সৌন্দর্যের গুণগান করে না এমন কেউ নেই, তা যদি নারীর সৌন্দর্য্য হয় তাহলে তো কথায় নেই। নারীর সৌন্দর্য্য নিয়ে কত কবিতা, গান, গল্প, সিনেমা, নাটক, লড়াই হয়ে গেল তার ইয়ত্তাই নেই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,
"শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।
সঁপিয়া তোমার 'পরে নূতন মহিমা
অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা।
কত বর্ণ কত গন্ধ ভূষণ কত-না,
সিন্ধু হতে মুক্তা আসে খনি হতে সোনা,
বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার,
চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার।
লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ,
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন।
পড়েছে তোমার 'পরে প্রদীপ্ত বাসনা
অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা। "
আজ আমরা এমনই এক নারী সম্পর্কে জানব। যিনি 'বিউটি উইথ ব্রেন' নামে পরিচিত, তিনি হলেন ভারতের প্রথম ব্রহ্মান্ড সুন্দরী সুস্মিতা সেন।সুস্মিতা যার অর্থ সর্বদা হাস্যজ্জল; সুন্দর হাসি।
পিতাঃ সুবীর সেন ( ভারতীয় বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার ছিলেন )।
মাতাঃ শুভ্রা সেন( অলঙ্কার ডিজাইনার এবং দুবাইভিত্তিক একটি দোকানের মালিক)।
ভাইঃ রাজীব সেন।
জন্মস্থানঃ সুস্মিতা সেন হায়দ্রাবাদে বাঙালী বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
জন্ম সময়ঃ ১৯ শে নভেম্বর ১৯৭৫।
দুই দত্তক সন্তানঃ রেনি (২০০০) ও আলিশা (২০১০)।
শিক্ষাঃ তিনি নতুন দিল্লীতে বিমান বাহিনীর গোল্ডেন জুবিলী ইন্সিটিউট-এ ভর্তি হন এবং পরে সেকেন্দ্রাবাদে সেন্ট অ্যান্ট'স হাইস্কুলে ভর্তি হন কিন্তু উচ্চ শিক্ষা নিয়ে আর এগোননি।
মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতা,১৯৯৪
স্থানঃ গোয়া, ভারত।
নাম দেওয়া নিয়ে ঘটনাঃ সুস্মিতা সেন যখন প্রতিযোগিতায় নাম দিতে যান, তখন সেইখানের স্টাফ তাঁকে নাম তুলে নিতে বলেন। তার আগে ২৫ জন মেয়ে নাম তুলে নিয়েছে - এইটাও বলেন। সুস্মিতা ভয়ও পেয়ে যান এবং ফর্ম জমা না দিয়েই চলে আসেন। কারণ, ঐশ্বর্য রায়ের মতো সুন্দরী প্রতিযোগির কাছে হেরে যাওয়ার ভয় ছিল যে!
সুস্মিতা বাড়ি ফিরে গেলেন। তাঁর মা তাঁকে ফর্ম জমা না দেওয়ার জন্য বকলেন। আর বুঝিয়েছিলেন, চেষ্টা না করে হাল ছেড়ে দেওয়া কখনও উচিত নয়। তুমি যদি মনে কর ঐশ্বর্য পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে তাহলে তুমি তার কাছ থেকেই হার মানো, অন্য কারও কাছে হেরে কী লাভ? যাও তোমার বেস্টটা দাও। এই কথা শুনেই তিনি পরের দিন শেষ মূহুর্তে ফর্ম জমা দিলেন। এরপরের ঘটনা সবারই জানা।
পোশাক তৈরির গল্পঃ সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় পোশাকের গুরুত্ব অপরিসীম। তা আবার যদি মিস ইন্ডিয়ার মতো প্রতিযোগিতা হয় তাহলে তো কথায় নেই!
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সুস্মিতা সেনের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার মতো তেমন ভালো পোশাক ছিল না, না ছিল ভালো ডিজাইনার তৈরি করার মতো টাকা। তাই তারা সরোজিনী নগর বাজার থেকে কাপড় কিনে আনেন। সেই কাপড় এক দর্জিকে দিয়ে সেলাই করিয়ে পোশাক তৈরি করান এবং সেই পোশাক পরেই তিনি ১৯৯৪ সালের মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতা জেতেন।
তিনি এই সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
"যখন আমি মিস ইন্ডিয়ার জন্য যাই তখন আমাদের কাছে এত পয়সা ছিল না যে আমি ডিজাইনার কাপড় পরে স্টেজে যাব। আমার চারটা পোশাকের দরকার ছিল। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ, আর আমারা আমাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানতাম। তখন আমার মা বলেন,'তো কী হয়েছে? কাপড় দেখতে থড়িই আসছে লোক, তোমাকে দেখতে আসছে। এরপর আমারা আমাদের কাজে লেগে গেলাম। সরোজিনী নগর বাজার থেকে কাপড় কিনে আনল। আমাদের নীচে গ্যারেজে
একজন পেটিকোট সেলাই করা দর্জি ছিল তাকে গিয়ে কাপড়টা ধরিয়ে দিলাম। আমার মা তাকে বলেছিল, ভাই T.V তে আসতে চলেছে ভালো করে বানাও। তো উনি ঐ ফেব্রিক
দিয়ে আমার উইনিং গ্রাউন তৈরি করে দিলেন। মা বেঁচে যাওয়া ফেব্রিক দিয়ে গোলাপ তৈরি করে ছিল, যা সামনে লাগানো হয়েছিল। তারপর নতুন ব্রেন্ডের মোজা কিনে কেটে তাতে ইলাস্টিক দিয়ে হাতে পরার হাত মোজা তৈরি করা হয়েছিল এবং ওটা আমি পরেছিলাম।"
এরপরের ঘটনা তো সবাই জানে। তিনি মিস ইন্ডিয়ার প্রতিযোগিতা জিতেছিলেন। এরপর তিনি বলেন, 'দেখো মানুষের যা চায় তারজন্য পয়সার দরকার হয় না এরজন্য intention চায়।'
এই প্রশ্নের উত্তরে সুস্মিতা উত্তর দিয়েছিলেন, 'আমার মনে হয় এর উত্তরাধিকার শুরু হয়েছে মহাত্মা গান্ধীর খাদি থেকে। তার পর থেকে পোশাক হয়তো অনেক বদলে গেছে। কিন্তু আমার মনে হয়, ভারতীয় টেক্সটাইল হেরিটেজের ভিত্তি সেখান থেকেই শুরু হয়েছে।’
তাঁর উত্তর বিচারকদের মুগ্ধ করেছিল এবং সুস্মিতা সেন, যিনি প্রতিযোগিতা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন, শেষ পর্যন্ত মিস ইন্ডিয়া হয়েছিলেন।
মিস ইউনিভার্স, ১৯৯৪
মিস ইন্ডিয়া জেতার পর তিনি মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতাতে অংশগ্রহণ করার জন্য ফিলিপাইন্সে যান। ৭৭ জন প্রতিযোগী এই বছর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তারমধ্যে থেকে তিনি জিতে নেন মিস ইউনিভার্সের ক্রাউন, হয়ে যান ভারতের প্রথম 'মিস ইউনিভার্স'।
সম্প্রতি মিস সেন একটি আবেগঘন পোস্ট করেন, 'ইতিহাস সাক্ষী, ২৯ বছর আগে ২১শে মে ভারত প্রথম মিস ইউনিভার্স খেতাব জেতে'।
'এই ছবিটার বয়স ঠিক ২৯ বছর। এই ছবিটা তুলেছিলেন দুর্দান্ত চিত্রগ্রাহক প্রবুদ্ধ দাশগুপ্ত। এই ছবির মাধ্যমেই তিনি ১৮ বছর বয়সী আমিটাকে ফ্রেমবন্দি করেন। উনি একটু হেসে আমায় বলেছিলেন, তুমি বুঝলে তুমিই কিন্তু প্রথম মিস ইউনিভার্স যার ছবি আমি তুললাম। আমি তখন তাঁকে গর্বের সঙ্গে বললাম এটা আসলে ভারতের প্রথম মিস ইউনিভার্সের ছবি।'
বিনোদন জগতেঃ
সুস্মিতা সেন ১৯৯৬ সালে মহেশ ভাটের থ্রিলার ছবি 'দস্তক' এর মাধ্যমে সিনেমা জগতে পা রাখেন। এরপর তিনি তামিল ভাষায় রোমান্টিক অ্যাকশন চলচ্চিত্র 'রাতচাগান' (১৯৯৭) এ অভিনয় করেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন