শূন্যবাদ কি আসলে নাস্তিবাদ?
নাগার্জুনের দর্শন ও তার সিদ্ধান্তগুলি যে কৌতূহলোদ্দীপক
এবং মাঝে-মধ্যে হজম করা কষ্টকর তাতে কোন সন্দেহ নেই ।
শূন্যবাদের দৃষ্টিভঙ্গী দর্শনিকগণের মাঝে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, যার মধ্যে
অন্যতম হল এই অভিযোগ যে শূন্যবাদের দর্শন মূলত সত্তাতাত্ত্বিক নাস্তিবাদের (ontological nihilism)
দর্শন, যে দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী কিছুরই (অর্থাৎ কোন প্রপঞ্চ বা বস্তুর) অস্তিত্ব
নেই ।
আপাতদৃষ্টিতে
এই অভিযোগ অবান্তর বলে মনে হতে পারে; যে সম্প্রদায় নিজেকে “মধ্যপন্থা”র অনুসারী
বলে দাবী করে, যে কারণে তাদের দর্শনের নামই “মাধ্যমক”, তা নাস্তিবাদী কীভাবে হওয়া
সম্ভব? কিন্তু এমন অভিযোগকে “অবান্তর” বলে বাতিল না করে তাকে গুরুত্বের সাথে
বিবেচনা করার নেপথ্যে প্রধান যুক্তি হল প্রাচীনকালে ভারতীয় দার্শনিকদের মধ্যে শূন্যবাদকে নাস্তিবাদ হিসেবে বিবেচনা
করার প্রবণতা প্রবল ছিল, এতটাই যে “শূন্যবাদ” ও “নাস্তিবাদ” আজও সমার্থক হিসেবে
বিবেচিত হয় । ভারতীয় দর্শনের প্রভাবশালী আত্মবাদী
দার্শনিকদের মধ্যে যাদের অন্যতম মনে করা হয়, তাঁরাও এমন বিবেচনা করেছেন । এদের
মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যারা তাঁরা হলেন ন্যায় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত দার্শনিক
উদ্যোতকার এবং অদ্বৈত বেদান্তের প্রতিষ্ঠাতা শংকরাচার্য ।
এবারে আত্মবাদী দার্শনিকদের আপত্তির কারণের দিকে তাকানো
যাক; উদ্যোতকারের অভিযোগটি এরকম – “কোন কিছুরই
অস্তিত্ব নেই” এই অবস্থানটি স্ব-বিরোধী কারণ এটিকে জ্ঞানমূলক দাবী বলে মানতে হলে
এটাও মানতে হয় যে এই জ্ঞান আহরণের মাধ্যমের বা প্রমাণের (means of knowledge)
অস্তিত্ব আছে, যা ব্যতীত এই দাবীর সত্যতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় । সহজ ভাষায় বললে,
আমি কীভাবে জানতে পারছি যে কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই যদি আমাকে তা জানতে সাহায্য
করার জন্য কিছুর অস্তিত্ব না থাকে?
পরিবর্তে
শংকরাচার্যের সমালোচনার বক্তব্য হল মাধ্যমক দর্শন কোন “পরম বাস্তব” প্রতিষ্ঠা না
করেই ব্যবহারিক বাস্তবতাকে (conventional
reality) অস্বীকার করে । অন্যভাবে বললে, শংকরের
যুক্তি হল কোন একটি স্তরের বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে হলে অন্য একটি স্তরের
বাস্তবতার প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন; কোনো পরম বাস্তবতার স্তর না থাকলে কোন বিষয়েরই
অস্তিত্ব থাকা সম্ভব হয় না ।
এই
অভিযোগদ্বয়ের জবাবে মাধ্যমকদের প্রতিযুক্তি তুলে ধরার আগে নাস্তিবাদ বলতে শংকর কী
বুঝিয়েছেন সেটা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা দেওয়া সমীচীন । মূলত, নাস্তিবাদের এই
দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী –
১.
যা কিছু অ-মৌলিক (অর্থাৎ যা কিছুই তার অস্তিত্বের জন্য অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল)
তার অস্তিত্ব নেই ।
২.
বাস্তবতার কোন মৌলিক স্তর বলে কিছু নেই (সবকিছুই অন্যের উপর নির্ভরশীল) ।
১ ও
২কে একত্রে সত্যি বলে মানলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া খুব কঠিন নয় যে কোন সত্তাই
অস্তিত্বশীল নয় (সত্ত্বাতাত্ত্বিক নাস্তিবাদ) ।
বেশ,
এবার দেখা যাক আত্মবাদীদের অভিযোগের উত্তরে মাধ্যমকদের প্রতিযুক্তি কী; ১এর
বিরুদ্ধে যুক্তি হল শূন্যবাদ অ-মৌলিক বিষয়ের অস্তিত্বশূন্যতার মতবাদ নয়, বরং
তাঁদের অস্তিত্বের স্বভাবশূন্যতার মতবাদ । উদাহরণস্বরূপ, একটি কলস স্বভাবশূন্য
অর্থ এই নয় যে কলসটি অস্তিত্বশূন্য; কলসটি অবশ্যই অস্তিত্বশীল কারণ তা নিজের মধ্যে
তরল (যথা, দুধ বা জল) ধারণ করতে সক্ষম । স্বভাবশূন্যতার অর্থ অস্তিত্বহীনতা নয়,
কেবল অস্তিত্বের নির্ভরশীলতা বোঝায় ।
২এর
যুক্তি মাধ্যমকরা স্বীকার করেছেন, কিন্তু এতে শংকরের যুক্তিখন্ডনে তাঁদের কোন
সমস্যা হয়নি কারণ, খেয়াল করে দেখুন, শংকরের যুক্তি ছিল একটি স্তরের বাস্তবতাকে
অস্বীকার করতে হলে অন্য একটি স্তরে বাস্তবতার প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন হয় । মাধ্যমক
যেহেতু ব্যবহারিক বাস্তবের (মাধ্যমক দর্শনে যাকে “সংবৃত সৎ” বলা হয়েছে) অস্তিত্বকে
অস্বীকার করেননি, কেবল সেই অস্তিত্বকে স্বভাবশূন্য বলেছেন, চূড়ান্ত বাস্তবকে
(পরমর্থ সৎ) “শূন্যতা” হিসেবে চিহ্নিত করায় কোন সমস্যার উদ্রেক হয় না ।
বেশ,
শংকরাচার্যের যুক্তিখন্ডন নাহয় হল, কিন্তু উদ্যোতকারের অভিযোগের কী উত্তর দেবেন
মাধ্যমকরা? উপরোক্ত যুক্তি থেকেই এটা স্পষ্ট যে জ্ঞান আহরণের মাধ্যম বা “প্রমাণের”
অস্তিত্ব থাকলে মাধ্যমকদের কোন সমস্যা নেই যদি এটা দেখানো যায় যে তাদের অস্তিত্বও
স্বভাবশূন্য । এবং নাগার্জুন তাঁর যুক্তির মাধ্যমে ঠিক এটাই প্রতিষ্ঠা করে
দেখিয়েছেন । অন্য সবকিছুর মতো প্রমাণেরাও স্বভাবরহিত; জ্ঞেয় বিষয় (object of knowledge)কে
প্রতিষ্ঠা করতে যেরূপে প্রমাণের প্রয়োজন হয়, সেরূপেই প্রমাণসমূহকে প্রতিষ্ঠা করতে
জ্ঞেয় বিষয়ের প্রয়োজন হয় । প্রমাণ নিজেকে নিজেই প্রতিষ্ঠা করতে পারেনা, সেটা সম্ভব
হলে প্রত্যক্ষ (বৌদ্ধদর্শনে প্রমাণের মধ্যে অন্যতম বলে যা গণ্য হয়) নিজেকেই
প্রত্যক্ষ করতে পারত ! প্রত্যক্ষণের জন্য কোন বাহ্যিক জ্ঞেয় বিষয়ের প্রয়োজন পড়ত না
।
এখানে
একটা বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে যে জ্ঞেয় বিষয় ও প্রমাণের একে-অন্যকে প্রতিষ্ঠার
ব্যাপারটা কী চক্রাকার যুক্তিদোষে (circular logic) দুষ্ট নয়? একদিকে আমি
বললাম, “আমার সামনে একটা টেবিল রয়েছে বলে আমি জানি কারণ আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি”
আবার অন্যদিকে বললাম, “টেবিলটার উপস্থিতির জ্ঞানই আমার দর্শনেন্দ্রিয়কে প্রমাণ
হিসেবে প্রতিষ্ঠা করল” । কিন্তু দৃষ্টি প্রমাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য যে “টেবিলের
উপস্থিতি জ্ঞান” প্রয়োজন সেটা তাহলে এল কোথা থেকে?
এর
একটা উত্তর হতে পারে এই যে প্রমাণসমূহরা (মাধ্যমক দর্শনে প্রমাণ চার প্রকার:
প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান বা উপমা, ও আগম বা বাক্য) একে-অন্যকে প্রতিষ্ঠা করে;
কিন্তু সেখানেও একই চক্রাকার যুক্তিদোষ দেখা দেয়, যদি না আমরা ধরে নিই যে আমাদের
কিছু বিশ্বাসকে যথার্থ জ্ঞান করে প্রমাণসমূহের নির্ভরশীলতার মূল্যায়ণ করা যায় ।
কিন্তু এই বিশ্বাসের যথার্থতা যেহেতু প্রমাণযোগ্য নয় সেহেতু স্বীকার করতে হয় যে
প্রমাণসমূহের প্রতিষ্ঠা আমাদের বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল । অতএব, দেখা যাচ্ছে যে
প্রমাণের অস্তিত্বও স্বভাবসম্পন্ন নয় ।
সুতরাং,
শূন্যবাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বিষয়ের অস্তিত্বের যেমন বিরোধ নেই তেমনই সেই বিষয়ের
প্রতিষ্ঠাতা প্রমাণের অস্তিত্বেরও কোন বিরোধ নেই ।
তিব্বতী
বৌদ্ধধর্ম বিশেষজ্ঞ মার্কিন দর্শনের অধ্যাপক জে গারফিল্ড তাঁর “Madhyamaka is Not Nihilism” প্রবন্ধে
শূন্যবাদের দৃষ্টিভঙ্গীর যে প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটাকে তুলে ধরে এই দীর্ঘ
আলোচনায় ইতি টানছি–
শূন্যতাই
ব্যবহারিক বাস্তবতাকে অর্থ প্রদান করে, ব্যবহারিক বাস্তবই শূন্যতাকে ব্যাখ্যা করে
। শূন্যতার সম্যক জ্ঞান প্রাপ্ত হলে দ্বিবিধ সত্যের (সংবৃত ও পরমার্থ) তাদাত্ম্য (identity) উপলব্ধ
হয় । কিন্তু তাহলে বলতে হয়, সমস্ত জাগতিক প্রপঞ্চের শূন্যতাকে গুরুত্ব প্রদান করার
অর্থ জাগতিক প্রপঞ্চের ব্যবহারিক বাস্তবতাকে গুরুত্ব প্রদান করা । আর বাস্তবতাকে
গুরুত্ব প্রদানের অর্থ নাস্তিবাদকে অস্বীকার করা । মাধ্যমকের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে
শূন্যতার অর্থ অনস্তিত্ব নয়, বরং তা অস্তিত্বশীল হওয়ার একমাত্র উপায় ।
References
1. ১. Westerhoff, J. (2016). On
the Nihilist Interpretation of Madhyamaka. Journal of Indian Philosophy, 44(2), 337–376.
2. ২. Garfield, J.L. (2012). Madhyamaka is Not
Nihilism.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন