নাগার্জুনের দর্শনে স্বভাব ও শূন্যতা: পর্ব ২ - ডঃ দীপ সরকার

নাগার্জুন (চিত্রসুত্র: www.wayofbodhi.org/)


আগের পর্বে ( পর্ব - ১ পড়ার লিঙ্ক)  আমরা বাস্তবতার চূড়ান্ত প্রকৃতি (শূন্যতা) সম্পর্কে নাগার্জুনের দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছি এবং দেখেছি যে এই চূড়ান্ত প্রকৃতি নিজেই স্বভাবশূন্য ও ধারণাবহির্ভূত, অর্থাৎ অনির্বচনীয় । কিন্তু আমরা এখনও নাগার্জুনের দর্শনের ভিত্তি যে নীতিটি তাই নিয়ে কোনো কথা বলিনি । উল্লেখযোগ্য, ভারতীয় দার্শনিকদের মধ্যে যিনি প্রথম এই নীতিটি ব্যবহার করেন তিনি নাগার্জুন নন । বরং এই নীতি, যাকে “চতুষ্কোটি” বলে অভিহিত করা হয়, প্রথম যিনি প্রয়োগ করেন তিনি হলেন ভারতীয় সংশয়বাদী দার্শনিক সঞ্জয়, যিনি বুদ্ধেরও আগে জন্মগ্রহণ ও শিক্ষাদান করেন বলে কথিত আছে ।

কী এই চতুষ্কোটি নীতি? সহজ ভাষায়, চতুষ্কোটি হল বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করবার চারটি নিম্নোক্ত বিকল্প বা “কোটি”:

১. একটি প্রস্তাব “S হল P” সত্য 

২. S হল P অসত্য 

৩. S হল P সত্য এবং অসত্য 

৪. S হল P না সত্য, না অসত্য (সত্য বা অসত্য কোনটাই নয়)

উপরোক্ত চারটি বিকল্পের মধ্যে ৩ ও ৪ স্পষ্টতই বিভ্রান্তিকর । এগুলি কি (যথাক্রমে) অ্যারিস্টটলের law of non-contradiction এবং law of excluded middle কে লঙ্ঘন করে না? একটা প্রস্তাব একইসাথে সত্য ও অসত্য কীভাবে হয় আবার না সত্য, না অসত্যই বা কেমন করে হয়?

তৃতীয় বিকল্পের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে, তবে নাগার্জুনের দর্শনের আলোচনার জন্য সেটা খুব প্রাসঙ্গিক নয় । আমাদের আপাতত এটা মাথায় রাখলেই চলবে যে শূন্যতার ক্ষেত্রে নাগার্জুন এই চারটি বিকল্পই নাকচ করেছিলেন । 

 নাগার্জুনের যুক্তির জন্য যেটা অধিক প্রাসঙ্গিক, সেই চতুর্থ বিকল্পের দিকে নজর দেওয়া যাক । এই বিকল্পে বলা হয়েছে যে S হল P এই প্রস্তাবটি সত্য বা অসত্য কোনটাই নয়; তবে সেটি কী? এটা বোঝার জন্য আমাদের negation বা অস্বীকৃতির ধারণা সম্পর্কে বিশদে আলোচনা দরকার । 

ধরা যাক আমার প্রস্তাবটি হল “৫ সংখ্যাটি লাল নয়”; এই বিবৃতিটি আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন । আমরা জানি যে সংখ্যার কোন রঙ হয় না, তাই একটি সংখ্যাকে লাল নয় বলাটা সংখ্যাটি অ-লাল কোন রঙের বলার মতই অর্থহীন শোনায় । 

কিন্তু এটি কেবল একটি বিশেষ ধরনের অস্বীকৃতি যেখানে কোন একটি বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করার অর্থ তার বিপরীত বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করা বলে ধরে নেওয়া হয় । এই ধরনের অস্বীকৃতিকে “choice negationবলা হয় । Choice negationএর অর্থে কোন সংখ্যাকে লাল নয় বললে বোঝানো হয় যে সংখ্যাটি অন্য কোন রঙের

কিন্তু উপরোক্ত অস্বীকৃতিটিকে আরেকভাবে বোঝা যেতে পারে যেখানে একটি বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করলে তার বিপরীত কোন বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করা হচ্ছে বলে অনুমান করা হয় না । অর্থাৎ এইক্ষেত্রে “৫ সংখ্যাটি লাল নয়” বললে কেবল এটুকুই বুঝতে হবে যে ৫ সংখ্যাটির “লাল” বলে কোন বৈশিষ্ট্য নেই । এই ধরনের অস্বীকৃতিকে “exclusion negation” বলা হয়ে থাকে 

আশা করি এইবারে যদি আমি বলি “৫ সংখ্যাটি লাল বা অ-লাল কোনটিই নয়” তবে সেটি শুনতে একেবারে অর্থহীন লাগবে না কারণ সংখ্যাদের ক্ষেত্রে রঙের ধারণাই প্রযোজ্য নয় । সুতরাং, চতুষ্কোটির চতুর্থ বিকল্পের প্রকৃত অর্থ হল P এমন কোন বৈশিষ্ট্য যা Sএর থাকতে পারে না

কিন্তু পাঠক মনে করে দেখুন, আমি বলেছিলাম যে নাগার্জুন শূন্যতার ক্ষেত্রে চতুষ্কোটির চারটি বিকল্পকেই নাকচ বা অস্বীকার করেছিলেন । অর্থাৎ শূন্যতা “সত্যও নয় আবার অসত্যও নয়” এমনটাও নয় । অন্যভাবে বললে, শূন্যতা সত্য ও অসত্যের থেকে ভিন্ন কিছু এমনটাও নাগার্জুন বলছেন না, কারণ যে-কোন বিষয়ই হয় সত্য (সৎ) কিংবা অসত্য (অসৎ) এই দুটোর একটাই হতে পারে; তৃতীয় কোন সত্তা নেই । সুতরাং, শূন্যতা যেহেতু সত্য ও অসত্যের থেকে ভিন্ন তৃতীয় কোন সত্তা নয়, এর অর্থ শূন্যতাকে চতুষ্কোটি দিয়ে ধরা সম্ভব নয়; তা চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত

চতুষ্কোটি সম্পর্কে আলোচনার একেবারে গোড়াতে বলেছিলাম যে নাগার্জুনেরও আগে চতুষ্কোটির প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন সংশয়বাদী দার্শনিক সঞ্জয় । কিন্তু নাগার্জুনের মতো বাস্তবতার প্রকৃতি সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে তিনি এর ব্যবহার করেননি । বরং একজন প্রকৃত সংশয়বাদী হিসেবে তিনি বাস্তবতাকে অস্বীকার করতেই চতুষ্কোটির প্রয়োগ করেছিলেন । উল্লেখ্য, সঞ্জয়কে যখন কোন বিষয়ের সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হত, তিনি “হ্যাঁ” বা “না” কোন উত্তরই দিতে চাইতেন না । এর কারণ সঞ্জয় “কিছুই বাস্তব নয়” এমন একটা বিবৃতিকেও একটি দাবী বা স্বীকৃতি হিসেবে দেখতেন আর যেহেতু সেটা দাবী সেহেতু তাকেও অস্বীকারযোগ্য বলে মনে করতেন । অর্থাৎ কোন বিবৃতিকে অস্বীকার করলে তার বিপরীতকে তিনি স্বীকার করছেন এমন ধারণা দেওয়া থেকে সঞ্জয় বিরত থাকতেন; এই অর্থে তার অস্বীকৃতি ছিল বর্জনীয় প্রকৃতির বা “exclusion negation

এখানে উল্লেখ্য যে কিছু প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধও নীরব থাকতেন বলে কথিত আছে; এমন একটি প্রশ্ন হল “আত্মা বলে সত্যি কিছু আছে কিনা?” কিন্তু তাঁর এই নীরবতা আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকারের ইঙ্গিত বহন করে না; এটি একটি ভুল ধারণা যে বৌদ্ধধর্ম আত্মাকে অস্বীকার করে । বুদ্ধের নীরবতা পালনের নেপথ্যে রয়েছে তাঁর মধ্যপন্থার দর্শন, যা একদিকে বেদান্তবাদীদের শাশ্বত আত্মার ধারণাকে যেমন স্বীকার করে না, তেমনই অন্যদিকে বিনাশবাদীদের দেহাত্মবাদকেও (অর্থাৎ “দেহই আত্মা” এই ধারণাকে) স্বীকৃতি দেয় না । 

চতুষ্কোটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যবহার পাওয়া যায় শংকরাচার্যের অদ্বৈত বেদান্তের দর্শনে; শংকরাচার্য চতুষ্কোটির ব্যবহার বাস্তবকে অস্বীকার কিংবা শূন্যতার প্রতিষ্ঠা করতে করেননি, বরং করেছেন ব্রহ্মকে চূড়ান্ত বাস্তব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে (কিছু দার্শনিক যদিও এমন যুক্তি দিতে চেষ্টা করেছেন যে শংকরের ব্রহ্ম এবং নাগার্জুনের শূন্যতা অভিন্ন ধারণা, এই দাবী নিয়ে সংশয় থেকে যায়; নাগার্জুনের শূন্যতা নিজেও স্বভাবরহিত, উল্টোদিকে শংকরের ব্রহ্ম একটি স্বভাবসম্পন্ন সত্তা)

কিন্তু শংকর কীভাবে একই নীতি ব্যবহার করে এমন একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যা নাগার্জুনের সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ বিপরীত? এর নেপথ্যে রয়েছে অস্বীকার বা negation সম্পর্কে শংকরের দৃষ্টিভঙ্গি । সঞ্জয় বা নাগার্জুন যেখানে exclusion negation ব্যবহার করেছেন, শংকর সেখানে choice negation ব্যবহার করেছেন তাঁর ধারণায় প্রত্যেক নেতি বা অস্বীকারের একটি ইতিবাচক ভিত্তি থাকা আবশ্যিক । উদাহরণস্বরূপ, আমি যদি বলি “কলমটি কালো নয়” তাহলে শংকরের মতে এর অর্থ অবশ্যই কলমটি অবশ্যই অন্য কোন রঙের, কেননা অন্য রঙ না দেখে থাকলে “কালো নয়”এর  ধারণা আমার কীভাবে তৈরি হবে?

সুতরাং, শংকরের দৃষ্টিভঙ্গিতে চতুষ্কোটির অস্বীকার বাস্তবতার প্রকৃতিকে প্রতিষ্ঠা করতে যথেষ্ট নয়; শংকরের অনুসারীরা তাই একটি পঞ্চম নেতি উপস্থাপন করেন যা চতুষ্কোটির অস্বীকারকেও অস্বীকার করে । এই অস্বীকারের অস্বীকারের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয় চতুষ্কোটির নেতির ইতিবাচক ভিত্তি, যা বাস্তবগুণরহিত । এই ইতিবাচক বাস্তবগুণরহিত ভিত্তিই হল ব্রহ্ম


References

1.      Westerhoff, J. (2009). Nagarjuna's Madhyamaka: A Philosophical Introduction. Oxford University Press.

2.      Raju, P. T. (1954). The Principle of Four-Cornered Negation in Indian Philosophy. The Review of Metaphysics, 7(4), 694713.

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন