মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে নিত্যদাসের। মোহন্ত ফিরে যাবেন বৃন্দাবন। " তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে বাবা! প্রভুসেবার কি হবে? তুমি ছাড়া আমরা যে বড়ো অসহায়।"
নিত্যদাসের গলা ধরে আসে। চিন্তা ভারে নুইয়ে আসে মাথা। এইবার কে নেবে আশ্রমের ভার। ভাবনায় আকুল নিত্যদাস।
— "আমি নিজে পুজো অর্চনা কিছুই জানি না বাবা। তুমি চলে গেলে..."
দুর্ভাবনায় মুখের কথা অসমাপ্ত থেকে যায়।
নিত্যদাসের ভাবনা অমূলক নয়। সে কথা বোঝেন মোহন্ত। তবে নিরুপায় তিনি। অন্তরের টানে সাড়া দিতেই হয় এইবার। ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন করে মোহন্ত ফিরে যাবেন বৃন্দাবন।
– "অতো ভেবো না নিত্যদাস। তোমার আমার সাধ্য কতটুকু! এ জগৎ সংসার সবই তাঁর ইচ্ছেয় সচল। চিন্তা করো না। সেই ভার চিন্তামণির। নিজের ব্যবস্থা প্রভু নিজেই করে নেবেন, দেখো।", নিত্যদাসকে বলেন মোহন্ত।
নিত্যদাস বসে থাকে। মোহন্তের আশ্বাসে মন ভরে না। দুই চোখ জলে ভাসে।
- "ত্রুটি তো কিছু রাখিনি বাবা। তারপরেও চলে যাবে তুমি!"
বড়ো ভালো মানুষ নিত্যদাস। এত বছর ধরে দেখছেন মোহন্ত। প্রভুর নামে পাগল। পরম ভক্ত। দুইবেলা নিয়ম করে আশ্রমে আসে।
"সিদ্ধান্ত বদলানো যায় না বাবা? তোমাকে কিছুতেই ছাড়বো না আমি। কিছুতেই না। কিছুতেই না।", কাতর অনুনয় নিত্যদাসের।
মোহন্ত ভাবেন, মানুষ চাইলে কি মানুষকে ধরে রাখতে পারে? সে কি অত সহজ! জগতে কোন কাজ মানুষের ইচ্ছে মতন হয়? মোহন্ত নিজে ঘর ছেড়েছেন এক ভেবে। হয়েছে আর এক। এক সংসার ছেড়ে অন্য সংসারে আটকা পড়েছেন! এক ঘাটের তরী বাঁধা পড়েছে অন্য ঘাটে। পালে হওয়া নিয়ে ভাব সাগরে ভেসে যাওয়া আর হলো কই! আজ কত বছর ধরে ভেবে এসেছেন মোহন্ত ফিরে যাবেন বৃন্দাবন। চৈতন্য নামে বুঁদ হয়ে পার করবেন জীবন। গুরুদেবের আদেশ হয়নি এতদিনেও। মোহন্ত মাঝে মধ্যেই পত্র লিখেছেন গুরুদেবকে।
- "সময় কি হয়নি বাবা? ফিরিয়ে নাও এইবার।"
"মানুষের মাঝেই মুক্তি। প্রভু বুঝিয়ে দেবেন সব।" প্রতিবারই এই কয়খানি শব্দ লেখা চিঠি এসেছে মোহন্তের হাতে। মানুষের মাঝে মুক্তি! এ কেমন কথা গুরুদেব? নির্জনে বসে চোখের জল ফেলেছেন মোহন্ত, "সংসার বন্ধন ছিন্ন করে পথে নেমেছি। আবারও শিকলে বেঁধে রেখেছো আমায়! এও তো এক সংসার। তবে কি মুক্তি নেই আমার? এ কেমন মায়া – ফাঁদ!" দিনের পর দিন মনে মনে আকুল হয়েছেন মোহন্ত। একান্তে ভেবেছেন, "মানুষের মাঝে মুক্তি।" গুরুদেবের সে কথার তল পাওয়া হয়ে ওঠেনি।
কয়দিন থেকেই মোহন্ত যেন ভাবে আচ্ছন্ন। ঘুম আসে না রাতে। মন্দিরের চাতালে একলা এসে বসেন। অনন্ত প্রকৃতি রাতের আঁধারে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। মাঠের বাতাস ছুঁয়ে যায় মোহন্তকে। ডুকরে ওঠে বুক। শরীরে কম্পন। মন হু হু করে কোন অজানা কারণে। দামাল কান্না বুক ফুঁড়ে বাইরে আসে। কেঁপে ওঠে নিঝুম প্রকৃতি। নিঃশব্দতা ভেঙে খান খান। বটগাছের কোটরের ঘুমন্ত পাখি সব জেগে ওঠে। কান পেতে শোনে মোহন্তের কান্না। এক অন্য সুরের ক্রন্দন। বহু দূরে কেঁদে ওঠে শিয়ালের দল। চঞ্চল হয়ে ওঠে নিশি সংসার। মোহন্তের আকুলতা টের পায় জীবকুল। এইভাবেই রাত ফুরায় রোজ। দিন দুপুরেও একই অবস্থা। মহাপ্রভুর পুজোর মন্ত্র উচ্চারণের সময় কেঁদে আকুল হন মোহন্ত।
পশু পাখি দেখে জল আসে চোখে। তবে কি জাগতিক মায়ায় বদ্ধ হয়েছেন? মাঝে মধ্যেই কানে ভেসে আসে গুরুদেবের কণ্ঠস্বর। "আরো, আরো প্রেম দাও জীবে। চৈতন্য প্রেমেই হবে মুক্তি।"
নিজের মনের এমনতর অবস্থার কথা গুরুদেবকে জানিয়ে চিঠি লিখেছেন মোহন্ত। উত্তরও পেয়েছেন। "নিরন্তর ভালোবাসায় অন্তরে অনন্ত প্রেমের প্রকাশ। জ্ঞানচক্ষু উন্মেলিত। হৃদয়ে প্রেমময় চৈতন্যের আবির্ভাব। ঘর – বাহির বিচার যায় ঘুচে। সময় এসেছে এইবার। জীবে শিব দর্শন। সর্বভূতে চৈতন্য উপলব্ধি। সাধনার বহু কাঙ্ক্ষিত স্তর। সবই প্রভুর কৃপা। মাভৈঃ, এগিয়ে চলো। আরো সাধন করো।"
"এগিয়ে চলো! আনন্দ, আনন্দ। সাধন চাই আরো।" এইবার চলো বৃন্দাবন। গুরু সন্নিকটে থেকে সাধন ভজন। হৃদপদ্মে প্রভুর উপস্থিতির উপলব্ধি। সামনেই ফাল্গুনী পূর্ণিমা। প্রভুর জন্মদিন। পূণ্যতিথি। সেই দিন ফিরে যাবেন বৃন্দাবন। সংসার ভার সরিয়ে মহৎ জীবনে উত্তরণ।
– "বাবা। যেতেই হবে?", আবারও জিজ্ঞাসা করে নিত্যদাস।
- "অনেক দিন হলো নিত্যদাস। এইবার আমাকে ছেড়ে দাও। তোমাদের সঙ্গ লাভে ধন্য আমি। প্রভুর অনুমতি আমি পেয়েছি। আগামী কাল দোলপূর্ণিমা। পরশু ভোর রাতে রওনা দেবো।"
দেখতে দেখতে তিরিশ বছর বছর পার হয়ে গেলো এই আশ্রমে। কোন কালে এসেছিলেন এখানে। সে সব কথা শরৎ-শিশিরসিক্ত ঘন সবুজ দুর্ব্বার মতোই সতেজ আজও।
সে দিন ফাগুনের দ্বিপ্রহর। মাজদিয়া স্টেশনে বসে মোহন্ত। দিশাহীন। কোথায় যাবেন জানেন না কিছুই। বৃন্দাবন থেকে শিয়ালদহ হয়ে সোজা নদিয়া। নদিয়ার মাটি চৈতন্যময়। বাতাসে পবিত্র হরিমন্ত্র। এইটুকু মাত্র জ্ঞান সম্বল করে এসেছেন এখানে। গুরুদেবের কথায় রেখেছেন অটল বিশ্বাস, "মহাপ্রভু নিজেই ডেকে নেবেন। অন্তরে আকুতি থাকলেই হলো।"
মজদিয়া স্টেশনে দেখা হয় নিত্যদাসের পিতৃদেব বৈদুর্যদাসের সঙ্গে। নিত্যদাস তখন দশ বারো বছরের কিশোর।
"আমাদের আশ্রমের ভার নাও বাবা। যুগযুগ ধরে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বিরাজমান সেথায়।"
গুরু বাক্য মিথ্যা নয়। মোহন্তের মনে বাঁধভাঙা আনন্দের প্লাবন। প্রভু ডেকে নিলেন সেবার অধিকার দিয়ে! বৈদুর্যদাস ধরে নিয়ে আসেন মোহন্তকে। অর্পণ করেন আশ্রমের দায় ভার। সেই দিন থেকে নিবিষ্ট চিত্তে চৈতন্য নামে ডুব দিয়েছেন মোহন্ত। সকাল দুপুর সন্ধ্যা, দিন চৈতন্যময়। এভাবেই গেলো কত গুলি বছর।
সত্যি জীবন বড়ো অদ্ভুত! মানুষের ইচ্ছে অনিচ্ছার মূল্য কোথায়! মানুষ ঈশ্বরের হাতের পুতুল বৈ অন্য কিছু নয়। জগৎ মেলায় প্রভু নাচিয়ে চলেছেন আপন মর্জি মতন। নিজের জীবন ভেবেই কতবার বিস্মিত হয়েছেন মোহন্ত। সংসারের মোহ ছিন্ন করে নেমে ছিলেন পথে। সে দিনের যুবক মোহন্ত। বনেদি পরিবারের সন্তান। পরিবার ক্ষয়িষ্ণু প্রায়। জ্ঞাতি কলহ। সম্পত্তি। বিবাদ। মামলা মোকদ্দমা। সংসারে বীতরাগ মোহন্ত। মনে বৈরাগ্য তীব্র। ছেলেবেলা থেকেই ঈশ্বর অনুরাগ প্রবল। ঘরে নিত্যদিনের কলহ। জীবন বিষময়। জীবন কি তবে এমনই? শান্তি চাই। খোলা বাতাসে শ্বাস। এই জীবনে বুঝি অধরা সেই সব।
নিরালায় আত্মজগতে অন্য সুর বাজে মাঝে মধ্যে। কে যেনো আশার বাণী শোনায় বহু বহু দূর থেকে। অস্ফুট সেই উচ্চারণ। শ্রুতির অগোচরেই রয়ে যায়। কে দিতে চায় স্বন্তনাবারি চাতক-পিপাসু মনকে! ততদিনে মোহন্ত পড়েছেন মহাপ্রভুর কথা। অপার্থিব জীবনের অনিন্দ্য সুন্দর ছবি ভেসে আসে মনে। ভ্রমের পৃথিবীর বন্ধন কেটে বের হবার পথও আছে। মনে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচাল। তেমন পথ কি সত্যিই আছে?
নিশ্চয় আছে। তবে সাধন ভজন প্রয়োজন। গুরু ছাড়া অসম্ভব সেই পথে অগ্রসর হওয়া। গুরু চাই। গুরু। জ্ঞানালোকের সন্ধান দেবেন তিনিই। অতএব গুরু অন্বেষণ। গৃহত্যাগ গভীর রাতে। সেদিন ফাল্গুনী পূর্ণিমা। পথ চলে মোহন্ত। একলা। মনের কন্দরে একটি প্রশ্নের ঘোরাফেরা, "কোথায় পাবো তারে?"
গন্তব্য বৃন্দাবন। চৈতন্য – চরণ স্পর্শে পবিত্র সেই ভূমি। বৃন্দাবন আসেন যুবক মোহন্ত। গুরু কৃপায় দেখা মেলে গুরুদেব শ্রীসর্বজ্ঞানানন্দের। মোহন্তের আকুতি শোনেন তিনি।
- "মন শীতল করো বৎস্য। হঠকারিতা ঈশ্বরের পথ নয়। শোনো, এই বিশ্বে সব কিছুতেই প্রভুর প্রেমের প্রকাশ। অনুভূতির জন্য হৃদয় চাই। দেখার জন্য চোখ। চর্ম চোখে সে প্রেম-প্রকাশ অদৃশ্যমান। ভাবাবেশে ভালোবেসে চলো। বিলাও প্রেম অকাতরে। হৃদপদ্মে চৈতন্য আবির্ভাব টের পাবে। অজান্তেই উন্মীলিত হবে প্রেমচক্ষু। সেই দিন মনে হবে সংসার চৈতন্যময়। নয়তো সবই মায়া আর মোহ। সে কথা অন্তরে অনুভবের জন্য পাহাড়ে গুহায় সাধনা নিষ্প্রয়োজন। মানুষের মাঝে থেকেই চৈতন্য – স্বরূপ বোঝা সম্ভব। পথে নামো। পাহাড় প্রমাণ বিশ্বাস রাখো গুরু বাক্যে। সাধনার আর অন্য পথ নেই।"
গুরু উপদেশ শিরোধার্য। এইবার গন্তব্য নদিয়া। তারপরেই তো দেখা মেলে বৈদুর্যদাসের। এক লহমায় কত কথা ভিড় করে আসে মনে।
– "আমি শহর থেকে ফিরে আসি বাবা।"
চোখের জল মুছে উঠে যায় নিত্যদাস। রাত পোহালেই দোল পূর্ণিমা। প্রভুর পুজোর উপাচার প্রয়োজন। নিত্যসেবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন মোহন্ত। এরই মাঝে আশ্রমে এসে মোহন্তের সঙ্গে দেখা করে গেছেন বৃদ্ধ বৈদুর্যদাস। আশ্রমের কথা ভেবে তিনিও বিপন্ন। সকাতর অনুরোধ, "যেও না বাবা। তুমি ছাড়া..."
আজ দোল পূর্ণিমা। গতকাল শহর থেকে ফুল মালা কিনে নিয়ে এসেছে নিত্যদাস।
গোলাপ শোভিত রজনীগন্ধার মালা। কপালে শ্বেতচন্দন তিলক। শ্বেতশুভ্র বসন। আহা কি রূপ প্রভুর! আনন্দ অশ্রু আসে চোখে। দুপুরে পঞ্চব্যঞ্জনে ভোগ হয়েছে। সঙ্গে লাউয়ের পায়েস। প্রভুর পছন্দের ভোগ। সন্ধ্যা বেলায় সুজির হালুয়া আর লুচি। রোজদিন তিনবেলা প্রভুর ভোগ নিজে নিবেদন করেন মোহন্ত। টুকিটাকি কাজ সারাদিন লেগেই আছে আজ। অন্য দিন দুপুরে সামান্য বিশ্রামের সুযোগ হয়। আজ আর ফুরসৎ মেলেনি তার।
সন্ধ্যা নামলো বলে। পিতলের থালায় খই বাতাসা নিয়ে আশ্রমের পূর্ব দিকে দাঁড়িয়ে মোহন্ত। উদাত্ত গলায় ডাকেন, "আয়,আয়, আয়।"
রোজ সকাল – সন্ধ্যা এ জগতের সবার আমন্ত্রণ থাকে মোহন্তের সংসারে। দিনান্তের ঘরে ফেরা পাখির দল সাড়া দেয় মোহন্তের, "আয় আয় আয়" ডাকে। সামনের বট গাছ থেকে পাখি, কাঠবেড়ালির দল নেমে আসে মহা কলরবে। ভিড় জমায় মন্দির চাতালে। খই বাতাসা খুঁটে খায় সবাই। একপাশে দাঁড়িয়ে রাখাল আর বাগাল। মোহন্তের দুই প্রিয় পোষ্য কুকুর। ওদের লক্ষ্য করে খই বাতাসা ছড়িয়ে দেয় মোহন্ত। মন্দির প্রাঙ্গণে আনন্দমেলা! সে এক অপার্থিব দৃশ্য। ইদানিং সে দৃশ্য দেখে চোখে জল আসে মোহন্তের। প্রভুর লীলা!
ভোগ আরতি পর্ব মিটেছে। অন্য দিন রাতের বেলায় বাড়ি ফিরে যায় নিত্যদাস। আজ রয়ে গেছে আশ্রমে। ভোর রাতে রওনা দেবেন মোহন্ত। বিমর্ষ নিত্যদাস।
রাত গভীর। টলটলে চাঁদ আকাশে। জোৎস্নায় বানভাসি প্রকৃতি। বট গাছের ডাল পালার ফোকর গলে চুঁইয়ে পড়ে চন্দ্রালোক। কনকবরণ মায়াবী আলোক মালায় সজ্জিত মন্দির। দুই হাত জোড় করে বসে মোহন্ত। মুদিত নয়ান।
"বাবা।", ডাকে নিত্যদাস। চোখ মেলে মোহন্ত, "বলো নিত্যদাস।"
– "কাল সকাল থেকে প্রভুর সেবার কি হবে? আমি যে মন্ত্র জানিনা বাবা।"
চুপ করে বসে মোহন্ত। দৃষ্টি মহাপ্রভুর চরণে। "চিন্তা করো না নিত্যদাস। ভরসা রাখো প্রভুর উপর।", মোহন্তের আশ্বাস। ভোর হয়ে এসেছে। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেন মহাপ্রভুকে। আশ্রমের ধূলি মাথায় ছোঁয়ায় মোহন্ত। "এইবার আসি।", বিদায় নিচ্ছেন মোহন্ত। "কি আর বলি বাবা। সাবধানে এসো।" , কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে নিত্যদাস।
নির্জন পথে এগিয়ে চলেন মোহন্ত। এতো ভোরে এই অঞ্চলে গাড়ি ঘোড়া মেলে না। হেঁটেই যেতে হবে স্টেশন। কতো আর পথ! মহাপ্রভুর নাম নিয়ে পা ফেলেন সামনে। ভোরের প্রকৃতি শান্ত। হঠাৎ করে ব্যস্ত – পদশব্দ কানে আসে। মুখ ফেরায় মোহন্ত। রাখাল আর বাগাল হাজির। মোহন্তের পায়ের কাছে এসে গড়াগড়ি খায়। হাজার চেষ্টায় কুকুর দুটিকে আশ্রমে ফেরাতে ব্যর্থ হন মোহন্ত। মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করেন, "হরি বোল হরি বোল হরি বোল। আহা প্রভুর জীব। যাও, ফিরে যাও তোমরা। কথা শোনো।"
রাখাল বাগালের চেহারা আজ অন্য রকম। আদরে বশ মানতে নারাজ। মোহন্তের পথ আগলে দাঁড়িয়ে। রাখাল বাগালের আটকানো পথ মুক্ত করে সামনে পা ফেলতে চায় মোহন্ত। ব্যর্থ হয়। কার ইশারায় স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন যেনো। বুকের মধ্যে কান্নার বুদবুদ ভেসে ওঠে। সঙ্গে ভীষন কম্পন। জগৎ সংসার যেনো স্বর্ণ বলয় হয়ে ভেসে যায়। অন্তরে ধ্বনিত হয়, "মোহন্ত, তুমি পরম বৈষ্ণব। সর্বভূতে চৈতন্য বিরাজমান। দেখো চেয়ে।"
মুহূর্তে ভ্রম ভাঙে মোহন্তের। সর্বভূতে ঈশ্বর। প্রভু সর্বত্র বিরাজমান। এই বোধ অনুভূতির আসে পাশেই ছিল এতদিন। মুক্তি চেয়ে মুক্তি – মোহেই আচ্ছন্ন থেকে উপলব্ধি করা হয়ে ওঠেনি মোহন্তের। জীবনে বেশ কিছু উপলব্ধি হঠাৎ ধরা দেয় মননে। মনের অবচেতনের কোঠরে ঘুমন্ত "সত্য" আচম্বিতে স্থায়ী – স্থিতি পায় চেতনে। মোহ – আচ্ছন্ন মন সেই ভাবের কথা খেয়াল রাখে না। এ বুঝি পাগলের পরশপাথর অন্বেষণ। অলক্ষ্যে থেকে কে যেন স্মরণ করিয়ে দেয়, ওই তো তোমার মধ্যেই রয়েছে তোমার কাঙ্ক্ষিত বস্তু। আঁধার থেকে আলোয় ফেরে মন। জ্ঞানালোকের উদ্ভাস জীবনে। সর্বত্র চৈতন্য দর্শন।
সেই উপলব্ধির আলোকপ্রভা প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে মোহন্তের চিদাকাশে। পরম পাওয়ায় তৃপ্ত জীবন। আনন্দাশ্রু নয়নে। মোহন্ত নিশ্চল। ভালোবেসে গায়ে এসে পড়ে রাখাল আর বাগাল। তর সয় না ওদের, চলো ফিরে এইবার। চোখ খোলেন মোহন্ত। জীবেই শিব। প্রেমে মুক্তি। জীব দুটিকে বুকে জরিয়ে ধরেন মোহন্ত। হা কৃষ্ণ। হা কৃষ্ণ। ক্ষমা করো প্রভু বুঝতে পারিনি তোমার ইঙ্গিত। এতো ভালোবাসা সংসার ছাড়া আর কোথায়!
পুব আকাশে লালচে আলোর উদয়। দিগন্ত রেখায় উঁকি দেয় নবারুণ। নব আনন্দে উদ্ভাসিত ধরিত্রী। বহুদূর থেকে গুরদেবের চরণে প্রণাম উৎসর্গ করেন মোহন্ত।
"ওঁ অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মিলিত যেন তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ।"
কাঁধের ঝোলা ছুঁড়ে ফেলে দেন মোহন্ত। প্রয়োজন ফুরিয়েছে ঝোলা কাঁধে পথে নামার। আগে পিছে হেঁটে চলে রাখাল আর বাগাল। আশ্রমের দিকে এগিয়ে চলেন মোহন্ত। শান্ত প্রকৃতির নিথর বাতাস কেটে ভেসে আসে নিত্যদাসের কণ্ঠস্বর,"আয়,আয়, আয়।" আজ মোহন্তের সংসারে মোহন্তের আমন্ত্রণ।
সে আর আসিবে না ফিরে।।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন