খোঁজ – চিত্রাভানু সেনগুপ্ত

  

নদী আমাগো লগে কথা কয় গো বাবুরা। হে জননী হয়ে ডাক পাড়ে, তবে তো বাঁচি আমরা। দশ বারো বচ্ছর বয়স থেকে এই নদীর বুকি মাছ ধরি, কাঁকড়া ধরি, কহনো জঙ্গলে যাই কাঠ জোগাড়ে, কহনো গহীন জঙ্গলের ভিতরে মধু আনতি যায়ে বেড়াই। এই দ্যাখতে দ্যাখতে পঁচিশটা বচ্ছর কাটায় দেলাম। কহন ভালো মাছ পড়বে পানির দিকে চেয়ে আন্দাজ করি। বারোডা মাইস জলে কাঁন্দায়, বাদাবন ঠেইলে বিপদ ঝুঁকি বুকি বেঁইন্দে নদীর বুকে টলার ভাসাই। ঘরে বুড়ো বাপটা আছে, বাঘের হামলায় পঙ্গু হইসে কত্তকাল আগে। মায়ে কাঁন্দে, কচি বউ, ছোট ছাওয়াল কান্না করে। হ্যাগো রেখে বনে আইতে কী মনে চায়? তবু আইতে হয়। অভাব, বড় অভাব! বনবিবি মায়ের থানে মাথা ঠেকাই, আর আল্লাতালার মর্জির দোহাই দি। প্যাটে টান পড়লি কোন ভয়ই আর ভয় লাগে না গো! ...

এতো কথা একনাগাড়ে বলে থামলো নিজাম। পরনের লুঙ্গির উপর জড়ানো গামছাটা টেনে তুলে চোখ মুছতে মুছতে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমাদের ট্রলার তখন দোবাঁকি নদীর উত্তাল স্রোতের বিপরীতে ঠেলে এগোতে চায়। ঢেউয়ের ধাক্কায় দুলে উঠছে যান। সন্ধ্যে নামছে আকাশ বেয়ে। পশ্চিমের দিগন্তে সূর্যগলা লাল রঙের বুকে তখন কালো আলকাতরা গলে পড়েছে। ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেবে সর্ব আকাশ। এখনো দিনের আলো আছে কিছুটা, অন্ধকার হওয়ার আগে লোকালয়ে পৌঁছতে হবে। দিনভর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও লাশখানা পাওয়া গেল না। গ্রামের লোকজনকে কী জবাবদিহি করব বুঝে উঠতে পারছি না। দূরে নদীপথের যতটা দেখা যায়, তার গায়ে লেগে থাকা সুন্দরী জঙ্গলের রেখাটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আর একটু এগোতে পারলে গন্তব্যমুখী জেগে উঠবে আর এক চর। দূরের বন মিলিয়ে যেতে যেতে মনের মধ্যে আরো হাজার চিন্তা জমে উঠছে। নিজামুউদ্দিনের গোঙানিতে আবার সজাগ হলাম।

ভাই রেএএ!


আমি ইদ্রিস হামিদ খান, একটি প্রখ্যাত দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় অস্থায়ী পদে সাংবাদিকতা করি। আমার কাজ নতুন খবর আনা। দেশের বিভিন্ন কোণে অজানা নানান তথ্য, মানুষের অজানা জীবনযাত্রাকে খুঁজে বের করা। একটু অন্যরকম রোমাঞ্চকর, একটু সুড়সুড়ি দেওয়া অথবা গায়ে কাঁটা দেবে এমন সব খবর আনতে পারলেই পাঠকের মনে নতুন কৌতূহল চাগাড় দেবে। যে যার মুনাফা গোনে আর কী! সেই উদ্দেশ্যে এসেছিলাম এই বঙ্গোপসাগর উপকূলের নোনা জল আর ম্যানগ্রোভের জঙ্গল সুন্দরবনে। এসেছিলাম এখানকার জনজাতির নানান সুখদুঃখ ভাগ করে নিতে। বের হয়ে বুঝেছি সবার তাগিদই ওই এক, পেটের টান।

এতো কথার ফাঁকে আসল ঘটনা একটু বলি। গেল সোমবারে কুলতলীর দেউলবাড়ি নাইয়েপাড়া থেকে সাতজনের একদল মাঝি মাছ কাঁকড়া ধরতে রওনা হয়েছিল সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘদিন বন্ধের পর রায়দীঘি রেঞ্জ কার্যালয় থেকে খুব কম দিনের অনুমতিপত্র পেয়েছিল। তিনদিনের সফর শেষে ঘরে ফেরার মুখে নিখোঁজ হয় একজন যুবক। বয়স বছর ছাব্বিশ। সে কোথায় গেল, কিভাবে হারালো কেউ সঠিক খোঁজ দিতে পারেনি। গতকাল ট্রলার নিয়ে তারা বাড়ি ফেরে, বিট অফিসে খবর দেয়। আজ ভোরবেলার দিকে বনদপ্তরের কর্মী, আর দলের 'জন মাঝিদের সাথে আমিও গিয়েছিলাম সেখানে খুঁজতে, কিন্তু কেউ সঠিক কিছু বলতে না পারায় তেমন লাভ কিছু হয়নি। যদিও জবাবদিহি আমার কাজ নয়, তবু পরিবারের মানুষজনের অসহায় মুখ দেখলে মন কী স্থির থাকে? আজ সকাল দশটা নাগাদ পৌঁছে গিয়েছিলাম সেইখানে যেখানে খোয়া গিয়েছে নিজামুউদ্দিনের ছোট ভাই আফতাব।


মাঝিদের কথা মত আমরা আমাদের ট্রলারটি নোঙর করি পীরখালি খালের ডান দিকে। ভাঁটির টানে নদীর দুপারে তখন চর জেগে উঠেছে। শুনেছি নদীর এককুল যখন ভাঙে তখন অপর কুল তৈরি হয়। চরে নামতেই একহাঁটু করে কাদা। বনের কিছু গাছ উঁচু ডাঙা ফেলে জলে হুমড়ি খেয়ে আছে। আসলে এই গাছ জঙ্গল ভেঙে নদীগর্ভে তলিয়ে যাবে দেখতে দেখতে। নদীর বুকে অলিখিত কত নিয়ম। চোখে দেখে অনেকেই, বোঝে কেবল তারা যাদের জীবন জীবিকা এই নদীর কোলেই জড়ানো। পাড়ে নেমেই ফরেস্টর ভাইদের নেতৃত্বে আমরা ভেতরে এগিয়ে গেলাম। শুরু হল খোঁজ। ঠিক যেখানে গতকাল মাঝিভাইরা খোঁজা শেষ করেছিল, আমাদের খোঁজ শুরু হল তারপরের জঙ্গলের অংশ থেকে কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে আফতাবের কোন চিহ্ন, টেনে নিয়ে যাবার দাগ, রক্ত, ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিচ্ছু পাওয়া গেল না। আমরা স্বভাবতই বেশ অবাক! একবেলা প্রায় কাবার। তারপর আমাদের গোটা দল একজায়গায় এসে দাঁড়ালো। আমি একটু উপযাচক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম , "কাল ঠিক কী হয়েছিল একটু খোলসা করে বলবে?" নিজামুউদ্দিন বলতে শুরু করল, "কাল সারাদিনে মাছ আর কাঁকড়া পায়েছি। ক্ষ্যাপ দিয়ে দিয়ে এগোচ্ছি, তারপর ফিরবো। পীরখালি খালের ভেতরে আরো একটা ছোট খাল। হঠাৎ দেখি সেকি মাছ! জোয়ার আসতেছে। পানির থেইকে পারশে মাছ জানি বেশি। কোটালমুখী স্রোতে মাছ পড়বেই পড়বে। সে জানি ঝাঁকি বেঁইন্দে বেঁইন্দে আসতিসে। আমরা সেখানে দুইডা ক্ষ্যাপ দিসি, জাল টেনে দেখি কোন মাছ নেই। কেমন খটকা লেগেছে। বনের নিয়ম, খটকা লাগলে সেখানে আর কাজ করতি নেই। জঙ্গলের হেতাল গাছের ওপাশে মট্ কইরে কিসের আওয়াজ পাইসি। উদিকে বেলা হয়েছে, আমি বলতিছি ভাই এবারে ফিরি চল্। তা সে বলে দাঁড়াও আর একটা ক্ষ্যাপ দিছি, তুলি লই। আমরা এই শুনে নৌকার দিকি এগোচ্ছি আর ডাকতিছি, আয় আয়। সে একবার সাড়া দিসে। আর সাড়া দেয় না। ঝপ করে কিসের জানি আওয়াজ হইসে। সাড়া দেয়না দেখে আমি এগিয়ে গেছি। কিছু দ্যাখতে পাইনে। ডাক দিই নাম ধরে, কোন সাড়া নেই।"


এতো পর্যন্ত বলার পর দ্বিতীয় আরেক মাঝি প্রসঙ্গ টেনে নেয়। ওর নাম সাহেব। সাহেবের কথায় কাদার উপর দিয়ে একটা শরীরকে টেনে নিয়ে যাবার দাগ ছিল। কিন্তু বাঘের গর্জন শোনা যায়নি। তাই অনেকের মত সাহেবেরও মত, ওই দাগ কুমিরেরও হতে পারে।

নিজাম সেই কথায় বেশ জোরালো আপত্তি জানালো, "কুমির হলি পানিতে টানি নামাতি পারে, জঙ্গলের দিকি টেনে নেবে কেন?"

আমি ওদের তর্ক থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম , "তারপর? তারপর কী হল? তোমরা দাগ লক্ষ্য করে ভেতরে খোঁজনি?"

ওরা বলল, "গিয়েছিলাম তো! জঙ্গলের ভিতর শ্বাসমুলের গায়ে আর আশেপাশের গাছের গায়ে রক্তের দাগ ছেল। এক জায়গায় গিয়ে কোমরের গামছাটাও পেয়েছি। সেই চিহ্ন ধরি ধরি বেশ খানিক এগোয়ছি, কিন্তু দেহ খুঁজি পাইনি।"

আমি বললাম, "তারপর?"

– "জোয়ারের পানি জঙ্গলে ঢুকে আসছেল। উদিকে বিকেল হয়ে গ্যাছে। আমাদের সাথে বড় গুণমান ছিল, হে কয় এবার ফিরতি হবে। আর এহানে থাকা যাবেনা একটুও। সময় ভালো ঠেকসে না। আমরা একরকম বাধ্য হয়ে বের হয়ে আসি।"

এই এতোক্ষণে আমার নজর পড়ল গুণমান অহীদুল হকের দিকে। বছর পঞ্চাশেক বয়স, একমাথা কাঁচাপাকা চুল আর দাড়ির জঙ্গলের মধ্যে চোখদুটো খুব প্রখর। আমি এগিয়ে যেতে সে নিজেই বলতে লাগল, "এতোগুলো মানসের প্রাণ হেফাজতে নিয়ে আমাদের কাজ করতি হয়, বাঘের মুখ বন্দ দিয়ে এগোতে হয়, সব সময় চোক-কান খোলা রাখতি হয়। তোমরা ভাবো জঙ্গলে শুধু বাঘির ভয়? জঙ্গলে আলি আরো কত ভয়ডর আছে! জলে কুমির ডাংগায় বাঘ। তাছাড়া ডাকাইতের ভয় আছে। জিন, প্রেত, পরী আরো কত কী! আমরা কাল জঙ্গলে ঢুকে, কোরানের রায়াত দিতি দিতি এগিয়েছিলাম। বাঘের পায়ের ছাপ দু-একটা দেখিনি তা নয়, তবে সাথে আরো একটা ছাপ দেখেছি ওদের পা দেখতে মানষের মত কিন্তু পায়ের পাতা থাকে না। ওরা হেঁটে গেলি গর্ত-গর্ত হয়। রক্তের দাগ লক্ষ্য করে একটা খাল পার করে গেছি, এরা সমানে কুউ-কুউ সাড়া দিচ্ছে, সেদিকে কোন সাড়া নেই। উদিকে অন্দকার নামসে দ্রুত..."

আমি অহীদুলকে থামিয়ে বললাম, "কুউউ দিতে দিতে কেন? নাম ধরে ডাকোনি?"

সে গম্ভীর স্বরে বলল, "জঙ্গলে আলি নাম ডাকতি নেই। বাঘে, পিশাচে চিনি রাখে। একবার চিনলি তাকে রক্ষে নেই!"

আমি বললাম, "তাই? তারপর!"

— "খানিক গিয়ে দেখি জঙ্গলের ভিতরে জমা পানি, সে পানি সাংঘাতিক গরম, ছ্যাঁকা লেগি যায়। তহন আমি ট্যার পাইসি, এমন তো হবার কথা নয়! আমার খটকা লেগেছে। আমি ওদের বলেছি এহনি জঙ্গল ছাড়তি হবে, না হলি আর বিপদ আসতি পারে। শ্যাষে সকলে ফিরে গ্যালাম।"

অহীদুলের থেকে শোনার পর আমার বেশ কটা বিষয়ে একটু সন্দেহ জাগল। ফরেস্টার অফিসার তাপস গায়েনকে কানেকানে বললাম, "এসব ভূতপ্রেতের গল্প আমার বিশ্বাস হয়না। জঙ্গলে এসে নাম ধরে ডাকলে বাঘে আর ভূতে চিনে রাখবে সে আবার কেমন কথা?"

তাপস বাবু বললেন, "আসলে কী জানেন? বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদুর। এখন জঙ্গলে বহু নিয়ম আছে, সবটা যে কুসংস্কার তাও নয়, কিছু যুক্তি নিশ্চই রয়েছে।"

 – "যেমন?"

– "যেমন ধরুন। কুউউ ডাকের পেছনে কারণ হিসেবে আমার যেটা মনে হয়, জঙ্গলে একটু জোরে কথা বললেই তো বিভিন্ন প্রতিফলন হয়, জঙ্গল কেঁপে ওঠে। জঙ্গলে নিস্তব্ধতাই তো কাম্য তাই না? বড় নাম ধরে ডাকলে ডাকটা ছড়িয়ে যায়, বা তেমন করে হয়তো শোনা যায় না। তাই কুউ ডাকটা অনেক সহজ পদ্ধতি বলতে পারেন।"

– "কিন্তু এই ভূত-প্রেত, জিন?"

– "দেখুন, এসব নিয়ে এদিকে চর্চা আছে ঠিকই। আমি তো কখনো দেখিনি। তবে কিছু জিনিস আমারও যে গোচরে আসেনি এমন নয়। কেন হয়, কী হয় বলতে পারব না। জঙ্গল মানে অনেক বড় ধোঁয়াশা! আমরা ফরেস্টাররাও সবটা বুঝে উঠতে পারিনি। রাত বিরাতে কাজেকর্মে কিছু ডাক শুনেছি, তবে তার কোন সঠিক কারণ খুঁজে পাইনি।"

আমি বললাম, "আচ্ছা এই যে লাশটা পাওয়া গেল না, কোন চিহ্নই আর পাওয়া গেল না, এর কারণ কি? আপনার কী মনে হয় কালকে যেদিকে ওরা ছিল সেদিকে আর একবার যাবেন?"

উনি বললেন, "যেতে তো হবেই! তবে লাভ হবে বলে মনে হয়না। কাল যখন ওরা জঙ্গল ছেড়েছে তখন জোয়ারের জল জঙ্গলে ঢুকে এসেছে। আন্দাজ করছি ভরা জোয়ারে ধুয়ে গেছে সব এভিডেন্স।"

নিজামুউদ্দিনের ভাঙা গলাটা কানে এলো, "ভাইকে না নে' আমি কিছুতেই যাবো না।"

আমি বললাম, "বেশ তো! কিন্তু কী করা যায় তোমরাই একটু ভেবে বল। আমরা তো খুঁজতেই এসেছি তোমার ভাইকে। কাল তোমরা যেদিকগুলো দেখেছ সে জায়গাগুলো আর একবার দেখি।"

সাহেব এগিয়ে এসে বলল, "নিশ্চই দেখবো। লাশ উদ্ধার না করে যাবো না। না হলি ঘরে ফিরে চাচা-চাচী আর কুদরতকে কী জবাব দেব?"

কুদরত নামটা শুনেই একটু মন কেমন করে উঠলো, "কুদরত? কে?"

সাহেব বললে, "আফতাবের বিবি গো! গেল বছরের শীতে ওদের শাদী হয়েছে। আফতাব নিখোঁজ হয়েছে খবর শোনার পর থেকে ঘরে সকলে কান্নাকাটি করছে, হে চুপ করে বসি ছিল, জানি একতাল পাথর! আমি যহন বের হয়ে আসি দেহি চুপ করে ঘাটের দিকে চেয়ে বসে আছে। আমি ওকে কথা দিয়ে আসছি, খবর ঠিক আনবোই। এই শোকে হে কিছু বলার অবস্থাতেই নাই। খালি একটু মাথা নাড়সে।"


-কাঁচা মাটির উঁচু চর, মানুষের এলোপাথাড়ি পদচারণে হাড়পাজরা বের হয়ে আসা কাদামাটির পথ, কোথাও বেখাপ্পা ঠেলে উঠেছে, কোথাও তুবড়ে গিয়েছে একেবারে। পাশাপাশি দুই লোকে হেঁটে চলার জো নেই। তবু তার মধ্যে পথ আগলে বসে থাকেন মা বনবিবি। মোটা বাঁশের চারখুঁটিতে চাটাই আর প্লাস্টিকের ছাউনী ঘেরা আস্তানা। এমন আগলানো পথে গোটা দিনের খাতা খুলে বসে মানুষ গোনাই যেন তার কাজ। খেয়া পারাপারের কতদূর সে পাহারা দিতে পারে কে জানে? কাদামাটির ঢালু ঘাটের কিছুটা সারি সারি ইট পেতে সমান করা হয়েছে জমিন। মাঝেমধ্যে বহুইটের গাঁথুনি থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসা একটা তেড়ছা ইটের ধাপ, আনাড়ীরা ওই পথে ওঠে নামে। নিত্যদিনের পথচলতি মানুষ সেই ধাপের ধার ধারে না। যথা সময়ে ট্রেকার ফেরি ঘাটে ভিড়েছে। সাহেব তৎপর ভাবে এগিয়ে এসে মোটা কাছিটা ঘাটের দিকে ছুঁড়ে দিতেই অপেক্ষারত মাঝি কাছি টেনে আঁটোসাঁটো বেঁধে ফেলল সামনের উঁচু থামে। ট্রলার থেকে একজন একজন করে নেমে এলো মাঝিভাইরা, শরীরে দিনভরের ক্লান্তি, মনে বড় চাপ। কি করুণ তাদের চোখের চাহনি! কেউ জেটির উপরে উবু হয়ে বসেই কেঁদে উঠলো, কেউ প্রাণহীন চাহনিতে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইল। বনবিবির ছাউনীর পাশে সকাল থেকে বসে আছে বছর ষোলোর এক কিশোরী। কুদরত... নিজের নামের সংজ্ঞা বোধগম্য হবার আগে জীবনসংগ্রাম তার নিত্য সঙ্গী হয়ে দাঁড়ালো। দুইদিন ভর পেটে দানাপানি জোটেনি। শরীরের ভিতর গজিয়ে ওঠা নতুন জানটা পাঁচ মাসের মুখে এসে নিজের হক জানান দিচ্ছে আপ্রাণ। আর কিছু সময় গেলে দুই হাতের মুঠোয় যেন ছিঁড়ে খাবে পেটের নাড়িভুঁড়ি। ঢালু পথ বেয়ে উঠে আসছিল সাহেব। কুদরতের চোখে তখন অনেক প্রশ্ন, তবু মুখে কথা সরেনা। সে চাহনি সাহেব বোঝে,বড় অসহায় লাগছে আজ।

আফতাবের বাড়িতে আজ বড় দুর্দিন। বারেবারে সংজ্ঞা হারিয়েছেন আম্মু। কুদরত সকাল থেকে ঘরে ফেরেনি। এক সময়ে কুদরতেরও খোঁজ পড়ল ... কোথায় সে? ঘরে নেই, শোকের মহলে সে নেই, মাঠে নেই, ঘাটেও নেই। পরশি বউ বলল, "ইকটু আগে আলো, বলল খাবার কিছু আসে ঘরে? আমি বললাম আসে, কটা বিস্কুটের প্যাকেট। বলল ইট্টু চা দে। আমি তো অবাক! বলল সময় নেই, খুব তাড়া। চায়ে চুমুক দিয়ে প্যাকেট কটা সাথে নেলো, তারপর ঘাটের দিকে দৌড় দেসে।"

– "কই গেল তুই দেখলি না?"

– "বলল যে তাড়া আসে। ছুট দিলো। আমি তহন ভাবলাম কী জানি কী তাড়া!"

নিজামুদ্দিন ডাক দিল, "একটু আগায়ে দেখ গিয়া সাহেব ভাই। কই গেল পোয়াতি মাইয়া।"

জনা তিন চারেক মানুষ এগিয়ে গেল। লোকালয়, বাজার, ঘরের সীমানা, যাবার সম্ভাব্য জায়গা, খোঁজা হল প্রায় সবটা। সন্ধ্যে তখন বেশ গাঢ়। হঠাৎ খালপাড় থেকে ডাক এলো, "ডিঙি নৌকাটা দেহিনা কেন্ রে?"

অনেক খুঁজে ডিঙি নৌকার খোঁজ মিলল না। কে নিলো তাও অজানা। জোয়ারের টানে কোন নৌকা কতদূর বেয়ে চলে, কোথায় থামে, কোথায় গিয়ে হারিয়ে যায় সে খবর তো আল্লাহ- জানেন। কুদরত হলে কত করিশমাই তো ঘটে! সে ভেসে যেতে যেতেও ফিরে আসতে জানে, ফিরিয়ে আনতেও জানে। মাঝরাতে দূঊরে কোথাও গহীন জঙ্গলে ডাক ভেসে বেড়ায়... কুউউ! কুউউ!



2 মন্তব্যসমূহ

  1. বেশ ভালো একটা লেখা পড়লাম, ভাষার জন্য আরো বেশি মন চাইলো পড়তে...এটা তো শুধু গল্প নয়, প্রান্তিক ওই মানুষ নিত্য নৈমিত্তিক জীবন শৈলী...

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন