গেল!

একটা দোমড়ানো মাংসপিন্ড আছাড় খেল প্লুটোর পায়ের কাছে! এই আকস্মিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সে যে চ্যালেঞ্জ হেরে গেছে, পাপাইদের পেটকাটা পুরু যে তার ভুয়াদর আলেকজান্ডারকে হারিয়ে দিয়েছে, এই কথাটাই যেন প্লুটোর বিশ্বাস হচ্ছিল না! নুপুর ককিঁয়ে উঠল ব্যাথায়," তুই কী করলি দাদা! পায়রাটা যে শেষ হয়ে গেল! কাঁচের ব্লেডের মতো মাঞ্জা যে ওর ডানা কেটে দিল!" কান্নায় ভেঙে পড়ল নুপুর।

হতভম্ব প্লুটো মাথা তুলে একবার রঙ্গিন আকাশটার দিকে তাকালো। পাপাইদের বিজয়ী পেটকাটা পুরু তখন যুদ্ধজয়ের আনন্দে আকাশে ডানা মেলে ফড়ফড় করে উড়ছে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল ওর। প্লুটো নীচু হয়ে রক্তাক্ত পালকবিহীন সুতোয় জড়ানো গরম দেহটা দু'হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। শান্তির প্রতীক এই সাদা পাখিটার ধবধবে ছোট্ট শরীরটার থেকে গড়িয়ে নামা রক্তের ধারায় ওর দুটো হাতের তালু ভিজে যাচ্ছে। প্লুটো ছলছলে চোখে দেখল, পায়রাটার ঠোঁটে তখনও শক্ত করে আটকে আছে কেঁচো ভর্তি একটা বড় আকন্দ পাতা।

বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল প্লুটোর! ঝাপসা চোখে এক আছাড় মারল হাতের লাটাইটাকে! দাদার কান্ড দেখে ভয়ে আঁতকে উঠে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল নুপুর! কাঠের লাটাইটা বিকট শব্দে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল ছাদময়! পাড়ার প্যান্ডেল থেকে তখনও ভেসে আসছে হিন্দি গানের সুর। পশ্চিম আকাশটা ছেয়ে গেছে কালো মেঘে। ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করল হঠাৎ! প্যান্ডেলের গান ছাপিয়ে দূর থেকে ভেসে এল পাপাইদের তীব্র চিৎকার, "ভোঁকাট্টা... ভোঁকাট্টা...ভোঁ ওওওওও...!"

1 মন্তব্যসমূহ

  1. অসাধারণ বললেও কম বলা হবে...প্রাসঙ্গিক একটা পরিবেশের বার্তা দেওয়া...প্রচ্ছন্ন গল্পের আড়ালে...তার উপর সরাসরি পরিবেশের জন্য একটা বার্তা তাও সুন্দর দুটো অনুভূতির গল্পের মালা গেঁথে।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন