গরুর দুধ যে বাচ্চাদের
জন্য কতোখানি উপকারী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এর মধ্যে উপস্থিত পুষ্টিকর
উপাদানগুলি তাদের দাঁত ও হাড়ের গঠনে সাহায্য করে। গরুর দুধে যে ভিটামিন ডি থাকে
তা শরীরকে ক্যালসিয়াম শোষণে সহায়ককারী। এর মধ্যেকার প্রোটিন বাড়ন্ত বাচ্চাদের
পেশী তৈরি করে এবং তাকে মজবুত করে তুলতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গরুর
দুধের ক্যালসিয়াম এবং কার্বোহাইড্রেট তাদের জন্য খুবই উপকারী। কিন্তু তাহলেও একটি
নির্দিষ্ট বয়সের আগে শিশুকে গরুর দুধ দেওয়া কোনোমতেই উচিত নয়।
আর ঠিক এই প্রসঙ্গেই অর্থাৎ শিশুদের কবে থাকতে গরুর দুধ দেওয়া যেতে পারে সেই নিয়ে মায়েদের মনে অনেক প্রশ্ন। সেই সংক্রান্ত আলোচনাই করা হলো এখানে।
গরুর দুধ কখন থেকে দেওয়া যাবে?
বাচ্চার একবছর বয়স সম্পূর্ণ হওয়ার আগে শিশু বিশেষজ্ঞরা নিষেধ করেন তাদের গরুর দুধ দিতে। সেই সময়টা তাদের জন্য ব্রেস্টমিল্ক অথবা ফর্মূলা মিল্কই আদর্শ। একবছর বয়স সম্পূর্ণ হওয়ার পর থেকে তাদের ফুল ফ্যাট মিল্ক দেওয়া যেতে পারে। তবে তার মানে এই নয় যে শিশুকে ব্রেস্টফিড করা বন্ধ করে দিতে হবে। শিশুর একবছর বয়সের পর থেকে তাকে গরুর দুধ দেওয়ার সঙ্গে ব্রেস্টফিডিংও অনায়াসেই করা যায়।
একবছরের আগে কেন নয়?
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন যা প্রায় সব মায়েদের মনেই তৈরি হয়। শিশুর একবছর বয়স সম্পূর্ণ হওয়ার আগে তাদেরকে গরুর দুধ দিলে সমস্যাটা কোথায়! এর কয়েকটি কারণ আছে।
এটা অবশ্যই সত্যি যে গরুর
দুধ অত্যন্ত পুষ্টিকর। কিন্তু ছোটো শিশুদের ক্ষেত্রে সেটি সমস্যা তৈরি করতে পারে।
শিশুদের পাচনতন্ত্র উন্নতমানের হয় না। গরুর দুধে ল্যাক্টোজ সুগার ও কেসিন
প্রোটিনের পরিমাণ থাকে অনেক বেশি। এই বিপুল পরিমাণ সুগার ও প্রোটিন পরিপাকের জন্য
প্রয়োজনীয় ল্যাক্টেজ ও কাইমোসিন এনজাইম শিশুদের শরীরে সাধারণত থাকে না। ফলস্বরূপ, উচ্চমানের প্রোটিন হজম করতে গিয়ে শিশুদের
শারীরিক সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে।
এছাড়াও গরুর দুধে থাকে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস। এই সোডিয়ামের পরিমাণ ব্রেস্টমিল্কের প্রায় চারগুণ, পটাশিয়ামের পরিমাণ প্রায় তিনগুণ এবং ফসফরাসের পরিমাণ প্রায় ছ'গুণেরও বেশি। একবছরের কমবয়সী শিশুদের কিডনি এমনিতেই অপরিণত থাকে। এই অতিরিক্ত মাত্রার খনিজ নিষ্কাশনে কিডনি নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হয়।
গরুর দুধে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদান উপস্থিত থাকলেও শিশুদের জন্য উপযুক্ত পরিমাণে আয়রন থাকে না, যেটি তাদের প্রথম বছরের জন্য শারীরিক বিকাশে অত্যন্ত দরকারি। এই আয়রনের ঘাটতির জন্য শিশুদের শরীরে রক্তাল্পতার সম্ভাবনা থেকে যায়।
গরুর দুধ নয়, কিন্তু দই কেন?
শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে শিশুদের সাত-আট মাস বয়স থেকে দই দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাদের একবছর বয়সের আগে গরুর দুধ দিতে নিষেধ করা হলে দই কেন দেওয়া যাবে! কারণটি হল দই তৈরি করার পদ্ধতিতে দুধ থেকে বেশীরভাগ ল্যাক্টোজগুলি ভেঙ্গে যায় এবং তার ফলে সেটি শিশুদের সহজেই সহ্য হয়, পরিপাকেও কোনোরকম সমস্যা হয় না। তবে অবশ্যই টক দইয়ের কথা বলা হচ্ছে।
কীভাবে শুরু করা যাবে?
শিশুর একবছর বয়স সম্পূর্ণ হলেই যে প্রথমে তাকে একেবারে নির্ভেজাল গরুর দুধ খাওয়া ধরিয়ে দিলেন তা কিন্তু একেবারেই নয়। তার শরীরকে প্রথমে গরুর দুধের সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে এবং সেই পদ্ধতি হবে অত্যন্ত ধীরে। প্রথমদিকে ব্রেস্ট মিল্ক বা ফর্মুলা মিল্কের সঙ্গে গরুর দুধ মিশিয়ে শিশুকে খাওয়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। ১:৩ অনুপাতে গরুর দুধের সাথে ব্রেস্ট মিল্ক অথবা ফর্মূলা মিল্ক মিশিয়ে অর্থাৎ একভাগ গরুর দুধের সঙ্গে তিনভাগ ব্রেস্ট মিল্ক বা ফর্মুলা মিল্ক মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। ধীরে ধীরে ব্রেস্ট মিল্কের পরিমাণ হ্রাস করতে থাকবেন এবং গরুর দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে থাকবেন। অবশেষে শুধুমাত্র গরুর দুধ দেওয়া শুরু করুন।
তবে শিশুকে সরাসরি গরুর দুধ খাওয়ানোর আগে সেই দুধ দিয়ে বানানো কোনো খাবার স্বল্প পরিমাণে তাকে অবশ্যই খাইয়ে দেখা উচিত যে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। কোনরকম সমস্যা না থাকলে ব্রেস্ট মিল্ক বা ফর্মুলা মিল্কের সঙ্গে গরুর দুধ মিশিয়ে তাকে নিয়মিত খাওয়ানো যেতেই পারে।
শুরুতে ফুল ফ্যাট দুধ কেন?
শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, ফুল ফ্যাট দুধ দিয়েই শুরু করা উচিত। গরুর দুধে যে ফ্যাট থাকে, বাড়ন্ত বাচ্চার বিকাশে সেটি সহায়ক। এই ফ্যাট ভিটামিন এ এবং ডি শোষণ করতে শরীরকে সাহায্য করে। বাচ্চার ওজন অতিরিক্ত না হলে লো-ফ্যাট গরুর দুধ না দেওয়াই শ্রেয়। কারণটি হলো, লো-ফ্যাট গরুর দুধে উচ্চমাত্রায় পটাশিয়াম, সোডিয়াম, প্রোটিন ও ক্লোরাইড থাকে যেগুলি পরিপাক করার ক্ষেত্রে বাচ্চার সমস্যা হয়। তবে শিশুর দু'বছর বয়স সম্পূর্ণ হয়ে গেলে তাকে ফুল ফ্যাট দুধের পরিবর্তে লো-ফ্যাট দুধ দেওয়া শুরু করতে পারেন।
আর পরিমাণ?
American Academy of Pediatrics (AAP) এর মতে, ১৮ মাসের বাচ্চার জন্য প্রতিদিন ১-১.৫ কাপ
গরুর দুধ যথেষ্ট। বাচ্চার বয়স ২ বছর হলে তাকে প্রতিদিন ২ কাপ করে গরুর দুধ দেওয়া
যেতে পারে। তবে গরুর দুধের কারণে বাচ্চার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হলে এই বিষয়ে তার
চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করাই শ্রেয়।
শিশুর ল্যাক্টোজ অসহিষ্ণুতা থাকলে?
গরুর দুধের প্রধান উপাদান হলো ল্যাক্টোজ। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে গরুর দুধে উপস্থিত বিপুল পরিমাণ ল্যাক্টোজ পরিপাক করার জন্য শিশুদের শরীরে প্রয়োজনীয় ল্যাক্টেজ এনজাইমের স্বল্পতা থাকে। শিশুর একবছর বয়স সম্পূর্ণ হলে তেমন কোনো সমস্যা সাধারণত তৈরি হয় না। কিন্তু তাহলেও কিছু কিছু শিশুকে গরুর দুধ হজম করতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাদের শরীর এই ল্যাক্টোজ সহন করতে পারে না যার কারণে সেইসব শিশু হয় ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্স। এক্ষেত্রে গরুর দুধ খাওয়ার কারণে তাদের জ্বর, বমি, তলপেটে ব্যথা, ডায়েরিয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।
ল্যাক্টোজ অসহিষ্ণুতা ছাড়াও আপনার শিশুর গরুর দুধে অ্যালার্জি আছে বলে মনে হলে সয়া দুধের মতো গরুর দুধের বিকল্পগুলির জন্য আপনার শিশুর চিকিৎসকের সঙ্গে অবশ্যই পরামর্শ করুন।
স্বাদ পছন্দ না হলে?
এই সমস্যায় অধিকাংশ অভিভাবককে পড়তে হয়। এতোদিন ধরে ব্রেস্ট মিল্ক বা ফর্মূলা মিল্ক খাওয়ার পর গরুর দুধের স্বাদ আর বাচ্চার পছন্দ হয় না। তেমনটা হলে প্রথমদিকে ব্রেস্ট মিল্ক বা ফর্মুলা মিল্কের সঙ্গে সামান্য পরিমাণে গরুর দুধ মিশিয়ে তাকে খাওয়াতে পারেন। এরপর ধীরে ধীরে সেই মিশ্রণে গরুর দুধের অনুপাত বাড়াতে থাকুন। দুধ পান করার জন্য বাচ্চাকে দিন রংবেরংয়ের sippy cup। এতে তার আগ্রহ তৈরি হবে।
এছাড়াও গরুর দুধ দিয়ে বানানো নানারকম খাবার দেওয়া যায় বাচ্চাকে, যেমন দুধ সুজি, দুধ ভাত, দুধ ওটস, দুধ রুটি, দুধ কর্নফ্লেক্স ইত্যাদি। তবে বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য অহেতুক চিনি যোগ করতে যাবেন না, সামান্য মধু অথবা গুড় মেশাতে পারেন। একটু সময় দিলে আপনার শিশু গরুর দুধের সঙ্গে ধীরে ধীরে ঠিকই অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
_______________________
কলমে - পৌ ষা লী ব্যা না র্জী
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন